মহাবিশ্বের মর্মবাণী ও মাতৃগর্ভের মহাকাব্য: কুরআনিক ভ্রূণতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক অভিসন্দর্ভ

অসীমের সন্ধানে সসীমের যাত্রা

মহাকাশের অনন্ত নক্ষত্রবীথির পানে চাহিয়া মানুষ যুগে যুগে বিস্ময়ে হতবাক হইয়াছে; কিন্তু সেই বিস্ময়ের চেয়েও গভীরতর এক রহস্য লুকাইয়া আছে মানুষের নিজেরই সত্তার গহীনে—মাতৃগর্ভের নিভৃত অন্ধকারের যবনিকার অন্তরালে। রবীন্দ্রনাথ যেমন গাহিয়াছিলেন, "সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর", ঠিক তেমনই এক অসীম কারিগর অতি ক্ষুদ্র এক বিন্দুর মাঝে প্রাণের যে মহাকাব্য রচনা করেন, তাহা কেবল জীববিজ্ঞানের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দ্বারা নিঃশেষ করা যায় না। আজ হইতে চতুর্দশ শতাব্দী পূর্বে, যখন আরব মরুময় প্রান্তর ছিল বিজ্ঞানের আলোকবঞ্চিত, তখন পবিত্র কুরআনে মানব সৃষ্টির যে পুঙ্খানুপুঙ্খ ও নিখুঁত বিবরণী অবতীর্ণ হইয়াছিল, তাহা আজ বিংশ শতাব্দীর আধুনিক ভ্রূণতত্ত্বের (Embryology) কষ্টিপাথরে যাচাই হইয়া এক অলৌকিক সত্যের সাক্ষ্য বহন করিতেছে। এই সত্য কেবল তথ্যের সমাহার নহে, বরং এক পরম সত্তার অস্তিত্বের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ, যিনি মহাকালের পাতায় প্রাণের ইতিহাস লিখিয়াছেন পরম মমতায় ।

বক্ষমান নিবন্ধে আমরা সূরা আল-মু'মিনুনের ১২ হইতে ১৪ নম্বর আয়াতের আলোকে মানব ভ্রূণবিকাশের পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো বিশ্লেষণ করিব। আমাদের আলোচনার ভিত্তি হইবে আধুনিক ভ্রূণতত্ত্ব, ভাষাতাত্ত্বিক ব্যুৎপত্তি এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের চুলচেরা বিশ্লেষণ—যাহা প্রমাণ করিবে যে এই ঐশী গ্রন্থ কোনো মানব মস্তিষ্কের কল্পনাপ্রসূত কাব্য নহে, বরং জগৎসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হইতে অবতীর্ণ এক শাশ্বত জ্ঞানভাণ্ডার।

মৃত্তিকার সারাংশ: সৃষ্টির আদি উপাদান (সুলালাহ মিন তিন)

সৃষ্টির আদি কথা বলিতে গিয়া কোরআন পাকে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা ঘোষণা করিয়াছেন, "আমি মানুষকে মাটির সারাংশ (সুলালাহ) হইতে সৃষ্টি করিয়াছি" । এখানে 'সুলালাহ' শব্দটির অর্থ কোনো কিছুর নির্যাস বা সর্বোৎকৃষ্ট অংশ। আর 'তিন' অর্থ কাদা বা ভেজা মাটি। স্থূল দৃষ্টিতে কেহ প্রশ্ন তুলিতে পারেন, মানুষের দেহ তো মৃৎপিণ্ড নহে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন মাটির টানে বারংবার ফিরিয়া আসিয়াছেন তাঁর কাব্যে, কুরআনও মানুষকে স্মরণ করাইয়া দেয় তার মূল।

আধুনিক জৈব রসায়ন (Biochemistry) আমাদের চক্ষুর সম্মুখে এই সত্য উন্মোচন করিয়াছে যে, মানবদেহের গঠনের জন্য অপরিহার্য মৌলিক উপাদানসমূহ—যথা অক্সিজেন, কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, ক্লোরিন, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং সিলিকন—তাহার প্রতিটিই মৃত্তিকার বুকে বিদ্যমান । সুতরাং, 'সুলালাহ মিন তিন' বা মাটির নির্যাস বলিতে কুরআনের ইঙ্গিত অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট—ইহা সেই সকল রাসায়নিক উপাদানের সমাহার, যাহা মাটি হইতে আহরিত হইয়া খাদ্যের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে এবং শুক্রাণু ও ডিম্বাণু গঠনের মূলভিত্তি রচনা করে। মুফতি শফি উসমানি যথার্থই বলিয়াছেন, এই আয়াত মানুষ সৃষ্টির মৌলিক রাসায়নিক ভিত্তিকেই নির্দেশ করে ।

নুতফাহ: মিশ্রিত বিন্দুর অলৌকিক আধার

অতঃপর স্রষ্টা মানুষকে 'নুতফাহ' রূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করিয়াছেন। আরবি 'নুতফাহ' শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অতি সামান্য পরিমাণ তরল বা গড়াইয়া পড়া ফোঁটা। কুরআনের অন্যত্র (সূরা ইনসান, ২ নং আয়াত) একে 'নুতফাতিন আমশাজ' বা মিশ্রিত তরল বলা হইয়াছে ।

এই একটি শব্দের মাঝে লুকাইয়া আছে তৎকালীন মানবীয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার বিপরীতে ওহীর জ্ঞানের বিজয়। সেই যুগে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতবাদ ছিল যে, ভ্রূণ গঠনে কেবল পুরুষের বীর্যই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং নারীর রজঃস্রাব কেবল উপাদান যোগায়; নারীর কোনো জিনগত অবদান নাই। কিন্তু কুরআন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সেই ভুল ধারণা প্রত্যাখ্যান করিয়া ঘোষণা করিল—ভ্রূণ সৃষ্টি হয় নারী ও পুরুষ উভয়ের তরলের সংমিশ্রণে ।

আধুনিক ভ্রূণতত্ত্ববিদ জন অ্যালেন এবং বেভারলি ক্রেমার নিশ্চিত করিয়াছেন যে, মানব ভ্রূণ বা জাইগোট (Zygote) গঠিত হয় পুরুষের শুক্রাণু এবং নারীর ডিম্বাণুর (Oocyte) মিলনের ফলে। এই জাইগোটই হলো সেই 'নুতফাহ', যাহা বাবা ও মা উভয়ের জিনগত উপাদানের এক মিশ্রিত সত্তা । মাইক্রোস্কোপবিহীন যুগে অ্যারিস্টটলের মতো মহাজ্ঞানী যেখানে ভুল করিয়াছিলেন, সেখানে মরুভূমির নিরক্ষর নবী (সা.)-এর কণ্ঠে এই নির্ভুল বৈজ্ঞানিক সত্যের উচ্চারণ—ইহা কি প্রমাণ করে না যে এর উৎস কোনো পার্থিব জ্ঞানালয় নহে?

সারণী ১: ভ্রূণ সৃষ্টিতে অ্যারিস্টটল বনাম কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান

বিষয়

অ্যারিস্টটলের মতবাদ (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী)

কুরআনের বক্তব্য (সপ্তম শতাব্দী)

আধুনিক ভ্রূণতত্ত্ব (বিংশ শতাব্দী)

নারীর অবদান

নিষ্ক্রিয়, কেবল রজঃস্রাব (Menstrual blood) প্রদান করে

সক্রিয়, পুরুষের তরলের সাথে মিশ্রিত হয় (নুতফাহ আমশাজ)

নারীর ডিম্বাণু (Gamete) পুরুষের শুক্রাণুর সাথে মিলিত হয়ে জাইগোট গঠন করে

ভ্রূণের গঠন

রজঃস্রাব জমাট বেঁধে ভ্রূণ হয়

মিশ্রিত তরল (Drop of mingled fluid) থেকে সৃষ্টি

জাইগোট গঠনের মাধ্যমে ভ্রূণ সৃষ্টি হয়

কারারিন মাকিন: জরায়ুর নিরাপদ দুর্গ

জাইগোট বা নুতফাহ সৃষ্টির পর তাহার প্রয়োজন এক সুদৃঢ় আশ্রয়ের। কুরআন ইহাকে অভিহিত করিয়াছে 'কারারিন মাকিন' বা সুদৃঢ় ও নিরাপদ আবাস রূপে। 'কারার' অর্থ স্থির হওয়া বা গেঁথে যাওয়া, আর 'মাকিন' অর্থ মজবুত ।

বিজ্ঞানের ভাষায় এই পর্যায়টিকে বলা হয় ইমপ্লান্টেশন (Implantation)। নিষিক্তকরণের প্রায় ৬ দিন পর ব্লাস্টোসিস্ট (Blastocyst) জরায়ুর গাত্রে বা এন্ডোমেট্রিয়ামে (Endometrium) নিজেকে প্রোথিত করিতে শুরু করে। এটি কেবল উপরিভাগে লাগিয়া থাকে না, বরং জরায়ুর দেয়ালের গভীরে শিকড় গাড়িয়া বসে এবং ওপর হইতে ফাইব্রিন ক্লট বা রক্ততঞ্চন দ্বারা আবৃত হইয়া যায়, যেন এটি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকে । জরায়ুর এই অবস্থানটি ভ্রূণের জন্য বাহ্যিক আঘাত হইতে রক্ষা পাইবার এবং পুষ্টি গ্রহণের সবচেয়ে নিরাপদ দুর্গ। 'কারারিন মাকিন' শব্দদ্বয় এই জৈবিক প্রক্রিয়াটির এক নিখুঁত চিত্রায়ন, যাহা ভ্রূণের সুরক্ষার নিশ্চয়তাকে মূর্ত করিয়া তোলে।

আলাকাহ: এক বহুমাত্রিক বিস্ময়

ভ্রূণ বিকাশের পরবর্তী ধাপকে কুরআন 'আলাকাহ' নামে অভিহিত করিয়াছে। এই একটি শব্দের মাঝে যে তিনটি অর্থ নিহিত আছে, তাহা আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে এক বিস্ময়কর সত্য উন্মোচন করে: ১. জোঁক (Leech)। ২. ঝুলে থাকা বস্তু (Suspended thing)। ৩. জমাট রক্ত (Blood clot) ।

রবীন্দ্রনাথ যেমন উপমার জাদুতে অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করিতেন, কুরআনও এখানে এমন এক উপমা ব্যবহার করিয়াছে যাহা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচেও সত্য বলিয়া প্রমাণিত।

১. জোঁকের সাদৃশ্য: ২৪-২৫ দিন বয়সের মানব ভ্রূণকে যদি আমরা আধুনিক ইমেজিং প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করি, তবে দেখিব ইহার আকৃতি অবিকল একটি জোঁকের ন্যায়। কেবল আকৃতিতেই নহে, স্বভাবধর্মেও মিল বিদ্যমান। জোঁক যেমন অন্যের দেহ হইতে রক্ত চুষিয়া বাঁচে, এই পর্যায়ে ভ্রূণও মায়ের জরায়ুর দেয়াল হইতে কোরিওনিক ভিলি (Chorionic villi) এর মাধ্যমে রক্ত ও পুষ্টি শোষণ করে ।

২. ঝুলন্ত অবস্থা: এই পর্যায়ে ভ্রূণটি 'কানেক্টিং স্টলক' (Connecting stalk) বা নাড়ির মাধ্যমে জরায়ুর গহ্বরে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। অভিকর্ষের বিপরীতে এই ঝুলে থাকা অবস্থাটি 'আলাকাহ' শব্দের দ্বিতীয় অর্থের সাথে হুবহু মিলিয়া যায় ।

৩. জমাট রক্ত: যদিও ভ্রূণ রক্ত নহে, কিন্তু এই প্রাথমিক পর্যায়ে ভ্রূণের দেহে প্রচুর পরিমাণে রক্ত সঞ্চালিত হয় এবং হৃৎস্পন্দন শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ইহা স্থির রক্তের একটি পিণ্ডের ন্যায় দেখায়। প্রাচীন আরবরা হয়তো ইহাকে কেবল জমাট রক্ত ভাবিয়াছিল, কিন্তু শব্দের এই বহুমাত্রিকতা আজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক উন্মোচন করিতেছে।

সমালোচকরা প্রায়শই অভিযোগ করেন যে, এই বর্ণনা গ্রিক চিকিৎসক গ্যালেনের লেখা হইতে নকল করা। কিন্তু গ্যালেন বলিয়াছিলেন ভ্রূণ তৈরি হয় রক্ত ও বীর্যের মিশ্রণে এবং তিনি এই পর্যায়কে 'মাংসের রূপ' বলিয়াছিলেন, 'জোক' বা 'ঝুলন্ত বস্তু' বলেন নাই। কুরআনের 'আলাকাহ' শব্দটি গ্যালেনের বর্ণনার চেয়ে অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট এবং বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক ।

মুদগাহ: চর্বিত মাংসপিণ্ডের উপমা

'আলাকাহ' পর্যায়ের পর ভ্রূণ পরিণত হয় 'মুদগাহ'-তে। আরবিতে 'মুদগাহ' অর্থ হলো এমন এক টুকরো মাংস যাহা চিবানো হইয়াছে বা যাহাতে দাঁতের দাগ বসিয়া গিয়াছে ।

চতুর্থ সপ্তাহের দিকে ভ্রূণের পিঠের দিকে 'সোমাইট' (Somites) বা খণ্ড খণ্ড অংশ তৈরি হয়। আধুনিক ভ্রূণতত্ত্ববিদ ব্যারি মিচেল এবং রাম শর্মা ব্যাখ্যা করেন যে, এই সোমাইটগুলোর বিন্যাস এবং ভ্রূণের বাঁকানো আকৃতি দেখিলে মনে হয় যেন এক টুকরো মাংসের ওপর দাঁতের পাটির ছাপ পড়িয়াছে । কেইথ মুর (Keith Moore)-এর মতো বিশ্বখ্যাত ভ্রূণতত্ত্ববিদ প্লাস্টিসিন দিয়া ভ্রূণের মডেল বানাইয়া তাহাতে দাঁত দিয়া কামড় দিয়া দেখাইয়াছেন যে, চিবানো মাংসের দাগ অবিকল সোমাইটের মতো দেখায়।

কুরআনের অন্যত্র এই পর্যায়কে 'মুখাল্লাকাহ ওয়া গায়রি মুখাল্লাকাহ' (গঠিত এবং অগঠিত) বলা হইয়াছে। এটি অর্গানোজেনেসিস (Organogenesis) বা অঙ্গ সৃষ্টির সেই সন্ধিক্ষণকে নির্দেশ করে, যখন কিছু অঙ্গ তৈরি হইতেছে কিন্তু তখনও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় নাই । ১৪০০ বছর পূর্বে কোনো মানুষের পক্ষে খালি চোখে এই সোমাইট বা অঙ্গ গঠনের এই সূক্ষ্ম পর্যায় দেখা কি আদৌ সম্ভব ছিল?

ইজাম ও লাহম: অস্থি ও মাংসের ক্রমবিকাশ

অতঃপর কুরআন বলে, "আমি সেই মাংসপিণ্ড (মুদগাহ) হইতে অস্থি (ইজাম) তৈরি করিয়াছি, এবং অস্থিকে মাংস (লাহম) দ্বারা আবৃত করিয়াছি"

এখানে ক্রমটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: প্রথমে হাড় (কাঠামো), তারপর মাংস (আবরণ)। আধুনিক ভ্রূণতত্ত্ববিদরা নিশ্চিত করিয়াছেন যে, ভ্রূণের মেসেনকাইমাল কোষগুলো প্রথমে ঘনীভূত হইয়া তরুণাস্থি বা হাড়ের মডেল (Cartilaginous models) তৈরি করে। অষ্টম সপ্তাহের দিকে হাড়ের এই প্রাথমিক কাঠামো তৈরি হওয়ার পরপরই মায়োব্লাস্ট (Myoblast) কোষগুলো একত্রিত হইয়া পেশী বা মাংস গঠন করে এবং হাড়ের কাঠামোর চারপাশে আবৃত হয় ।

জন অ্যালেন এবং বেভারলি ক্রেমার তাঁহাদের গ্রন্থে স্পষ্ট করিয়াছেন যে, হাড়ের মডেল তৈরি হওয়ার পরেই পেশীসমূহ সংযুক্ত হইয়া হাড়কে আবৃত করে। অ্যারিস্টটল মনেিতেন হাড় ও মাংস একই সাথে তৈরি হয়, কিন্তু কুরআন দ্ব্যর্থহীনভাবে হাড় গঠনের অগ্রাধিকার ঘোষণা করিয়াছে, যাহা আধুনিক বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ । কেহ কেহ বলিতে পারেন, শিশু তো নরম হাড় লইয়া জন্মায়। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, 'ইজাম' বা হাড়ের সূচনা হয় তরুণাস্থি দিয়া, এবং কুরআনের এই বর্ণনা সেই কাঠামোগত ভিত্তি স্থাপনের দিকেই ইঙ্গিত করে।

খালকান আখারা: নব সৃষ্টির উন্মেষ

সবশেষে আল্লাহ বলেন, "অতঃপর আমি তাহাকে অন্যরূপে (খালকান আখারা) সৃষ্টি করিয়াছি।"

এই পর্যায়টি ভ্রূণীয় পর্যায় (Embryonic period) শেষ হওয়ার পর ফিটাল পর্যায় (Fetal period) বা ৮ম সপ্তাহের পরবর্তী সময়ের ইঙ্গিত। এই সময়ে শিশুটি আর কেবল কোষের সমষ্টি বা মাংসপিণ্ড থাকে না; তাহার হাত-পা, মুখমণ্ডল এবং মানুষের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটিয়া ওঠে। সে এক নতুন সত্তা হিসেবে বিকশিত হয় । এটি কেবল দৈহিক পরিবর্তন নহে, বরং এই পর্যায়ে রুহ বা আত্মা ফুঁকিয়া দেওয়ার আধ্যাত্মিক মুহূর্তও নিহিত থাকিতে পারে। মাতৃগর্ভের সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে একটি জড় পিণ্ড কীভাবে একটি হাসিখুশি, ক্রন্দনরত মানব শিশুতে রূপান্তরিত হয়—তাহা ভাবিলে স্রষ্টার প্রতি মস্তক অবনত না হইয়া পারে না।

ঐতিহাসিক সন্দেহবাদ ও সত্যের আলোকছটা

পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদ এবং সমালোচকরা দীর্ঘকাল ধরিয়া দাবি করিয়া আসিতেছেন যে, কুরআনের এই ভ্রূণতত্ত্ব গ্রিক উৎস, বিশেষত অ্যারিস্টটল বা গ্যালেনের লেখা হইতে গৃহীত। তাঁহারা আল-হারিস বিন কালাদা নামক এক আরব চিকিৎসকের কথা উল্লেখ করেন, যিনি নাকি পারস্যের জুন্দিশাপুর হইতে চিকিৎসাশাস্ত্র শিখিয়া আসিয়াছিলেন এবং নবীজি (সা.)-কে এই তথ্য দিয়াছিলেন। কিন্তু এই অভিযোগ যুক্তির ধোপে টেকে না এবং ঐতিহাসিক সত্যের অপলাপ মাত্র।

প্রথমত, অ্যারিস্টটল ও গ্যালেনের তত্ত্বে ভয়াবহ বৈজ্ঞানিক ভুল ছিল। অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন নারীর রজঃস্রাব ভ্রূণ তৈরির উপাদান। গ্যালেন মনেিতেন ভ্রূণের ডান ও বাম পার্শ্বে লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। কুরআন যদি নকল করিত, তবে এই ভুলগুলোও নকল করিত। কিন্তু কুরআনে এই ভুলগুলোর লেশমাত্র নাই; বরং কুরআন এমন সব সঠিক তথ্য দিয়াছে (যেমন নারীর ডিম্বাণুর ভূমিকা, হাড় ও মাংসের ক্রম) যাহা গ্রিকরা জানিত না । নবীজি (সা.) কীভাবে জানিলেন কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল?

দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক ডেভিড সি. লিন্ডবার্গ এবং রয় পোর্টারের মতো আধুনিক গবেষকরা প্রমাণ করিয়াছেন যে, নবীজির (সা.) সময়ে জুন্দিশাপুরে কোনো আনুষ্ঠানিক মেডিকেল স্কুল বা অনুবাদ কেন্দ্র ছিল না। আল-হারিস বিন কালাদার সাথে নবীজির (সা.) বৈজ্ঞানিক আলোচনার কোনো নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক দলিল নাই। এমনকি আল-হারিস বিন কালাদা নামটিই অনেক ক্ষেত্রে কিংবদন্তিতুল্য ।

তৃতীয়ত, নবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কায় 'আল-আমিন' বা বিশ্বাসী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি যদি অন্যের লেখা নকল করিয়া তাহাকে আল্লাহর বাণী বলিয়া প্রচার করিতেন, তবে তাহা তাঁর সারা জীবনের সততা ও ত্যাগের সাথে সাংঘর্ষিক হইত। সত্যের জন্য যিনি প্রস্তরের আঘাত সহ্য করিয়াছেন, তিনি মিথ্যার আশ্রয় লইবেন—ইহা যুক্তিবিরুদ্ধ।

লিঙ্গ নির্ধারণ ও হাদিসের বিজ্ঞান

কুরআন ও হাদিসের বৈজ্ঞানিক যথার্থতার আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো লিঙ্গ নির্ধারণ। সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হাদিসে বলা হইয়াছে, "৪২ রাত্র অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহ একজন ফেরেশতা পাঠান যিনি ভ্রূণকে আকৃতি দেন... এবং জিজ্ঞাসা করেন, হে রব! এ কি পুরুষ হবে না নারী?"

আধুনিক জিনেটিক্স আমাদের জানায়, গর্ভাবস্থার ৬ষ্ঠ সপ্তাহ পর্যন্ত (অর্থাৎ প্রায় ৪২ দিন) ভ্রূণের গোনাড (Gonad) অবিভেদিত (Undifferentiated) অবস্থায় থাকে। ঠিক এই সময়ের পরেই Y ক্রোমোজোমের SRY জিন সক্রিয় হইলে ভ্রূণটি পুরুষে এবং না হইলে নারীতে রূপান্তরিত হয় । ১৪০০ বছর আগের এই হাদিসটির সাথে আধুনিক ভ্রূণবিকাশের সময়সীমার (Timeline) এই নিখুঁত মিল কি কেবলই কাকতালীয়?

মেরুদণ্ড ও বক্ষপঞ্জরের রহস্য (সুলব ও তারাইব)

কুরআনের সূরা তারিক-এ বলা হইয়াছে, মানুষ সৃষ্টি হইয়াছে এমন এক তরল হইতে যাহা "মেরুদণ্ড (সুলব) ও বক্ষপঞ্জরের (তারাইব) মধ্য হইতে নির্গত হয়" । সমালোচকরা বলেন, শুক্রাশয় তো অণ্ডকোষে থাকে, মেরুদণ্ডে নহে।

কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, 'সুলব' অর্থ কটিদেশ বা কোমরের হাড় (Loins/Lumbar region) এবং 'তারাইব' অর্থ বক্ষপঞ্জর বা পেলভিক আর্চ (Pelvic arch)। ভ্রূণতাত্ত্বিকভাবে, শুক্রাশয় (Testes) এবং ডিম্বাশয় (Ovaries) প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনির কাছে, অর্থাৎ মেরুদণ্ড ও বক্ষপঞ্জরের মধ্যবর্তী স্থানেই গঠিত হয়। পরবর্তীতে জন্মের পূর্বে অণ্ডকোষ নিচে নামিয়া আসে। তাছাড়া, স্নায়বিক সংযোগ (Nerve supply) ও রক্ত সঞ্চালন (Blood supply) এর উৎস বিচার করিলে দেখা যায়, প্রজনন অঙ্গের মূল উৎস সেই মেরুদণ্ড সংলগ্ন ধমনী (Aorta) ও স্নায়ুতন্ত্র, যাহা 'সুলব' ও 'তারাইব' এলাকার মধ্যেই অবস্থিত । সুতরাং, এই আয়াতটি ভ্রূণীয় উৎপত্তিস্থলের দিকেই ইঙ্গিত করে, বর্তমান অবস্থানের দিকে নহে।

উপসংহার: অনন্তের চরণে সমর্পণ

রবীন্দ্রনাথ যেমন তাঁর 'গীতাঞ্জলি'-তে গাহিয়াছেন—"আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে", কুরআনের এই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের পর একজন চিন্তাশীল মানুষের মস্তক আপনাআপনিই সেই মহান স্রষ্টার সামনে নত হইয়া আসে।

সূরা মু'মিনুনের এই আয়াতগুলো কেবল ভ্রূণবিদ্যার শুষ্ক বিবরণ নহে, বরং এ এক মহাজাগতিক আহ্বান। যখন কোনো আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন ছিল না, ব্যবচ্ছেদ করার কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না, তখন মরুভূমির বুকে বসিয়া নিরক্ষর নবী (সা.) কীভাবে মানুষের জরায়ুর অন্ধকারের খবর এত নিখুঁতভাবে দিলেন? এর উত্তর একটাই—এই জ্ঞান সেই সত্তার কাছ থেকে আসিয়াছে যিনি মানুষকে 'আলাকাহ' হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়াছেন।

বিজ্ঞান যেখানে কার্যকারণ (Mechanism) খোঁজে, কুরআন সেখানে কার্যকারণের পেছনের মহাকারুকারকে (Creator) চিনাইয়া দেয়। মানুষের সৃষ্টি—মাটির নির্যাস থেকে শুরু করে একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষে রূপান্তর—আল্লাহর অসীম ক্ষমতা, জ্ঞান এবং করুণার এক জীবন্ত সাক্ষী। এই নিবন্ধের আলোকে আমরা নিঃসঙ্কোচে বলিতে পারি, পবিত্র কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান পরস্পরবিরোধী নহে, বরং একে অপরের পরিপূরক। বিজ্ঞানের প্রতিটি নতুন আবিষ্কার কুরআনের সত্যতাকে আরও উজ্জ্বল করিয়া তোলে।

তাই আসুন, আমরা কুরআনের এই আয়াতগুলোকে কেবল তেলাওয়াতের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখিয়া, এর মর্মার্থ অনুধাবন করি এবং সেই মহান রবের প্রশংসা করি যিনি ঘোষণা করিয়াছেন—"নিপুণতম স্রষ্টা আল্লাহ কতই না বরকতময়।"

সারণী ২: ভ্রূণ বিকাশের পর্যায়ক্রম - কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান

কুরআনিক পর্যায়

সময়কাল (আনুমানিক)

আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা (Modern Embryology)

মূল বৈশিষ্ট্য

নুতফাহ (Nutfah)

১ম সপ্তাহ

জাইগোট (Zygote) ও ব্লাস্টোসিস্ট গঠন

মিশ্রিত শুক্রাণু ও ডিম্বাণু, জরায়ুতে গমন

কারারিন মাকিন (Qararin Makin)

৬ষ্ঠ-১০ম দিন

ইমপ্লান্টেশন (Implantation)

জরায়ুর দেয়ালে ভ্রূণের নিরাপদ প্রোথিতকরণ ও আবৃত হওয়া

আলাকাহ (Alaqah)

২য়-৩য় সপ্তাহ

নিউরুলা ও রক্ত সংবহন শুরু

জোঁকের মতো আকৃতি, মায়ের রক্ত চোষা, ঝুলন্ত অবস্থা

মুদগাহ (Mudghah)

৪র্থ সপ্তাহ

সোমাইট গঠন (Somitogenesis)

চর্বিত মাংসের মতো খাঁজকাটা চেহারা, অঙ্গ সৃষ্টির সূচনা

ইজাম ও লাহম (Idhaam & Lahm)

৫ম-৮ম সপ্তাহ

কঙ্কালতন্ত্র ও পেশী গঠন

তরুণাস্থি গঠন এবং পরবর্তীতে পেশীর আবরণ দ্বারা আবৃতকরণ

খালকান আখারা (Khalqan Akhara)

৯ম সপ্তাহ থেকে জন্ম

ফিটাল পর্যায় (Fetal Period)

মানুষের আকৃতি ধারণ, বৃদ্ধি ও রুহ ফুঁকে দেওয়া

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter