আজও মুসলিম উম্মাহর জন্য ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর আদর্শ ও আত্মত্যাগের তাৎপর্য অনুধাবনের প্রয়োজন রয়েছে
কারবালার ঘটনা ইসলামের ইতিহাসের এক আবেগময় অধ্যায়, এবং এটি এমন এক বাস্তবতা যা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মানবসমাজে মূলত দুটি শক্তি মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে—একটি হল ‘হক’ বা সত্য, অপরটি ‘বাতিল’ বা মিথ্যা, এবং যুগে যুগে এ দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘটিত হয়ে এসেছে। এই ধারাবাহিকতারই একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হল নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রিয় নাতি, হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর শাহাদাত যা ইসলামের ইতিহাসে আজও মানুষের হৃদয়ে জীবন্ত হয়ে রয়েছে। যদি আমরা গভীরভাবে চিন্তা করি তবে দেখতে পাব, এমন কোন আকস্মিক ঘটনা নয় বরং বহু গম্ভীর ও তাত্ত্বিক কারণের ফলস্বরূপ ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁর মূল্যবান প্রাণ উৎসর্গ করেন। অথচ তিনি বাতিলের সামনে আত্মসমর্পণ করেননি। প্রতি বছর মুসলিম সমাজ মুহাররম মাসে হজরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাতের স্মরণে শোক প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অধিকাংশ মানুষ এই প্রশ্নের গভীরে প্রবেশ করে না যে, আসলে এমন কী ছিল যা ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে শুধু নিজের জীবন নয় বরং তাঁর পরিবারের শিশুদের জীবন বিসর্জন দিতেও অনুপ্রাণিত করেছিল।
এই প্রেক্ষাপটে আমরা যদি আন্তরিকতা ও চিন্তার গভীরতা নিয়ে বিচার করি, তাহলে স্পষ্ট হবে যে, ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর আত্মত্যাগের পেছনে এক মহান ও আলোকোজ্জ্বল লক্ষ্য ছিল। সেই লক্ষ্য এতই মহান ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তা তাঁর কাছে নিজের জীবন থেকেও অধিক প্রিয় হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্য ছিল ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শাসনপ্রক্রিয়াকে আল্লাহ তাআলার সার্বভৌমত্ব, তাঁর বিধান ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত রাখার প্রচেষ্টা। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা এমন কারো হাতে থাকা উচিত, যিনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হবেন, কোনো জবরদস্তিমূলক শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী নন। এইরকম একটি পরিস্থিতি চৌদ্দশত বছর পূর্বে হজরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর সম্মুখেও উদ্ভূত হয়েছিল। খোলাফায়ে রাশেদীনের পবিত্র ও আলোকোজ্জ্বল যুগের পরই ইসলামী বিশ্ব ধীরে ধীরে খিলাফত থেকে মুলূকিয়তের (রাজতন্ত্র) দিকে সরে যাচ্ছিল। অর্থাৎ, খিলাফতের বৈশিষ্ট্যসমূহ ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করল এবং রাজতান্ত্রিক ত্রুটিবিচ্যুতি সমাজে স্থান করে নিতে থাকল। সারসংক্ষেপে বলা যায়, ইসলামী শাসনব্যবস্থা এক ধরণের বিচ্যুতির শিকার হতে শুরু করেছিল।
যেমন— খলিফা নির্বাচনের ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে তা উত্তরাধিকারভিত্তিক করে ফেলা, খলিফাদের জীবনধারায় বিলাসিতা ও রাজকীয়তার অনুপ্রবেশ, বায়তুল মাল (রাষ্ট্রীয় কোষাগার)-এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিলুপ্তি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অবসান, শুরা বা পরামর্শমূলক শাসনব্যবস্থার অবসান এবং জাতিগত ও গোত্রীয় কুসংস্কারের পুনরুত্থান। এসব বিষয়ই ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর প্রতিবাদের মূল প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায় এবং এ কারণেই তিনি কারবালার প্রান্তরে চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধকে রক্ষা করার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার বিচ্যুতি, কারবালার শিক্ষা ও বর্তমান সময়
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়, যখন ইয়াযীদ জবরদস্তির মাধ্যমে ইসলামী সমাজের উপর শাসক হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হলো, তখন রাষ্ট্র তার ইসলামি স্বরূপ—যা ন্যায়বিচার ও পরামর্শমূলক শাসনের মাধ্যমে পরিচালিত হতো—তা থেকে সরে এসে রাজতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক রূপ নিতে শুরু করল। যে সমাজে পূর্বে আল্লাহর বিধান এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ মোতাবেক জনগণের মতামতকে মর্যাদা দেওয়া হতো, সেখানে এখন শাসকের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দই আইন হয়ে দাঁড়াল।
যেখানে পূর্বে খলিফাগণ জনগণের সমালোচনার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত থাকতেন এবং জনগণ নির্ভয়ে তাদের ভুল-ত্রুটি তুলে ধরতে পারত, সেখানে এখন এমন অবস্থা তৈরি হলো যে, শাসকের গুরুতর ভুল-ত্রুটি নিয়েও কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছিল না। রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা ‘বায়তুল মাল’—যা এক সময় আমানত হিসেবে গণ্য হতো—তা রাজাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হতে লাগল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হলো, মানুষের মুখে তালা লাগানো হলো। যে রাষ্ট্রব্যবস্থা এক সময় ‘শূরা’ বা পরামর্শভিত্তিক ছিল, এখন তা একনায়কের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। প্রশাসনিক পদসমূহ যেখানে পূর্বে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বিতরণ হতো, সেখানে এখন বংশ, গোষ্ঠী ও পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে বণ্টিত হতে শুরু করল।
এই সকল বিচ্যুতি হজরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর নিকট পরিপূর্ণভাবে অন্যায় ও বাতিল বলে প্রতীয়মান হয়েছিল। তাই তিনি ইয়াযীদের শাসনকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন এবং তাকে ‘হক’ বা সত্যের প্রতিনিধি হিসেবে মানতে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। ইয়াযীদ তার রাজ্যক্ষমতা বৈধ প্রতিপন্ন করার জন্য নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাতিকে, অর্থাৎ হজরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। এজন্য হজরত হুসাইন (রাঃ)-কে তার হাতে বাইয়াত দিতে বাধ্য করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাতে সম্মত হননি এবং শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে, ইসলামী শরিয়তের রক্ষার্থে ও বাতিল শক্তির সামনে আত্মসমর্পণ না করে সত্যের পতাকা উঁচু রেখেছিলেন।
কারবালা শুধু ইতিহাস নয়, আজকের জন্যও এক বাস্তব পাঠ
কারবালার ঘটনা কি শুধু অতীতের একটি বেদনাদায়ক অধ্যায়? না, এটি এক অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ শিক্ষার ভান্ডার, যা প্রতিটি যুগের মুসলমানের জন্য জীবন্ত দিশারী। হজরত হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাত আমাদের শেখায়—সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়া মুসলিম জীবনের অপরিহার্য অংশ। ইতিহাসে সব সময় দুই শক্তির সংঘর্ষ দেখা গেছে—হক ও বাতিল, আল্লাহভীরু ও জালিম, আদর্শ ও স্বার্থপরতা। কারবালার ময়দান সেই চিরন্তন সংঘর্ষের একটি প্রতীক। আজকের সমাজেও সেই ফিরআউনী, ইয়াযীদী ও তাগূতি শক্তিগুলো ভিন্ন রূপে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, যারা মুসলিম উম্মাহর পরিচয়, বিশ্বাস ও আদর্শকে ধ্বংস করতে চায়।
এই প্রেক্ষাপটে, মুসলমানদের উচিত—‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ’-এর নীতি অনুযায়ী নিজেদের জীবন গঠন করা। তবে এর জন্য দরকার ভেতরের ‘নফস’-এর উপর বিজয়। যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেও সমাজের অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। কারবালা কেবল ইতিহাস নয়—এটি সত্য, ত্যাগ, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ঈমানদারির চিরন্তন পাঠ, যা আজও আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
খিলাফত থেকে মুলূকিয়তের যাত্রা ও তার পরিণতি
এই বাস্তবতাই আমাদের সামনে স্পষ্ট করে যে, ইসলাম যখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আবির্ভাবের পর থেকে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ পর্যন্ত একটি আদর্শিক, গতিশীল ও ক্রমোন্নত ধারায় এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন মুলূকিয়তের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে সেই অগ্রযাত্রা ধীরগতি হয়ে পড়ে। মুসলমানদের মাঝে ক্রমশ এই উপলব্ধি ও আত্মবোধ বিলুপ্ত হতে থাকে যে, তারা এক ‘خَيْرُ أُمَّةٍ’ বা শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে দুনিয়ার সামনে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য মনোনীত হয়েছেন। তাদের এই ভুলে যাওয়া এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে, তারা ইসলামের প্রাধান্য ও বিজয়ের জন্য যে সংগ্রাম করা তাদের ওপর ফরয, সেটি ভুলে যেতে শুরু করে। ‘اقامت دین’ তথা ইসলামী জীবনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজকে প্রস্তুত করাও যে একটি ইবাদত—সে বোধ হারিয়ে যায়। এখানে একটি মৌলিক বাস্তবতা বোঝা জরুরি—যখন নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা (শাসকগণ) তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, বিশেষ করে যখন তারা ‘أمر بالمعروف و نهى عن المنكر’ অর্থাৎ সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্ব থেকে বিমুখ হন, তখন তার প্রতিক্রিয়া গোটা সমাজের উপর পড়ে। যদি রাষ্ট্রের কর্ণধাররাই আদর্শ বিচ্যুত হন, তাহলে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ও নৈতিক অবস্থার কি পরিণতি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
মুসলিম সমাজের অধঃপতন : হঠাৎ নয়, ধারাবাহিক বিচ্যুতির ফল
আজ মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত জীবনে যে অপচয়ের ও অধঃপতনের ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা কোনো হঠাৎ দুর্ঘটনা নয়; বরং এটি সেই ধারাবাহিক বিচ্যুতির ফল, যা শুরু হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের ন্যায়ভিত্তিক শাসনপদ্ধতি থেকে সরে গিয়ে মানবিক রাজতন্ত্রের সূচনার মধ্য দিয়ে। এর ফলে ধীরে ধীরে ইসলামি সমাজের ঐক্য ভেঙে পড়ল এবং একক খিলাফতের অবসান মুসলিম বিশ্বে চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলল। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল এই যে, মানুষ ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন হিসেবে দেখতে ভুলে গেল এবং ব্যক্তি-পর্যায়ের কিছু ধর্মীয় আচরণেই ‘দীন’ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল।
যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শ পেশ করেছিলেন এবং পরে খোলাফায়ে রাশেদীনও তদনুযায়ী দীনকে রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় রূপ দিয়েছিলেন, তখন দীন ছিল সমাজের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু মানবিক রাজতন্ত্র শুরু হতেই এই গঠন ভেঙে পড়ে। ফলস্বরূপ, মানুষের ভেতর দীন প্রতিষ্ঠার প্রেরণা ও সংগ্রামী চেতনা ক্রমশ লুপ্ত হয়ে যায়। শেষে এমন এক সময় আসে যখন ইসলামকে কেবল ব্যক্তিগত ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, এবং তা-ই সমাজে প্রচলিত হয়ে পড়ে।
হজরত হুসাইন (রাঃ)-এর এই অবস্থান কুরআনের শিক্ষার সাথেও সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। সূরা আলে ইমরানে বলা হয়েছে:
"كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ ٱلْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ "
"তোমরা সেই শ্রেষ্ঠ জাতি, যাদেরকে মানবজাতির কল্যাণের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করো, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখো।"
(সূরা আলে ইমরান: ১১০)
সূরা তাওবায় বলা হয়েছে, মুমিনদের বৈশিষ্ট্য এই যে তারা:
"ٱلتَّـٰٓئِبُونَ ٱلْعَـٰبِدُونَ ٱلْحَـٰمِدُونَ ٱلسَّـٰٓئِحُونَ ٱلرَّٰكِعُونَ ٱلسَّـٰجِدُونَ ٱلْـَٔامِرُونَ بِٱلْمَعْرُوفِ وَٱلنَّاهُونَ عَنِ ٱلْمُنكَرِ وَٱلْحَـٰفِظُونَ لِحُدُودِ ٱللَّهِ"
“তারা তাওবা করে, ইবাদত করে, আল্লাহর প্রশংসা করে, রোযা রাখে, রুকু করে, সিজদা করে, সৎকাজের নির্দেশ দেয়, অসৎকাজে বাধা দেয় এবং আল্লাহর সীমারেখা সংরক্ষণ করে। আপনি ঈমানদারদেরকে সুসংবাদ দিন।”— (সূরা তাওবা: ১১২)
রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন:
"مَنۡ رَأَى مِنكُمۡ مُنۡكَرٗا فَلۡيُغَيِّرۡهُ بِيَدِهِۦۖ فَإِن لَّمۡ يَسۡتَطِعۡ فَبِلِسَانِهِۦۖ فَإِن لَّمۡ يَسۡتَطِعۡ فَبِقَلۡبِهِۦۚ وَذَٰلِكَ أَضۡعَفُ ٱلۡإِيمَانِ"
"তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় দেখে, সে যেন তা হাত দিয়ে পরিবর্তন করে, যদি না পারে, তবে জিহ্বা দিয়ে নিষেধ করুক, আর সেটাও যদি না পারে, তাহলে অন্তরে তা ঘৃণা করুক—এটাই ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।" (সহীহ মুসলিম, হাদীস নম্বর: ৪৯)
কারবালার শিক্ষা ও আজকের মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি প্রসিদ্ধ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
"أفضل الجهاد كلمة عدل عند سلطان جائر"
"সর্বোত্তম জিহাদ হলো একজন জালিম শাসকের সামনে ন্যায়ের কথা বলা।"
— (আবু দাউদ: ৪৩৪৪, তিরমিযী: ২১৭৪)
অন্য এক হাদীসে তিনি সতর্ক করে বলেন:
"يَكُونُ بَعْدِي أُمراءُ، فمَن دَخَلَ علَيْهِمْ فَصَدَّقَهُمْ بكَذِبِهِمْ، وأعانَهُمْ علَى ظُلْمِهِمْ، فليسَ مِنِّي ولَسْتُ منهُ، ولَيْسَ يَرِدُ علَيَّ الحَوْضَ"
“আমার পরে কিছু শাসক আসবে, যারা মিথ্যা বলবে। যে ব্যক্তি তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে নেবে এবং তাদের জুলুমে সাহায্য করবে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং আমি তার দলভুক্ত নই। সে কিয়ামতের দিন আমার হাউজে (কাউসার)ও পৌঁছাবে না।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৩৪২)
আরেকটি কঠোর হুঁশিয়ারিমূলক হাদীসে এসেছে:
"مَن أَرْضَى سُلْطَانًا بِمَا يَسْخَطُ اللَّهُ، فَقَدْ خَرَجَ مِن دِينِ اللَّهِ"
“যে ব্যক্তি কোনো শাসককে সন্তুষ্ট করার জন্য এমন কিছু কথা বলে, যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীন থেকে বের হয়ে যায়।” — (মুসনাদ আহমদ: হাদীস ১৩৭৩৪, সহীহ হাদীস)
উপর্যুক্ত কুরআনি আয়াত ও হাদীসসমূহ পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে—সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা মুমিনদের পরিচয়, এবং কোনো শাসকের সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহর অসন্তোষ টেনে আনা একজন ব্যক্তিকে দ্বীন থেকে বিচ্যুত করে দিতে পারে। এই ভিত্তিতে হজরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) যখন সময়ের জালিম শাসক ইয়াযীদের সাথে কোনো আপোষ করেননি এবং তার কর্তৃত্বকে বৈধতা দেননি, তখন তা কোনো পার্থিব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে দ্বীনি ভিত্তিতে ছিল। কারণ, ইসলাম ধর্ম ও রাজনীতি—এই দুই পৃথক নয়; বরং ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালাও অন্তর্ভুক্ত।
ইসলামি রাজনীতির চেতনা ও হুসাইনি আদর্শ
শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইকবাল ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখেন:
ماسوی اللہ راہ مسلمان بندہ نیست
پیش فرعونے سرش افگندہ نیست
অর্থাৎ, একজন মুসলমান আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাস হতে পারে না, এবং সে কোনো ফিরআউনের সামনে মাথা নত করে না।
এমন শিক্ষাই হজরত হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাত থেকে আমরা গ্রহণ করি—যে একজন মুমিন কেবল আল্লাহরই সামনে নত হয়; কোনো জালিম, তাগূত বা ফিরআউনের সম্মুখে নয়। তিনি তাঁর জীবন ও কর্মের মাধ্যমে এমন সমস্ত ‘আনুগত্য’ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যা আল্লাহর আনুগত্য থেকে বিচ্যুতি ঘটায় বা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সুন্নাহর বিপরীত পথে পরিচালিত করে। ইমাম হুসাইন (রাঃ) বিশ্বাস করতেন—শাসন ও আইন প্রণয়নের একমাত্র অধিকার আল্লাহর। কেউ যদি আল্লাহর বিধান বদলাতে চায়, সে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করছে। তাই হুসাইন (রাঃ) বাতিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সত্য প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করেন। এই ঘটনা আমাদের শেখায়—ঈমান, ত্যাগ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভেতরের নফস ও বাইরের যুলুমের মোকাবিলা করতে হবে। ইসলামী শরিয়ত রক্ষায় প্রয়োজনে প্রাণও উৎসর্গ করা ঈমানের দাবি।
উপসংহার
কারবালার ঘটনা শুধু ইতিহাসের একটি আবেগময় অধ্যায় নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বাস্তব ও চিরন্তন আদর্শ। হজরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) শুধু নিজের জীবন নয়, তাঁর পরিবার-পরিজনের জীবনও কুরবান করে দেখিয়ে দিয়েছেন—সত্যের পক্ষে দৃঢ় থাকা এবং বাতিলের সামনে কখনোই মাথানত না করাই একজন মু’মিনের প্রকৃত চেতনা। তাঁর শাহাদাত প্রমাণ করে যে, ইসলাম শুধুমাত্র নামাজ, রোজা ও ব্যক্তিগত আচার-আচরণের ধর্ম নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার মধ্যে ন্যায়ভিত্তিক শাসন, পরামর্শমূলক নেতৃত্ব ও জনগণের অধিকার সংরক্ষণ অন্তর্ভুক্ত। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর অবস্থান ছিল রাজনৈতিক নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় ও নৈতিক। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, আল্লাহই একমাত্র হাকিম, আর তাঁর বিধান ও রাসূলের সুন্নাহর বাইরে কোনো শাসনব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়। আজকের মুসলিম সমাজের জন্য এই শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি—বিশেষত যখন অন্যায়, স্বৈরাচার ও ইসলামী মূল্যবোধের অবক্ষয় চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মুসলিম উম্মাহকে ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর আত্মত্যাগ থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ’-এর দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। কারণ, হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব যুগে যুগে চলমান, এবং এই লড়াইয়ে সত্যের পক্ষেই থাকা ইমানদারের পরিচয়।