বিদায় হজ্বের উপদেশ ও বিশেষ বার্তা

মক্কা বিজয়ের পরে আরব জনসংখ্যা সারিবদ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে আরম্ভ করেন।   লোকজন  হুজুর মোহাম্মদ (সাঃ) এর থেকে ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষা দীক্ষা, যেমন নামাজ,রোজা এবং বিভিন্ন ইবাদতের শিক্ষা অর্জন করতে শুরু করেন। হুজুর মোহাম্মদ (সাঃ) সমস্ত রকম জ্ঞান বর্জন করেয়িয়েছিলেন শুধুমাত্র হজ ছাড়া। এবার হজ পালন করার পদ্ধতিগুলি শিখানোর সময় ঘনিয়ে এসেছে। ৯ই হিজরীর শেষেরদিকে মুসলমানদের প্রতি হজ ফরজ করেন।  আর এই যে হজ করেছিলেন এটাই হুজুর (সাঃ) এর হিজরতের পরে প্রথম হজ ছিল। মক্কায়  জীবন যাপন করার সময় তিনি বহুবার হজ করেছিলেন, কিন্তু কতবার করেছিলেন তার কোন বিশেষ গণনা নেই। অতএব মুহাদ্দিসরা বর্ণনা করেছেন যে - হুজুর (সাঃ) যখন থেকে চেতনা লাভ করেছেন এ থেকে প্রকাশ হয় যে প্রত্যেক বছর বছর হজ্জে অংশগ্রহন করেছিলেন। 

হজের উদ্দেশ্যে দুনিয়ার প্রত্যেক কোনা কোনা থেকে ও বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ মক্কা শরীফে উপস্থিত হন এবং তিনারা হুজুর মোহাম্মদ (সাঃ) থেকে জ্ঞান অৰ্জন করার চেষ্টা করতেন। আর নবী মোহাম্মাদ (সাঃ) বিভিন্ন তাঁবুগুলিতে গিয়ে তিনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন ও সম্পর্ক গঠন করতেন আর তিনাদের কে ইসলাম ধর্মে দাওয়াত প্রদান করতেন।  অতএব মদিনায় আনসার যারা ছিলেন তিনাদের দুটি গৌত্র ছিল প্রথমত হচ্ছে ওয়াস এবং দ্বিতীয়ত হচ্ছে খাজরাজ তিনাদের সঙ্গে রাসূল (সাঃ) এর সাক্ষাৎ ও সুসম্পর্ক সংগঠিত হয় এই হজ্জের সময়, এই দুই গোত্রের মানুষরা আগমনের পরে নবি (সাঃ) তিনাদের প্রত্যেকটা তাঁবুতে গিয়ে দাওয়াত প্রদান করেন এবং  দাওয়াত গ্রহণ করে নবী (সাঃ) এর প্রত্যেকটা কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেন।    

  

 ৮ হিজরীর রমজান মাসে মক্কা বিজয় হয়।  ৯ হিজরীতে মুসলমানরা একত্রিত হয়ে আবু বাক্কার (রাঃ) এর নেতৃত্বে প্রথম হজ পালন করেন। এবং এই হজ্জের দ্বারা মানুষের মধ্যে কিছু কথা ঘোষণা করলেন। তার পরের বছর হজরত আলী (রাঃ) কে পাঠালেন এবং তিনার দ্বারাও কিছু কথা মানুষের মধ্যে ঘোষণা করলেন এবং পরবর্তী হজ্জের জন্য প্রস্তুত করলেন। আর এই প্রস্তুতির মধ্যে দুই তিনটি কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হল। প্রথমত ছিল যে বিভিন্ন আরব গোত্রের মধ্যে যে চুক্তি ছিল, এর মধ্যে কিছু চুক্তি কে বাকি রাখার ও কিছুকে রদ্দ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত ছিল যে পরের বছর হুজুর (সাঃ) এর হজ পালন করার পূর্বে মক্কা শরীফে কিছু পবিত্রিতা চায়, যেমন প্রথমে বিভিন্ন ধরণের মানুষ হজ্জের জন্য আসতেন, কিন্তু হুজুর (সাঃ) ঘোষণা করেছিলেন যে এই থেকে মুসলমান ছাড়া কেও যেন হজ পালন করতে না আসে। এই আল্লাহর ঘর মুসলমানদের জন্য বিশেষ করে নির্মাণ করা হয়। এছাড়া এই আল্লাহর ঘর  ইব্রাহিম (আঃ) ও ইব্রাহিম (আঃ) এর মিল্লাতের জন্য বিশেষ করা হয়েছিল।  এবং তৃতীয়ত হচ্ছে যে জাহেলী যুগে অনেক মানুষ  হজ পালন করতে আসতেন,তখন তারা নগ্ন হয়ে তাওয়াফ করতেন, এই জন্যেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) হজে আসার পূর্বে ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্য নগ্ন হয়ে তাওয়াফ নিষিদ্ধ করেন । আর মহিলাদের জন্য সম্পূর্ণ কাপড় পরিধান করবেন ও লজ্জা সহিত ও সাহসের সঙ্গে তাওয়াফ করবেন।  আর পুরুষরাও দুটি কাপড়ে বা চাদর দিয়ে নিজের সম্পূর্ণ শরীর কে লুকাবে।   

সারা বছর এই এলান করতে থাকেন যে মুসলমানদের মধ্যে যিনারা রাসূল এর বন্ধুত্ব অর্জন করতে চান, এবং যিনারা রাসূল (সাঃ) কে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে চান তিনারা হজে পৌঁছে যাবেন । এর মতই ১০ হিজরীর হজ্জের জন্য জাজিরাত-আল আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে তৈরী হয়ে মানুষ হজ্জের জন্য পৌঁছায় । একজন বর্ণনা করেছেন যে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার সাহাবীগণ হুজ্জাতুল বিদার উদ্দেশ্যে জমা হয়েছিলেন । এই জামা’য়াত নবী করিম (সাঃ) এর জীবিত কালে সাহাবীগনদের সব থেকে বড় সম্মেলন ছিল, আর হুজুর (সাঃ) এর জীবিত কালে এর মত ইজতিমা হয়নি ।

রাসূল (সাঃ) এর বিদায় খুতবার বার্তা 

জাহেলী যুগের সমাপ্তি 

রাসূল (সাঃ) হুজ্জাতুল বিদ্যার উপলক্ষে অনেক প্রয়োজনীয় বার্তা ঘোষণা করেন । যেমন রাসূল (সাঃ) এক মহৎ বড় ঐতিহাসিক বার্তা ইরশাদ করেন যে : "মনে রাখো ! জাহেলী যুগ সমাপ্তি এবং ইসলামের যুগ আরাম্ভ হয়ে গেছে। সচেতন থাকো ! জাহেলী যুগের প্রত্যেকটি কর্ম কে আজ এই দিনে আমার পদতলে দাফন করে দিলাম।"

জাতিগত ও ভাষাগত অহংকারের সমাপ্তি 

জাহেলী যুগে আরববাসীরা জাতি, ভাষা  এবং রং কে নিয়ে অহংকার করতেন । যেমন কুরাইশ গোত্রের লোকজন অন্য গোত্রের লোকদের সমান ভাবে মেনে নিতেন  না, আরববাসীরা অন্য দেশের লোকজনদের সমান ভাবে মেনে নিতেন না । এর সিরিজ এখনো চলিত, আজ পর্যন্ত এই দুনিয়ায় জাতি, ভাষা এবং রং কে নিয়ে অহংকার করা পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে । 

নবী করিম (সাঃ) মক্কা বিজয়ের দিনে এই আচার কে ভেঙ্গে সকলকে সমান ভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন আর হুজ্জাতুল বিদ্যার উপলক্ষে এর উপর জোর দিয়ে ইরশাদ করেন : 

"ব্যাক্তিগন! অবশ্যই তোমাদের রব এক এবং তোমাদের পিতাও এক ।  সচেতন থাকো ! কোনো আরব কোনো আজমীর উপর, কোনো আজমী কোন আরবদের উপর, কোনো সাদা রঙের ব্যাক্তি কোনো কালো রঙের ব্যাক্তির উপর,  কোনো কালো ব্যাক্তি কোনো সাদা ব্যাক্তির উপর পুন্য অর্জিত হয় না । পুণ্যের ভিট শুধুমাত্র তাকওয়া বা আন্তরিকতার উপর নির্ভর । তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকটতম ও সম্মানের হকদার ব্যাক্তি সেই যে বেশি সীমাবদ্ধতা ।” 

প্রতিশোধের সমাপ্তি 

নবী (সাঃ) এক বিশেষ ঘোষণা এই ছিল যে জাহেলী যুগের সমস্ত কর্ম আমার আমার পদ তল।   কিন্তু দুটো জিনিস কে নবী (সাঃ) বিশেষ করে ইরশাদ করেন : 

"সচেতন থাকো ! জাহেলী যুগের সমস্ত রকমের রক্তক্ষরণ আজ মাফ করা হল, আর জাহেলী যুগের রক্তক্ষরণের মধ্যে সর্ব প্রথম  যার রক্ত মাফ করা হল, তিনি হচ্ছেন হারিস বিন আব্দুল মুত্তালিব।  একজন বর্ণনা করেছেন যে হারিস কে দুধ পান করার জন্য বানু লাইসের দিকে পাঠানো হয়েছিল যেখানে তিনাকে বানু হুজাইল হত্যা করেছিলেন।" (তিরমিজি,২১০৩) 

রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছিলেন যে জাহেলী যুগে প্রতিশোধ ও হত্যার যে কাস্টম ছিল, গোত্রের মধ্যে যে প্রতিশোধের কষ্টম ছিল, গোত্রের মধ্যে এমনি হতো যে যদি এক গোত্রের মানুষ হত্যা হয় তাহলে বদলে ওই গোত্রের মানুষকেও হত্যা করা হত। এই কস্টম আজ আমি শেষ করে দিলা । 

সুদের সমাপ্তি 

সুদ হচ্ছে দ্বিতীয় বিষয় যার প্রতি বিশেষ নিবদ্ধ ছিলেন:

নবী সাঃ বলেছিলেন 

“সচেতন থাকো! জাহেলি যুগের সমস্ত রকমের সুদকে প্রত্যাখ্যান করা হল। তোমরা শুধুমাত্র আসল ধনের অধিকারী। না তোমরা কাউরির উপর অত্যাচার করবে, না তোমাদের উপর অত্যাচার করা হবে। আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব রাঃ এর উপর যে সমস্ত লোকের সুদের ঋণ রয়েছে তা সব মাফ করে দেওয়া হল। তোমরা যে জাহেলী যুগে সুদের লেনদেন করতে আজ তা সমাপ্তের ঘোষণা করলাম। যার দায়িত্বে কিছু পরিমাণ বাকি আছে, তিনি আসল পরিমাণটিই পাবেন, সুদ পাবেন না।”

আল্লাহ তায়ালা কোরান শরীফে এটি হারাম বলে উল্লেখ করেছেন (বাকারা ২৫,আয়াত ২৭৮। আল্লাহ আমাদের সকল কে সুদ থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুক।  আমিন।  

মহিলা ও ইয়াতিম বাচ্চাদের অধিকার 

নবী  (সাঃ) বিদায় বক্তব্যে বলেছিলেন যে আজ তোমাদের কে দুটি শক্তিহীন এর সমন্ধে বিশেষ অসিয়াত করছি যে তারা নিজ হাতে নিজের অধিকার নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না, তোমরা তিনাদের কে যত্ন সহকারে দেখাশোনা করবে, নবী (সাঃ) এর বিশেষ দুটি অসিয়াত হচ্ছে প্রথমত ইয়াতিম, দ্বিতীয়ত মহিলা।  

 

অধীনস্ত ও গুলামদের অধিকার 

হুজুর (সাঃ) বিশেষ ভাবে দাসদের জন্য অসিয়াত করেছেন আর তাদের গুণমান জীবনে কোন পার্থক্য যেমন না হয় তা বিদায় বক্তব্যে পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করেছেন: 

"তোমরা আপন ক্রীতদাসদের সঙ্গে নম্র এবং ভদ্রতা বজায় রাখবে। তোমরা যা খাও তাদের তা খায়াও। তোমরা যা পোশাক পরিধান কর তাদেরকেও সেই পোশাকপরিধান করাও। যদি তাদের কাছে কোনো ত্রুটি হয়ে যায়, তাহলে তুমি যদি মাফ করতে ইচ্ছুক না থাকো তাহলে সেই আল্ল্হর বান্দা কে শাস্তি না দিয়ে বিক্রি করে দাও। 

নবী সাঃ আপন বিদায় হজ্বের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিক্ষা প্রদান গেছেন। এবং আখিরাতের ত্বরে অগ্রসর হয়েছেন। আল্লাহ যেন সেই সমস্ত বার্তা গুলির প্রতি আমল করার তৌফিক দান করুক।  আমিন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter