সূরা ফাতিহা ও সূরা আল-বাক্বারার শেষ আয়াতের বিশেষ মর্যাদা

সূচনা

প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর জিবরাইল (আলাইহিস সালাম) এক সাথে বসেছিলেন। হঠাৎ আকাশ থেকে এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে এলো । যা ছিল স্পষ্ট, উচ্চস্বরে, অথচ তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। রাসূলুল্লাহ চারিদিকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তখন জিবরাইল (আ.)  তাঁর মাথা উঁচু করে বলল: “আজ আসমানে একটি দরজা খোলা হয়েছে, যা এর আগে কখনও খোলা হয়নি।” জিবরাইল (আ.) এই কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ফেরেশতা তাদের সামনে উপস্থিত হল। তখন জিবরাইল (আ.) নবীজীকে বলল: “ইনি এমন এক ফেরেশতা, যিনি আজ পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো নাযিল হয়েছেন; এর আগে কখনও তিনি নামেননি।”

নতুন এক অতিথি, যে সদ্য খোলা স্বর্গীয় দরজা দিয়ে পৃথিবীতে নেমে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ও তার ফেরেশতা সঙ্গীকে সালাম করল। এরপর নবীজিকে লক্ষ্য করে বলল: “আপনাকে এমন দুটি বস্তু প্রদান করা হয়েছে, যা আপনার পূর্বে কোনো নবীকে দেওয়া হয়নি। তা হলো—কিতাবের সূচনা অংশ (অর্থাৎ সূরা আল-ফাতিহা), এবং সূরা আল-বাক্বারার শেষ আয়াতসমূহ। আপনি যখনই এগুলো থেকে কোনো আয়াত পাঠ করবেন, তখনই আপনার দোয়া কবুল হবে।”

এই ঘটনাটি মূলত গায়েবের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। আমাদের পার্থিব উপলব্ধির বাইরে এমন এক ঘটনা, যা ভাষায় পুরোপুরি প্রকাশ করা যায় না। তবুও আমরা উপলব্ধি করতে পারি এ ঘটনার মাহাত্ম্য এবং প্রিয়নবী -কে যে অসাধারণ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে তার গুরুত্ব। এ মর্যাদার ছোঁয়ায় তাঁর উম্মতরাও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ফেরেশতার ঘোষিত এই বিশেষ মর্যাদার দুটি অংশ হলো—

প্রথমত: কিতাবের সূচনা অর্থাৎ সূরা আল-ফাতিহা। এ সূরাটিই আমরা প্রত্যেক নামাজের প্রতিটি রাকাতে পাঠ করি।

দ্বিতীয়ত: সূরা আল-বাক্বারার শেষ অংশ, যা দোয়ার অমুল্য ধনভাণ্ডার।

কুরআনের বিভিন্ন সূরা ও আয়াতের অসাধারণ ফজিলত

নিঃসন্দেহে সূরা আল-ফাতিহা ও সূরা আল-বাক্বারা কুরআনের অনেক সূরার মধ্যে অন্যতম, যাদের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। আসলে, কুরআনের প্রতিটি সূরা ও আয়াতের ফজিলতই কুরআনিক বিজ্ঞান (উলুমুল কুরআন)-এর এক প্রেরণাদায়ক ও আত্মিক উন্নয়নমূলক শাখা। অনেক মুসলিমই এমন কিছু আয়াত সম্পর্কে জানেন, যেগুলো আত্মিক রোগের চিকিৎসায় (রুকিয়া) পাঠ করা হয়; কিছু সূরা রয়েছে, যেগুলো কবরের শাস্তি থেকে রক্ষা করে; আবার কিছু আয়াত রয়েছে, যেগুলো কিয়ামতের দিন ছায়া প্রদান করবে। তবে এসব উদাহরণ কুরআনের অসীম ফজিলতের সাগরের তুলনায় অতি সামান্য মাত্র।

কুরআনের ফজিলত অধ্যয়ন করার উপকার অনেক বেশি। কেউ যখন কোনো নির্দিষ্ট সূরা ও আয়াত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে ও অধ্যয়ন করে, তখন তার সঙ্গে পরোক্ষভাবে আল্লাহর সাথে একটি গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সম্পর্ক গড়ে ওঠার মাধ্যমে মুমিনের জীবনে শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা আসে। নিয়মিত তিলাওয়াত একজন মুসলিমের আত্মিক শক্তি বাড়ায় এবং তাকে আল্লাহর কালামের মাধ্যমে সান্ত্বনা, দিকনির্দেশনা ও সঙ্গ লাভের অভ্যাসে অভ্যস্ত করে তোলে। নিয়মিত পাঠের অভ্যাস এক সময় কুরআনকে মুখস্থ করা সহজ করে দেয় এবং ধীরে ধীরে আরও আয়াত মুখস্থ করার সুযোগ তৈরি হয়। এভাবে ধারাবাহিক তিলাওয়াতের মাধ্যমে কুরআন হয়ে ওঠে জীবনের এক বিশ্বস্ত সাথী—যে সঙ্গী দুঃখ-কষ্টের সময় সান্ত্বনা দেয়, ঈমানের মৌলিক শিক্ষা, বিধান ও দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন করে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সওয়াব অর্জনের মাধ্যম হয়।

সাধারণ ফজিলতের পাশাপাশি, কুরআনের বিশেষ কিছু সূরা ও আয়াতের মাধ্যমে আরও আলাদা পুরস্কার, বরকত ও সুরক্ষাও লাভ করা যায়। যেমনঃ দুনিয়ার সুরক্ষায় আয়াতুল কুরসি। কবরের আযাব থেকে রক্ষায় সূরা আল-মুলক। কিয়ামতের ময়দানে সুরক্ষায় সূরা আল-বাক্বারা। তাছাড়া সূরা আল-কাউসার আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, আর আয়াতুল কুরসি আল্লাহর সর্বাবস্থায় রক্ষণাবেক্ষণের কথা শিক্ষা দেয়। এই সমস্ত অনুগ্রহ ও নেয়ামতের কথা স্মরণ করে মুমিনের অন্তরে কৃতজ্ঞতা জন্ম নেয়। এর ফলে আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা (তাওয়াক্কুল) বাড়ে এবং একইসাথে দুনিয়ার কাজে সচেতনতা ও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণেও উৎসাহিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, সূরা আল-ফালাক ও সূরা আন-নাস আমাদের শেখায় কীভাবে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে হয় এবং আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ ও রহমতের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে হয়।

ফজিলতের ধারায় সূরা আল-ফাতিহা: আলোয় উদ্ভাসিত এক সূচনা

যদিও কুরআন আরবিতে অবতীর্ণ, তবে যারা আন্তরিকতা ও নিষ্ঠারের সাথে উচ্চারণের নিয়ম অনুসারে কুরআন পড়ার চেষ্টা করে, তারাও এর সওয়াব ও ফজিলত থেকে বঞ্চিত হবে না। এ ক্ষেত্রে সেই মু’মিনা নারীর কথাও প্রযোজ্য, যারা হায়েযের সময়েও মুখস্থ থেকে কিংবা কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে কুরআন তিলাওয়াত করেন। এতে বোঝা যায়, বছরের প্রতিটি সময়েই আল্লাহর কিতাবের সাথে সম্পর্ক রাখা প্রত্যেক মুমিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও কাঙ্ক্ষিত।

এখানে ‘ফজিলত’ বলতে বোঝানো হয়েছে—কোনো নির্দিষ্ট সূরা বা আয়াতের এমন কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা সহিহ বর্ণনায় উল্লেখ আছে। যেমন: বিশেষ সওয়াব, বিশেষ সুরক্ষা, নবীজি কর্তৃক নির্দিষ্ট সংখ্যায় পাঠ করা অথবা তাঁর প্রিয়তা অর্জন করা ইত্যাদি।

সূরা আল-ফাতিহা: মুক্তির দিশার আলো

যেমন সমুদ্রযাত্রী মাঝি কখনো কখনো একটিমাত্র স্পষ্ট ও সহজ দিকনির্দেশনার প্রয়োজন অনুভব করে—একটি তীব্র আলো যা দূর থেকে নিরাপদ উপকূলে পৌঁছাতে সাহায্য করে, তেমনি সত্যের সন্ধানকারী পথিকের জন্যও কুরআনের অন্যান্য সূরা সহায়ক হলেও সূরা আল-ফাতিহা একাই চূড়ান্ত দিশারূপে যথেষ্ট। এ সূরা তার পাঠকদের আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ দেখায়, পার্থিব জীবনে নৈতিক দিকনির্দেশনা দেয় এবং অনন্ত সুখের গন্তব্যে পৌঁছার জন্য পথপ্রদর্শক হয়।

সূরা আল-ফাতিহা কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা। এটি ইসলামের ভিত্তি, সত্যের সারাংশ, রোগের জন্য শিফা, দুশ্চিন্তার জন্য সান্ত্বনা, সুরক্ষা ও এক অদম্য দুর্গ। আল-ফাতিহা এমন এক অনন্য আসমানী ওয়াহী যা শেষ উম্মতের জন্য বিশেষভাবে নাজিল হয়েছে। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মুসলিমগণ কমপক্ষে সতেরো বার এ সূরাটি তিলাওয়াত করেন। এর মাধ্যমে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে নিয়মিত এক সংলাপ স্থাপিত হয় এবং এটি সৃষ্টি জগতের হৃদয়ের জন্য নির্ধারিত চিকিৎসার মতো কার্যকরী।

সূরা আল-ফাতিহার নামসমূহ: ফজিলত ও তাৎপর্যের প্রতিফলন

সূরা আল-ফাতিহার রয়েছে বহু নাম, যা তার ফজিলত ও বিষয়বস্তুর পরিপূর্ণতা প্রকাশ করে। ইমাম কুরতুবি (রহঃ) তার তাফসিরে বারোটি নাম উল্লেখ করেছেন, যা ইমাম তাবারির (রহঃ) অভিমতসহ এখানে তুলে ধরা হলো:

১. আস-সালাত (নামাজ): যেমন হাদিসে এসেছে, আল্লাহ বলেন: "আমি সালাত (নামাজ)কে আমার ও আমার বান্দার মাঝে বিভক্ত করেছি।"

২. আল-হাম্দ (প্রশংসা): কারণ এতে আল্লাহর প্রশংসা রয়েছে।

৩. ফাতিহাতুল কিতাব (কিতাবের সূচনা): এটি কুরআনের সূচনা ও নামাজের সূচনা সূরা। ইমাম তাবারি বলেন, এটি লেখন ও তিলাওয়াত উভয়ের সূচনা হিসেবে কাজ করে, যা পরবর্তী সূরাগুলোর ভূমিকা রচনা করে।

৪. উম্মুল কিতাব (গ্রন্থের মূল): যদিও এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে, অধিকাংশ আলেম একে গ্রহণ করেছেন, কারণ এতে কুরআনের মূল বিষয়বস্তুর সারাংশ রয়েছে। তবে সাহাবি আনাস ইবনে মালিক (রা.) ও তাবেয়ি ইবনে সিরিন (রহ.) মনে করেন যে, এ নামটি লাওহে মাহফুজের জন্য নির্দিষ্ট, আল্লাহর বাণী থেকে: “এটি উম্মুল কিতাবে রয়েছে।”

৫. উম্মুল কুরআন (কুরআনের মূল): এটিও কিছুটা মতভেদের বিষয় হলেও অধিকাংশ আলেম একে গ্রহণ করেছেন। যেমন তিরমিজি সহ অন্যান্য বর্ণনায় নবীজি বলেছেন:

"আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামিন উম্মুল কুরআন, উম্মুল কিতাব এবং সাত পুনরাবৃত্ত আয়াত।"

ইমাম তাবারি বলেন, সূরা আল-ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন বলা হয় কারণ এটি লেখা ও তিলাওয়াতে সর্বপ্রথম স্থান পেয়েছে। আরবরা যে কোনো সারসংক্ষেপকে ‘উম্ম’ বা ‘মা’ বলে থাকে।

৬. আল-মাসানী (বারবার পাঠিত): কারণ এটি প্রতি নামাজের প্রতিটি রাকাতে পড়া হয়।

৭. আল-কুরআনুল আযীম (মহান কুরআন): এতে কুরআনের সমস্ত জ্ঞানের সারাংশ রয়েছে।

৮. আর-রুকইয়া (রুকিয়া বা আত্মিক চিকিৎসা): এক হাদিসে প্রমাণ রয়েছে যেখানে রাসুলুল্লাহ জিজ্ঞাসা করেন, কেউ কীভাবে জানল যে, সূরা ফাতিহা রুকিয়া হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

৯. আশ-শিফা (আরোগ্য): আগের বর্ণনার মাধ্যমেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

১০. আল-আসাস (ভিত্তি): ঈমানের মূল ভিত্তিকে নির্দেশ করে।

১১. আল-ওয়াফিয়া (সম্পূর্ণতা): মুফাসসির ও মুহাদ্দিস সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ (রহঃ) বলেছেন, এটিকে সম্পূর্ণ পড়তে হয়; অন্য সূরার মতো খণ্ডিতভাবে পড়া যায় না।

১২. আল-কাফিয়া (যথেষ্ট): ইয়াহইয়া ইবনে আবি কাসির বলেন, এটি অন্য সূরার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে, কিন্তু অন্য কোনো সূরা সূরা ফাতিহার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না।

সংক্ষেপে বলা যায় যে, সূরা আল-ফাতিহার বহু নাম তার অসীম গুরুত্বের বিভিন্ন দিককে তুলে ধরে। এটি কুরআনের সূচনা, নামাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ, দিকনির্দেশনা, প্রশংসা, আরোগ্য ও উপলব্ধির উৎস। সূরা আল-ফাতিহা একদিকে যেমন ঈমানের কেন্দ্রবিন্দু, তেমনই কুরআনের মূল বার্তা ধারণ করে। এটি এক অনন্য ওয়াহী যা মুসলিম জীবনের প্রতিটি স্তরে দিকনির্দেশনা, শিক্ষা, সঙ্গ ও সুরক্ষা প্রদান করে।

উপসংহার

সূরা আল-ফাতিহা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য এক অপূর্ব নিয়ামত। এর মাঝে রয়েছে বিশ্বাস, দোয়া, প্রশংসা, ইবাদত, পথনির্দেশনা ও রহমতের সমন্বয়। এর বহুবিধ নাম এর বহুমাত্রিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যের প্রতিচ্ছবি। মুসলিম জীবনের প্রতিটি স্তরে সূরা আল-ফাতিহা অপরিহার্য—প্রতিদিনের সালাতে, রোগমুক্তির প্রার্থনায়, দুঃখ-কষ্টে শান্তনার আশ্রয়ে। এটি শুধু মুখে উচ্চারণের বিষয় নয়, বরং হৃদয়ে ধারণ করার এবং জীবনে বাস্তবায়নের আহ্বান। এ সূরার মাধ্যমে আমরা শিখি আমাদের রবের প্রশংসা করা, একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা এবং তাঁর কাছে সঠিক পথের দিশা চাওয়া। এটি জীবনের সর্বস্তরে আমাদের আল্লাহর সান্নিধ্যে রাখে এবং আখিরাতে মুক্তির পথ সুগম করে। তাই সূরা আল-ফাতিহা শুধু কুরআনের সূচনা নয়, বরং ঈমানী জীবনের কেন্দ্রীয় স্তম্ভ।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter