বিশ্বের বিশাল ইতিহাস তামিম আনসারির বই ‘ডেসটিনি ডিসরাপটেড’-এ সংশ্লেষিত
প্রায় সমস্ত ঐতিহাসিক ধারাবাহিক ঘটনা যা বৈশ্বিক বিষয়ে স্পষ্ট প্রভাব ফেলে মূলত সবই বিশ্ব-কেন্দ্র থেকে উদ্ভূত যাকে বর্তমান পাশ্চাত্য বিশ্ব ব্যবস্থা ‘মধ্যপ্রাচ্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। এই স্বাতন্ত্র্যসূচক প্রক্ষেপণের সাথে, আফগানী লেখক তামিম আনসারির ‘ডেসটিনি ডিসট্রাপ্টেড’ শিরোনামে বিশ্ব ইতিহাসের নতুন চুক্তি পাঠকদেরকে ‘চিল-চোখ’ দিয়ে অতীতের পৃষ্ঠাগুলি এবং ভবিষ্যত ঘটনাগুলির ফলস্বরূপ বর্তমানের দিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে৷
পের্সিয়াস বুকস গ্রুপ দ্বারা ২০০৯ সালে প্রকাশিত বইটি সমস্ত ঐতিহাসিক প্রমাণপত্র সহ একটি অত্যন্ত গবেষণামূলক কাজ, যদিও লেখক এটিকে একটি স্বাচ্ছন্দ্য পাঠে পরিণত করেছেন। লেখক নিজে যেমন পাণ্ডিত্যপূর্ণভাবে ইসলামের ইতিহাসকে একটি আমেরিকার পাঠ্যপুস্তকে কেন্দ্রীয় স্থান দেওয়ার জন্য সংগ্রাম করেন, অনুরূপ এই মাস্টারপিসটি ‘বিশ্ব ইতিহাসে ইসলামকে আরও কভারেজ দেওয়ার জন্য’ এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এটি ইতিহাসের এক অসামান্য কাজ, এমন সময় যখন পশ্চিম থেকে শুধুমাত্র ‘আমাদের নিজস্ব সভ্যতা’-এর ডাক আরও জোরে বেড়ে চলেছে।
একটি সাধারণ সমালোচনা
বইটি ইতিহাস রচনার (historiography) এক সমালোচনা দিয়ে শুরু হয়, যা অন্যান্য গবেষণা শাখার মতোই ইউরোকেন্দ্রিক আখ্যান দ্বারা আঁকড়ে ধরেছে যদিও দূরবর্তী ভূগোলের ঐতিহাসিক পরিবেশ খুব কমই উপযুক্ত হয়ে ওঠে। যুক্তিযুক্তভাবে, ইতিহাস পরিমাপের পদ্ধতিটি আরও নমনীয়, অনুকূল এবং নির্দিষ্ট হওয়া চায়। অনেক ইতিহাসবিদ এই উদ্বেগ আগেও উত্থাপন করেছেন তবে তামিম আনসারী সেই উদ্দেশ্যে কার্যত এক উদাহরণের প্রমান দিয়েছেন।
তাই, ‘দ্য ওয়েস্ট অফ কাবুল, ইস্ট অফ নিউ ইয়র্কে’র লেখক অধ্যবসায়ের সাথে দুটি ইতিহাস রচনার দিকনির্দেশের মধ্যে একটি উপযুক্তভাবে অভিযোজিত সুড়ঙ্গের প্রবর্তন করেছেন, একটি নতুন ‘মধ্য বিশ্ব’ যেখানে আনসারী 'জন্ম' (birth) থেকে শুরু করে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত দশটি অনুরূপ পর্যায় ‘প্রতিক্রিয়া’য় দাঁড়িয়েছেন। এটি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজের ইতিহাসের মতো যা ‘সভ্যতার জন্ম' (birth of civilization) দিয়ে শুরু হয় এবং বর্তমানে 'গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের বিজয়'-এ (the triumph of democratic capitalism) দাঁড়িয়েছে। লেখক বিশ্ব মঞ্চের মার্কসবাদী সমাজতাত্ত্বিক ভবিষ্যত ব্যাখ্যা নিয়ে মাথা ঘামানন। আবার বিপরীতে, ফুকুইয়ামার ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ (end of history)-এর ঐতিহাসিক ভুল অস্বীকার করেছেন এবং ইতিহাসের এক নুতুন পুনুরাম্ভ বলে ঘোষণা করেন। এমনকি বইটি পড়ার সময়, বর্তমান অবস্থাকে দীর্ঘ সাম্প্রতিক অতীতের পরিণতি হিসাবে দেখা হয়। লেখকের ইতিহাস চিত্রিত পশ্চিমা একচেটিয়া পথের বিরুদ্ধে সফলভাবে কাজ করে স্বতন্ত্র ইতিহাস উপস্থাপন করেছে।
বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক তত্ত্বসমূহকে অস্বীকার করার জন্য বইটিতে বিভিন্ন অভিজ্ঞতামূলক যুক্তি ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। লেখক হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘর্ষের (Clash of Civilizations) মতো বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বিকশিত যুক্তি নাকচ করে মধ্যবিশ্বের সাংস্কৃতিক স্থাপনাকে আবদ্ধ করেছেন। যাইহোক, যেমনটি লেখক বলেছেন এখনও বিতর্কিত যে আরব মহলে যুক্ত সত্যিই পশ্চিমা কর্মকর্তাদের অর্থনৈতিক পেশাদারিত্ব ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। পাশ্চাত্যের কোনো সভ্যতা ছিল না বলাটাও লেখকের প্রশ্নবিদ্ধ দাবি।
অন্তঃসম্পর্কিত পরিণতি
বইটিতে পাশাপাশি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনার উপর ভিত্তি অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। বিস্তৃত বিবরণের সঙ্গে ঘটনারগুলির বিভিন্ন কারণ এবং পরিণতি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছ। আরও একটি মজার ব্যাপার, লেখকের ইতিহাস ভাষণ তারিখ এবং নামের মতো তথ্যের বিভ্রান্তিকর বোঝার সাথে জড়িত নয়। উদাহরণ স্বরূপ, জাতীয়তাবাদের (nationalism) ধারণা, যা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে রাষ্ট্রহীন ইউরোপে জোহান হার্ডারের দ্বারা উদ্ভূত হয়েছিল এবং পরে ইতালীয় জোসেফ ম্যাজিনি দ্বারা প্রচারিত হয়, সারা বিশ্বে মর্মান্তিক প্রভাব ফেলে। এমনকি ইউরোপ মহাদেশকে বিভিন্ন ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত করে, মধ্যপ্রাচে অটোমান সাম্রাজ্যকে বিনা মূলে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ইত্যাদি। তাছাড়া অবিরাম সংঘর্ষে নিছক ইসলামী ইতিহাসের পাঠক নতুন বিশ্ব গঠনে এর ভয়াবহ ভূমিকার কথা ভাবতে বাধ্য হবে। কী আশ্চর্যের বিষয় যে দুটি মর্মান্তিক বিশ্বযুদ্ধ, ইহুদিদের অভিবাসন, ফিলিস্তিনি বিপর্যয়, গৃহযুদ্ধ এবং আধুনিক যুগের আন্তঃসীমান্ত বিরোধ কোনো না কোনোভাবে সেই ধারণার সূত্রপাতের সঙ্গে যুক্ত!
গল্প হিসেবে ইতিহাস
ইতিহাস বর্ণনায় লেখকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ হল তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে একই সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির একটি সংক্ষিপ্ত চিত্রায়ন করার চেষ্টা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, এখানে সপ্তদশ শতাব্দীর বিশ্ব চিত্র অঙ্কিত: মধ্যপ্রাচ্যে, উত্তর আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপে অটোমান (১২৯৯-১৯২২), মধ্য এশিয়ায় সাফাভিদ (১৫০১-১৭৩৬) এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মুঘোল সাম্রাজ্য (১৫২৬-১৮৫৮) ছিল বিশ্বের তিনটি প্রধান শক্তি। ইতিমধ্যে ইউরোপে, ক্রুসেডের পর মরিয়া পরিস্থিতি তাদের বেঁচে থাকার বা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে নতুন সুযোগ অন্বেষণ করতে বাধ্য করে যা মুসলমানরা আগেই আবিষ্কার করে ফেলেছিল। কখনও কখনও, লেখক বিশ্বের উভয় অংশের পরিসংখ্যান/ঘটনা/স্থানের মধ্যে সৃজনশীল চিত্তাকর্ষক তুলনা করেছেন যেমন ইউরোপের জোহান হুসের সঙ্গে পারস্যের মনসুর আল-হাল্লাজের, যারা ধর্মবিরোধী অভিযুক্ত হন, অটোমান সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের (Ottoman’s Constitutional Monarchy) সঙ্গে ইউরোপের ফরাসি বিপ্লব (French Revolution) ইত্যাদি। লেখক এই পন্থা উপয়োগ করে উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠকদের জন্য ঐতিহাসিক ঘটনাকে সরল করার একটি নতুন উপায় তৈরি করেছেন।
কেন্দ্রীয়তা এবং নিরপেক্ষতা
স্ট্যানলি লেন পোলের লেখা দ্য স্টোরি অফ দ্য মুরস ইন-এর স্পেন বিপরীতে, তামিম আনসারীর বইটিতে কাব্যিক গদ্যের সঙ্গে সঙ্গে তথ্যের সত্যতা সুন্দরভাবে বজায় রাখা হয়েছে। স্পেনের কথা স্মরণ করার সময়, লেখক আন্দালুসিয়ায় ব্যাপক ইতিহাসের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেননি। বরং ইউরোপের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ইসলামের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের জন্য বাগদাদের পরিবর্তে রোম না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মধ্যবিশ্বে থেকে উদ্ভূত ঘটনার উপর লেখকের কেন্দ্রীয়তা হওয়ার কারণে সম্ভবত এই প্রবণতা দেখা গিয়েছে। যাইহোক, তিনি মুঘোল সম্রাট আকবর এবং ও ঔরঙ্গজেবের উপর বিশেষ মনোযোগী বর্ণনা সহ যথেষ্ট বিশদ বিবরণ দিয়েছে। এই কারণ হতে পারে, মধ্য এশিয়া বর্তমান উজবেকিস্তানের ফারগানা উপত্যকা থেকে পলায়ন করে বাবর ভারতীয় উপমহাদেশকে কেন্দ্র মুঘোল সম্রাজ্য করে স্থাপন করেন। একইভাবে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইসলামী সংস্কারের দুইজন বিশিষ্ট প্রবর্তক স্যার সৈয়দ আহমদ এবং সৈয়দ জামালুদ্দিন আফগানীর বর্ণনায় লেখকের কেন্দ্রীয়তা স্পষ্ট।
যাইহোক। এসব কিছু পিছনে রেখে, পরিশ্রমী লেখক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাকে বিদ্বেষ ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার জন্য সম্ভাব্য নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছেন। এমনকি বস্তুনিষ্ঠতা (objectivity) এবং নিরপেক্ষতার এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ গুণটি ইতিহাস থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ধার্মিক এবং সাংগঠনিক ভগ্নাংশের বিকাশ বর্ণনাতেও প্রতিফলিত। এটাও দেখা যায় যে লেখক কখনও কখনও ইসলাম এবং খ্রিস্টধর্মের স্থায়িত্বের মধ্যে বিতর্ক টেনে এনেছেন এবং সেই বিতর্কের ফলাফলগুলিকে আলাদাভাবে স্ফটিক করে তুলেছেন। একটি উদাহরণ নেওয়ার যাক: খ্রিস্টান ধর্ম মানুষকে ‘আদি পাপের জন্য জন্মগত দোষী’ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছে, তাই ধর্মটি ‘ব্যক্তিগত পরিত্রাণের উপর মূলত মনোনিবেশ করে’। বিপরীতে, ইসলামী তত্ত্বে মানুষ ‘নির্দোষ এবং সর্বোচ্চ আভিজাত্যের দিকে উর্তীন্ন হতে সক্ষম আবার সর্বনিম্ন অধঃপতনেরও প্রবণ’। ইসলাম মানব সম্প্রদায়কে ‘আনুগত্যের আদেশকৃত’ হিসাবে দেখে এবং শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পরিত্রাণই নয় বরং ‘নিখুঁত সম্প্রদায়ের নির্মাণ’-এর উপরও জোর দেয়। উপরন্তু, খ্রিস্টধর্মে আধ্যাত্মিকতা একটি ‘যৌনতার প্রতিকার’ যেখানে ইসলামে এটি ‘উচ্চতর অবস্থা অর্জন করার’ এক বিকল্প। এই ধরনের আকর্ষণীয় চর্চা বইটিকে যেকোনো শ্রেণীর পাঠকের কাছে প্রামাণিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। লেখক কী আবেদন করেছেন তা স্পষ্ট যে বর্তমান মুসলমান ইসলামের প্রধান উদ্দেশ্য অর্থাৎ সার্বজনীন সম্প্রদায় যা তাদের হারিয়ে যাওয়া গৌরব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যার্থ।
বইটি সুস্পষ্ট বর্ণনা এবং সুনির্দিষ্ট মূল্যায়নের মাধ্যমে ইসলামিক দৃষ্টিতে বিশ্বের ইতিহাস বর্ণনা এবং পূর্ব ও পশ্চিমকে পুরোপুরি ভারসাম্যপূর্ণ করে তাদের সঙ্গতিকে নিপুণভাবে অন্তর্ভুক্ত করে। অবশেষে লেখক গল্প বলার মাধ্যমে পাঠকদের সকল ঐতিহাসিক উন্নয়নের সাধারণ ইতিহাসবিদে পরিণত করেছেন।