সচ্চরিত্র নির্মাণের সর্বোত্তম নমুনা

চরিত্রের সারমর্ম:

মানুষের রূপ দেখা যায় কিন্তু গুণ দেখা যায় না, কেননা গুণ এক অদৃশ্য বস্তু, ঠিক যেমন বায়ু। বাতাস বইলে তার উপস্থিতি বোঝা যায়, না বইলেও মানতেই হয় যে, পৃথিবীর সর্বত্রই সব সময় বাতাসের উপস্থিতি বর্তমান। বিশ্ব প্রকৃতিকে জুড়ে যেমন বাতাসের অবস্থান- মানব জীবনকে জুড়ে তেমনি প্রত্যেক মানুষের স্বভাব-চরিত্রের উপস্থিতি। মানুষটি বেঁচে আছে তো তাঁর নিজস্ব স্বভাব-চরিত্র তার জীবনকে, জীবনের সমস্ত চিন্তা-চেতনা ও কর্ম সাধনাকে বেষ্টন করে রয়েছে। এমনকি মৃত্যুর পরেও অসাড় দেহের ভেতর দেহধারীর জীবনের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ অদৃশ্যমান স্বভাব-চরিত্রটি নিস্তেজ অবস্থায় বিরাজমান থাকে। আর পার্থিব জীবনের এই স্থায়ী- সম্পদটিকে সাথে নিয়েই তাকে কবরে বা শ্মশানঘাটে যেতে হয়। কেননা পার্থিব স্বভাব-চরিত্রের ভিত্তিতেই একজন মানুষের চিরস্থায়ী পারলৌকিক জীবনের রূপরেখা স্থিরীকৃত হয়ে থাকে। পৃথিবীরে সমস্ত আসমানী কিতাবে এবং সব নাবী-রাসূলের শিক্ষায় এ কথাটিই বলা হয়েছে। 

ইসলাম ও আসমানী কিতাবে সৎচরিত্রের অনুপ্রেরণা

সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ কুরআন ও বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) এর শিক্ষায় মানব স্বভাব চরিত্রকেই জীবনের সার-সম্পদরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। বায়ুমণ্ডলের বিশুদ্ধতার ওপর যেমন কোনা ভূখণ্ডের সুস্থতা ও সৌন্দর্য নির্ভরশীল, মানবজীবনের সাফল্যও তেমনি সচ্চরিত্রতার ওপর নির্ভরশীল। উল্লেখ্য যে, দ্বীন ইসলাম মানুষের সচ্চরিত্রতাকেই তার চিরস্থায়ী পারলৌকিক জীবনের সফলতার মৌল উপাদানরূপে বর্ণনা করেছে। মহানাবী-মহামানব মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) এর জীবন-কর্ম সাধনাকে মানবীয় সচ্চরিত্রতার সর্বশ্রেষ্ঠ নমুনা বলা হয়েছে। এজন্যই তাঁরই জীবনাদর্শকে অনুসরণ করে সচ্চরিত্রতা অর্জন করার জন্য সমগ্র মানবমণ্ডলীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কুরআনের ঘোষণা 'ইন্নাকা লা-আলা খুলুকিন আযীম' - নিশ্চয়ই তুমি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।' বলা হয়েছে যে, নাবী-জীবন সমস্ত মানুষের জন্য 'উসওয়াতুন হাসানা' অর্থাৎ সর্বোত্তম অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয় নমুনা। 

হাদীস সাহিত্যে চরিত্র বিকাশের অনুপ্রেরণা:

প্রিয় নাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম) সচ্চরিত্রতার প্রয়োজন ও গুরুত্বকে নানাভাবে বুঝিয়েছেন, যাতে মানুষ চরিত্র গঠনের প্রতি প্রলুব্ধ হয়। এবং উসামা ইবনু শরীক আনন্ধু) হতে বর্ণিত হাদীসন্বয়ে বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম? আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি কে? এই সওয়ালের জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) বলেছেন, 'আহসানুহুম খুলুকা' অর্থাৎ 'যে ব্যক্তি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।'

রোজ হাশরের অনিবার্য হিসাব নিকাশের কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রিয় নাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) বলেছেন, 'মীযানে (কিয়ামতের দিবসে পাপ-পুণ্য ওজনের পাল্লায়) সর্বাপেক্ষা ভারী বস্তু হলো, উত্তম চরিত্র।' মুমিন মুসলিমদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই পূর্ণ ঈমানদার, যে ব্যক্তি চরিত্রগত দিক হতে সর্বোত্তম, এ প্রসঙ্গে কিছু সংখ্যক হাদীসের সাথে আমাদের সম্যক পরিচিতি অত্যাবশ্যক-

আবু সাউদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে মারফু সূত্রে বর্ণিত, মুমিনদের মধ্যে পূর্ণ ঈমানদার সেই ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে চরিত্রগত দিক হতে উত্তম, নম্র স্বভাবী, অতিথিপরায়ণ, যারা অন্যকে ভালোভাসে এবং অন্যের ভালোবাসা পায়। আর ঐ ব্যক্তির মাঝে কোনো কল্যাণ নেই, যে অন্যকে ভালোবাসেনা, অন্যের ভালোবাসাও পায়না।

আবু হুরাইরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহ্ আলাইহি অসাল্লাম) বলেছেন, "মুমিনদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই পরিপূর্ণ ঈমানদার, যে সর্বাপেক্ষা চরিত্রবান। সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর কাছে সবচেয়ে ভালো।"

আয়িশা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম) বলেন, "নিশ্চয় মানুষ তার উত্তম চরিত্রের কারণে (বিনিময়ে) রাতে দণ্ডায়মান (রাত জেগে নফল স্বলাত আদায়কারী) এবং দিনে (নফল) সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির (মতন) মর্যাদার অধিকারী।”

চারিত্রিক গুণাবলি যে কতো মহৎ মহান জিনিস প্রিয় নাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) এর নিম্নোক্ত বাণী হতে সে-কথা সুস্পষ্ট বোঝা যায় - আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) বলেছেন, "আমি কি তোমাদের সেই ব্যক্তির সংবাদ দিবনা যে ব্যক্তি (জাহান্নামের) আগুনের জন্য হারাম তথা যার জন্য (জাহান্নামের) আগুন হারাম? প্রত্যেক হৈতেষী, নম্র ও শিষ্ট-শান্তর জন্য (জাহান্নামের আগুন হারাম)"।

এই হাদীসটির মর্মার্থ অনুধাবন করার পরে সচ্চরিত্রের গুরুত্ব-মহত্ব সম্পর্কে আরও বেশী কথা বুঝবার প্রয়োজন হয়তো থাকেনা, কারণ মরণোত্তর জীবনে জাহান্নামের আগুন হতে আত্মরক্ষা করাই হলো মুমিন-মুসলিমের সবচেয়ে বড় আকাঙ্খা। চরিত্রবান আগুনে পুড়বেনা ও আগুন তাকে পোড়াবেনা এটা কি কম বড়ো সুসংবাদ।

তাহলে কিভাবে আপনি আপনার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাবেন:

এখন প্রশ্ন হলো যে, সচ্চরিত্রতা অর্জনের প্রকৃত উপায় কি? রাসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) কে আল্লাহ তাআলা স্বয়ং সর্বোত্তম চরিত্রাধিকারী বলেছেন, চরিত্র নির্মাণের জন্য তাঁকেই অনিবার্যভাবে অনুসরণ করতে বলেছেন। প্রিয় নাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) এর ইন্তেকালের পরে কিছু লোক মা- আয়িশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) কে নাবীজীর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি সোৎসাহে উত্তর  দিয়েছিলেন, পবিত্র কুরআনে বর্ণিত সর্বোত্তম স্বভাব- চরিত্রেরই জীবন্ত প্রতীক ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সর্বোত্তম চরিত্র নির্মাণের সমস্ত, উপাদান-থিওরীরূপে পবিত্র কুরআনে তথা প্র্যাকটিকালভাবে মহানাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) -এর জীবন-কর্ম-সাধনায় উপস্থিত রয়েছে। এজন্যই প্রিয় নাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম) তাঁর এক বহুচর্চিত বয়ানে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেছেন- 'সর্বোত্তম বাণী আল্লাহ তাআলার কিতাব কুরআন এবং সর্বোত্তম জীবনপথ হলো মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) এর জীবনপথ।'

প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা উপরোক্ত দুটি স্রোত হতে সচ্চরিত্র নির্মাণের রসদ সংগ্রহ করতে রাজি আছি কি? কুরআন বলে যে, সৎ নিয়‍্যাতে, সত্যনিষ্ঠভাবে যে ব্যক্তি সত্যপথ পাওয়ার জন্য চেষ্টা-সাধনা করে থাকে, আল্লাহ তাকে তাওফীক দানে ভূষিত করেন। আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দ্বীনি জ্ঞানবিদ্যা দান করেন। হাদীসে বলা হয়েছে, আল্লাহর দিকে মানুষ হেঁটে এলে, দয়াময় আল্লাহ তার দিকে দৌড়িয়ে আসেন। এ-সকল কথা যখন গ্যারান্টিযুক্ত সত্যকথা, দিকে দৌড়িয়ে আমেন হয়ে উঠবে না কেন? কিন্তু এতদসত্বেও যদি চেষ্টিত না হই, তবে আমাদের শেষ গতি কী হতে পারে সে সম্পর্কে কুরআনের ঘোষণা তখন-আমরা

بَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ

“হে ঈমানদার লোকেরা। তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো, আর (অবহেলায়) নিজেদের আমল নষ্ট করো না” (৪৭:৩৩)।

وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَلَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلاً .

“যা-লিম মানুষরা (রোজ হাশরে) নিজেদের হাত নিজেই কামড়াবে আর বলবে- হায়। আমি যদি রাসূলের সঙ্গ গ্রহণ করতাম” (২৫:২৭)।

فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيم.

"রাসূলের হুকুম অমান্যকারীদের ভয় করা উচিত যে তারা যেন কোনো ফিৎনায় না পড়ে কিংবা তাদের ওপর কোনো মর্মভুদ আযাব না এসে পড়ে” (২৪:৬৩)।

এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনকে তিলাওয়াত করা, অর্থোদ্ধার করা তথা প্রিয় নাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) এর জীবনাদর্শকে বিনা বাক্যে ব্যয়ে সানন্দে মেনে নেওয়াকে দুর্লভ সম্পদ 'ঈমান'-এর ও 'মুসলিমরূপে' বেঁচে থাকার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে বর্ণনা করেছেন। কুরআনী শিক্ষা ও নাবী জীবনকে পূর্ণরূপে অথবা আংশিকভাবে বাদ দিয়ে চরিত্র গঠনের জন্য যদি আমরা অন্য কোথাও যাই, তবে কি আমরা ঈমানওয়ালা-মুসলিমরূপে বেঁচে থাকতে পারবো? অথচ কুরআনে বলা হয়েছে, তোমরা ইসলামের মধ্যে পুরোপুরি প্রবেশ করো। হাদীসে বলা হয়েছে, ঈমানকে পরিপূর্ণ করো। আতিউল্লাহ এবং আতিউর রাসূল' ছাড়া কি এ কাজ সম্ভব?

উপসংহার 

দুঃখের বিষয় যে, আমরা উত্তম ও এবং সর্বোত্তম স্বভাব-চরিত্র নির্মাণের প্রয়োজনকে তেমন গুরুত্বই দিই না। মোটামুটি একটা কিছু হলেই চলবে, একালে মুসলিমদের এমনই মনোভাব। দুনিয়াদারিতে উত্তম-সর্বোত্তম হওয়ার ইচ্ছা আমাদের যতো দুর্বার ও প্রবল, দ্বীনদারিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ইচ্ছা আমাদের ততো সক্রিয় সতেজ নয়। ফলে সব মিলিয়ে উপস্থিতকালে আমরাও সেকালের অভিশপ্ত ইহুদী-নাসারাদের মতনই আসমানী কিতাবের কিছুটা মানতে রাজি, আর কিছুটা মানতে একেবারেই নারাজ। এটাও যে একশ্রেণীর মারাত্মক প্রবৃত্তিপূজা ও তার সর্বশেষ পরিণাম অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হতে বাধ্য, আল্লাহর বিধানে সে-কথা বারংবার উচ্চারিত হয়েছে। অতএব জগৎ ও জীবনের আরও সব বিষয়বস্তুর মতন চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে অপরিহার্যভাবেই কুরআনী আদেশ ও মহা নাবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) এর জীবনাদর্শকে অনুসরণ করতে হবেই। রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অ সাল্লাম) সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَ إِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ

"নিঃসন্দেহে তুমি নৈতিকতার অতি উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত" (৬৮:৪)।

উল্লেখ্য যে, এ সকল কারণেই আল্লাহ তাআলা বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) কে মানব-চরিত্র নির্মাণের সর্বোত্তম নমুনা ও আদর্শরূপে স্থির করেছেন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁরই জীবনাদর্শের আলোকে চরিত্র গঠনের তাওফীক দান করুন,- আমীন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter