মুর্শিদাবাদের বৈপরীত্য: শিক্ষা, ইসলাম এবং মুসলিম রমণীর পরিবর্তিত অবস্থান
ভূমিকা
পশ্চিমবঙ্গের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে, মুর্শিদাবাদ জেলা এক জ্বলন্ত এবং অনিবার্য প্রতিচ্ছবি রূপে দণ্ডায়মান। এই জনপদ একদিকে যেমন অসীম ঐতিহাসিক গরিমায় ভাস্বর, তেমনই সমকালীন বঞ্চনা ও প্রান্তিকীকরণের নিগূঢ় ছায়ায় আচ্ছন্ন। রাজ্যের সর্বাধিক মুসলিম জনঅধ্যুষিত এই ভূখণ্ডে মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশেরও অধিক ইসলাম ধর্মাবলম্বী। দশককাল ধরিয়া, এই সম্প্রদায়, এবং বিশেষত এই সম্প্রদায়ের নারীকুল, ভারতীয় সমাজের অন্যতম সুবিধাবঞ্চিত অংশরূপে পরিগণিত হইয়া আসিতেছে। ঐতিহাসিকভাবে, তাঁহারা শিক্ষাগত অনগ্রসরতা, অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং তাঁহাদের স্বকীয়তাকে সীমিতকারী সামাজিক প্রথার সহিত নিরন্তর সংগ্রাম করিয়া আসিতেছেন।
কিন্তু, মুর্শিদাবাদের মুসলিম রমণীদের এই উপাখ্যান আর কেবলই স্থবিরতার আখ্যান নহে। বিগত দুই দশকে যাহা ঘটিয়াছে, তৌফিক ইমরোজ খালেদীর এক সাম্প্রতিক (২০২৫) গবেষণাপত্রে তাহাকে "আমূল পরিবর্তন" বলিয়া আখ্যায়িত করা হইয়াছে। এই নিবন্ধটি সেই গবেষণালব্ধ তথ্যের উপর ভিত্তিশীল, যাহা এক গভীর "পরিবর্তনের বৈপরীত্য" (paradox of change) উন্মোচন করে। ইহা এমন এক সন্ধিক্ষণে দণ্ডায়মান সম্প্রদায়ের চিত্র তুলিয়া ধরে, যাহারা একদিকে নীতিনির্ধারণী উদ্যোগের ফলস্বরূপ শিক্ষাক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতির সাক্ষী, এবং অন্যদিকে তাঁহাদের প্রকৃত সম্ভাবনাকে রুদ্ধকারী মূলগত কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার নাগপাশে আজিও আবদ্ধ।
এই নিবন্ধ মুর্শিদাবাদের মুসলিম নারীশিক্ষার সেই জটিল বাস্তবতাকে গভীরভাবে অবলোকন করিতে প্রয়াসী। ইহা নারীশিক্ষার সমর্থনে ইসলামের মৌলিক আদর্শ এবং এই জেলায় প্রচলিত সাংস্কৃতিক ভ্রান্ত ধারণার মধ্যবর্তী গভীর ফারাককে বিশ্লেষণ করে। নিবন্ধটি তাঁহাদের অসামান্য, যদিও ভঙ্গুর, অগ্রগতির পরিসংখ্যানগত প্রমাণের সমীক্ষা করে, তাঁহাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান নিরন্তর আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ অন্বেষণ করে এবং বিদ্যালয় ব্যবস্থায় তাঁহাদের অংশগ্রহণের বাস্তব তথ্য-উপাত্ত মূল্যায়ন করে। ইহা শিক্ষাগত বঞ্চনা হইতে মুক্তির পথে এক সম্প্রদায়ের অভিযাত্রার উপাখ্যান; যে অভিযাত্রা আজিও সম্পূর্ণতা লাভ করে নাই।
ইসলামী অনুশাসন এবং মুর্শিদাবাদের ভ্রান্ত ধারণা
মূলনীতি: নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ
মুর্শিদাবাদে মুসলিম নারীদের শিক্ষাগত অগ্রগতির পথে এক অন্যতম প্রধান অন্তরায়, যাহা অনেকে ভ্রান্তভাবে ধারণা করিয়া থাকেন, তাহা ধর্মীয় নহে, বরং সম্পূর্ণরূপেই সাংস্কৃতিক—যাহা মূল ধর্মীয় আদর্শের অপব্যাখ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। খালেদীর গবেষণাপত্রটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, "ইসলামী মূলনীতিসমূহ কন্যাশিশুর শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করে না, বরং ইহাকে সমুন্নত করে।" এই গবেষণা "কন্যাশিশুকে শিক্ষিত করিবার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কিত একাধিক বর্ণনার" প্রতি ইঙ্গিত করে, যাহা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই জ্ঞানার্জনকে এক মৌলিক কর্তব্যরূপে স্থাপন করিয়াছে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বাণী রহিয়াছে:
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ
"জ্ঞান অন্বেষণ প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয (অবশ্য কর্তব্য)।" [সুনানে ইবনে মাজাহ]
এই ধর্মীয় আদর্শ, দুর্ভাগ্যবশত, জেলার বহু গ্রামীণ সম্প্রদায়ের বাস্তব জীবনচিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। গবেষণায় দেখা গিয়াছে যে, "গ্রামীণ এলাকাগুলিতে চিরাচরিত কুসংস্কারগুলি এখনও অনগ্রসরতার চিহ্ন হিসাবে ক্রিয়াশীল", যেখানে ধর্মতাত্ত্বিক অনুশাসন নহে, বরং সামাজিক প্রথাই একজন নারীর জীবনের গণ্ডি নির্ধারণ করিয়া দেয়।
অনুশীলন: ধর্মীয় আদর্শের বিপরীতে সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা
মূল সংঘাতের উদ্ভব ঘটে যখন আর্থ-সামাজিক উদ্বেগ এবং পুরুষতান্ত্রিক প্রথাসমূহকে একটি কৃত্রিম ধর্মীয় আবরণে আচ্ছাদিত করা হয়। গবেষণাপত্রে উদ্ঘাটিত হইয়াছে যে, বহু অভিভাবকই তাঁহাদের কন্যাদের মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করার ক্ষেত্রে "ধর্মীয় বিধিবিধান এবং 'সতীত্ব' (chastity) বা পর্দার ধারণাকে ভ্রান্তভাবে ব্যাখ্যা করেন"। তাঁহাদের মধ্যে এই ভীতি প্রবল যে, কন্যারা "দীর্ঘপথ পাড়ি দিলে, ছেলেদের সহিত মেলামেশার কারণে তাঁহাদের সতীত্ব বা সম্ভ্রম ক্ষুণ্ণ হইয়াছে বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে"। ইহা সমাজে এক ক্ষতিকর ধারণার জন্ম দিয়াছে, যদ্দরুন "মুসলিম সমাজ মনে করে যে শিক্ষিত মেয়েরা নৈতিকভাবে কলুষিত হইয়া পড়ে"। এই প্রকারে, পর্দা বা আব্রুর এক সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক ও বিকৃত ধারণাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করিয়া নারীদের সেই উচ্চশিক্ষা হইতেই বঞ্চিত করা হয়, স্বয়ং তাঁহাদের ধর্ম যাহাতে উৎসাহিত করিয়াছে।
এই সামাজিক ঘর্ষণ পারিবারিক ভূমিকার এক পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যার দ্বারা আরও জটিল হইয়া উঠিয়াছে। ইসলামের 'কিয়ামাহ' (পুরুষের রক্ষণাবেক্ষণ ও অভিভাবকত্ব) এবং 'বিলায়াহ' (কর্তৃত্ব) সংক্রান্ত ধারণার যে সেক্যুলার বা লৌকিক ব্যাখ্যা সমাজে প্রচলিত, তাহার সহিত গবেষণালব্ধ তথ্যের গভীর সাযুজ্য রহিয়াছে। গবেষণায় উল্লিখিত "পুরুষতান্ত্রিক অনুশীলন" এবং "সামাজিক প্রত্যাশা" এক "লিঙ্গ-পক্ষপাতদুষ্ট শিক্ষা" ব্যবস্থার সৃষ্টি করিয়াছে। মুর্শিদাবাদের গ্রামীণ অভিভাবকগণ "তাঁহাদের কন্যাদের শিক্ষার ঊর্ধ্বে পুত্রদের শিক্ষাকেই প্রাধান্য দেন"।
এই পক্ষপাতের কারণ সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিক, যাহা 'কিয়ামাহ'-এর এক বিশেষ সাংস্কৃতিক উপলব্ধিকে প্রতিফলিত করে। পবিত্র কুরআনে সূরা আন-নিসায় (৪:৩৪) পুরুষদের 'কাওয়াম' বা রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসাবে যে দায়িত্ব অর্পণ করা হইয়াছে:
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ
"পুরুষেরা নারীদের উপর তত্ত্বাবধায়ক, কারণ আল্লাহ তাঁহাদের একের উপর অপরের শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন এবং যেহেতু তাহারা তাহাদের অর্থ-সম্পদ হইতে ব্যয় করে।"
এই আয়াতের ভিত্তিতে গবেষণায় দেখা যায় যে, সমাজে প্রচলিত ধারণাটি হইল, "পুত্রসন্তানকে শিক্ষিত করা একটি 'বিনিয়োগ' (investment), কারণ তাহারাই বার্ধক্যে পিতামাতার ভরণপোষণের জন্য দায়িত্বশীল"। বিপরীতক্রমে, "কন্যাদের শিক্ষা [বিবেচিত হয়] 'অর্থের অপচয়' হিসাবে, কারণ কন্যারা পরিণামে তাহাদের স্বামীর পরিবারে বসবাস করিবে"। এই আর্থ-সামাজিক যুক্তি, যেখানে একজন পুরুষের 'কাওয়াম' বা প্রতিপালকের ভূমিকাকেই একমাত্র অর্থনৈতিকভাবে মূল্যবান বলিয়া গণ্য করা হয়, তাহা সরাসরি নারীশিক্ষায় বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। এইরূপে, সকলের জন্য শিক্ষার যে মহান ইসলামী আদর্শ, তাহা এক সাংস্কৃতিক অনুশীলনের দ্বারা পরাভূত হয়, যে অনুশীলন নারীর ভূমিকাকে কেবল গার্হস্থ্য বলিয়া মনে করে এবং বহু পরিবারের দৃষ্টিতে তাহাদের শিক্ষাকে অর্থনৈতিকভাবে অপ্রয়োজনীয় বলিয়া প্রতিপন্ন করে।
পরিসংখ্যানগত বাস্তবতা: সাক্ষরতা, বৈষম্য এবং একটি সঙ্কুচিত ব্যবধান
যদিও আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ দুর্লঙ্ঘ্য, বিগত দুই দশকের পরিসংখ্যানগত তথ্য এক অসামান্য এবং অনস্বীকার্য অগ্রগতির চিত্রই তুলিয়া ধরে। "মুর্শিদাবাদ জেলায় মুসলিম নারীদের সাক্ষরতার ধারা" (literacy trend) এই গবেষণার অন্যতম ইতিবাচক প্রাপ্তি।
সাক্ষরতার গতিপ্রকৃতি: এক দ্রুত প্রবৃদ্ধির আখ্যান
গবেষণাপত্রটি মুর্শিদাবাদে মুসলিম নারীদের সাক্ষরতার হারে কয়েক দশকব্যাপী এক অবিচল ঊর্ধ্বগতি নথিভুক্ত করিয়াছে।
- ১৯৯১ সালে, মুসলিম নারীদের সাক্ষরতার হার ছিল ৩৩.৪৫%।
- ২০০১ সাল নাগাদ, ইহা ৪২.৭৬%-এ উন্নীত হয়।
- ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, এই হার পুনরায় উল্লম্ফন করিয়া ৫৪.০৪%-এ পৌঁছায়।
ইহা এক ধারাবাহিক এবং ত্বরাণ্বিত অগ্রগতির ধারাকেই প্রমাণ করে। গবেষণাটি এই ক্রমাগত প্রবৃদ্ধির জন্য "শিক্ষাগত পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার বিকাশ," "নারীশিক্ষার প্রতি ক্রমবর্ধমান ইতিবাচক মনোভাব," এবং বিশেষত, "সরকারি প্রকল্প ও বৃত্তির সহজলভ্যতা"-কে কৃতিত্ব প্রদান করিয়াছে। এই গতিপথের উপর ভিত্তি করিয়া, সমীক্ষাটি ২০২১ সালের জন্য ৬৫.৩২% সাক্ষরতার হারের একটি সম্ভাব্য প্রক্ষেপণও করিয়াছে, যাহা এই অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতাকেই সূচিত করে।
বৈষম্য সূচক: অগ্রগতির এক তুলনামূলক চিত্র
অগ্রগতির সর্বাধিক প্রণিধানযোগ্য প্রমাণটি আসিয়াছে 'বৈষম্য সূচক' (Disparity Index) হইতে, যাহা দুইটি গোষ্ঠীর মধ্যে সাক্ষরতার ব্যবধান পরিমাপ করে। গবেষণাপত্রটি এই সূচক ব্যবহার করিয়া মুর্শিদাবাদের সাধারণ জনসংখ্যা এবং বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পুরুষ-নারী সাক্ষরতার ব্যবধানের তুলনা করিয়াছে।
- সাধারণ বৈষম্য: ২০০১ সালে, জেলার সাধারণ সাক্ষরতা বৈষম্য সূচক ছিল ০.২৩০। ২০১১ সাল নাগাদ, এই ব্যবধান সংকুচিত হয় এবং সূচকটি ০.১৪৩-এ নামিয়া আসে। ইহা প্রমাণ করে যে, সামগ্রিকভাবে, জেলার নারীরা পুরুষদের সমকক্ষ হইয়া উঠিতেছিলেন।
- মুসলিম সম্প্রদায়ের বৈষম্য: মুসলিম সম্প্রদায়ের তথ্য আরও অধিক নাটকীয়। ২০০১ সালে, পুরুষ-নারী বৈষম্য সূচক ছিল ০.১৯৯। ২০১১ সাল নাগাদ, ইহা কমিয়া মাত্র ০.১০৬-এ দাঁড়াইয়াছে।
এই বিশ্লেষণ সুস্পষ্ট: মুসলিম নারী ও মুসলিম পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার ব্যবধান সাধারণ জনসংখ্যার ব্যবধানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে দ্রুত এবং অধিক সম্পূর্ণভাবে হ্রাস পাইয়াছে। এই তথ্য এক শক্তিশালী প্রমাণপত্র যে, সাম্প্রতিক হস্তক্ষেপসমূহ এই নির্দিষ্ট, ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক গোষ্ঠীটিকে লক্ষ্যবস্তু করিতে এবং উন্নীত করিতে অসামান্য সাফল্য লাভ করিয়াছে। যদিও ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী, মুসলিম নারীদের সামগ্রিক সাক্ষরতা (৫৪.০৪%) পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ নারী সাক্ষরতার হার (৭০.৮৪%) হইতে তখনও পশ্চাতে ছিল, তথাপি তাঁহাদের অগ্রগতির হার ছিল নিঃসন্দেহে অনেক বেশি দ্রুততর।
শিক্ষার প্রতিবন্ধকতাসমূহ: ব্যবধান কেন আজিও বর্তমান
এই সকল ইতিবাচক ধারা সত্ত্বেও, গবেষণাপত্রটি স্পষ্ট করিয়াছে যে, জেলায় মুসলিম নারীদের শিক্ষাগত অবস্থান "এখনও সন্তোষজনক নহে"। ইহার কারণ, শিক্ষার পথে আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ আজিও অবিশ্বাস্যরকম উচ্চ রহিয়াছে, যাহা এক দৈনন্দিন সংগ্রামের সৃষ্টি করে এবং প্রায়শই বালিকাদের বিদ্যালয় ব্যবস্থা হইতে ছিটকাইয়া ফেলে। গবেষণাটি কতিপয় মূল প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করিয়াছে।
১. মুসলিম পরিবারের দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা
ইহা "সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ" নির্ধারক। গবেষণায় উল্লিখিত হইয়াছে যে, মুর্শিদাবাদের ৭৫% মুসলিম কৃষি বা দিনমজুরির সহিত জড়িত। জেলার মানব উন্নয়ন সূচক (HDI) যেখানে ০.৪৬-এর ন্যায় নিম্নস্তরে, সেখানে দারিদ্র্য এক সর্বব্যাপী রূপ ধারণ করিয়াছে। ইহার প্রত্যক্ষ পরিণতিস্বরূপ, "বহু কিশোরী হয় গৃহকর্মে অথবা সেলাই ও বিড়ি বাঁধার মতো বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হয়" যাহাতে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা যায়। এই অর্থনৈতিক আবশ্যকতা "তাহাদের শিক্ষাগত অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করে" এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণে কার্যকরভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
২. লিঙ্গ-পক্ষপাতদুষ্ট শিক্ষা
পূর্বে যেমন আলোচিত হইয়াছে, এই প্রতিবন্ধকতার মূল প্রোথিত রহিয়াছে সেই অর্থনৈতিক গণনায়, যাহা পুত্রসন্তানের শিক্ষাকে "বিনিয়োগ" এবং কন্যাসন্তানের শিক্ষাকে "অর্থের অপচয়" বলিয়া গণ্য করে। গ্রামীণ পরিবারগুলিতে প্রচলিত এই মনোভাব এমন এক গার্হস্থ্য পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে একটি বালিকার শিক্ষাগত আকাঙ্ক্ষা লালিত হয় না, এবং তাহাকে বিবাহের প্রস্তুতিস্বরূপ গার্হস্থ্য ভূমিকার দিকে পরিচালিত করা হয়।
৩. বালিকাদের বাল্যবিবাহ
"মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বালিকাদের শিক্ষিত করার পথে প্রধান অন্তরায়" হিসাবে বাল্যবিবাহকে চিহ্নিত করা হইয়াছে। দারিদ্র্য এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা দ্বারা চালিত হইয়া, অভিভাবকগণ এই বিশ্বাসে উপনীত হন যে, "তাঁহাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হইল কন্যাদের বিবাহ দেওয়া"। এই প্রথা একটি বালিকার শিক্ষাজীবনে যবনিকা টানিয়া দেয়, প্রায়শই স্থায়ীভাবে, এবং অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতার এই দুষ্টচক্রকে আরও শক্তিশালী করে।
৪. সামাজিক কুসংস্কার এবং সুযোগের অভাব
উচ্চশিক্ষার সহিত জড়িত "নৈতিক অবক্ষয়" এবং "সম্ভ্রমহানির" যে সাংস্কৃতিক ভীতি, তাহা এক শক্তিশালী প্রতিরোধক হিসাবে আজিও ক্রিয়াশীল। গবেষণাপত্রটি একটি সমীক্ষার উল্লেখ করিয়াছে, যেখানে ৭৯% বালিকা মত দিয়াছে যে, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় অনগ্রসরতার অন্যতম প্রধান কারণ হইল সামাজিক কুসংস্কার। ইহার সহিত যুক্ত হইয়াছে এক গভীর নিষ্ফলতার বোধ; বহু বালিকা মনে করে যে, শিক্ষা লাভ করিলেও "চাকরির সুযোগ বিরল", তাহারা "ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ঘুষের বিনিময়ে চাকরি" প্রাপ্তির দিকে ইঙ্গিত করে। তাহাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা পূর্বনির্ধারিত—এই বিশ্বাস শিক্ষাজীবনের কঠিন সংগ্রামকে অনেকের নিকটেই অর্থহীন করিয়া তোলে।
শ্রেণিকক্ষের অভ্যন্তরে: বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ এবং DISE-এর প্রতিবেদন
এই শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতাসমূহ এবং সাম্প্রতিক শিক্ষাপন্থী নীতিমালার অভিঘাতের মধ্যকার সংঘাতটি জেলার বিদ্যালয় তালিকাভুক্তির তথ্যে সর্বাধিক স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন (DISE)-এর ২০১৬-১৭ সালের রিপোর্ট কার্ডের ফলাফল সম্ভবত সর্বাধিক বৈপরীত্যপূর্ণ।
এক বিস্ময়কর সাফল্য: নারী তালিকাভুক্তি পুরুষকে অতিক্রম
DISE প্রতিবেদনটি মুর্শিদাবাদের ৬,৮৭০টি বিদ্যালয়ের এক সামগ্রিক চিত্র প্রদান করে। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে, মোট ছাত্রছাত্রী ভর্তির সংখ্যা ছিল ১,২৯৯,১১৪। এই প্রতিবেদনের সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ পরিসংখ্যান হইল লিঙ্গ বিভাজন: মোট তালিকাভুক্তির ৫০.৩% ছিল বালিকাদের, অর্থাৎ জেলার বিদ্যালয় ব্যবস্থায় ছাত্রীসংখ্যা ছাত্রদের তুলনায় সামান্য অধিক ছিল।
এই প্রবণতা শ্রেণিস্তর অনুযায়ী আরও বিভাজিত:
- প্রাথমিক (শ্রেণি I-V): মোট ৮০২,১৫২ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে বালিকারা ছিল ৪৮.৪%।
- উচ্চ প্রাথমিক (শ্রেণি VI-VIII): বালিকাদের অনুপাত বৃদ্ধি পাইয়া ৪২৪,২৮৯ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৫৪.০৪% হইয়াছে।
এই পরিসংখ্যানসমূহ সরকারি প্রকল্পগুলির প্রাথমিক লক্ষ্য—অর্থাৎ শিক্ষার 'অ্যাক্সেস' বা প্রবেশাধিকার—অর্জনে সাফল্যের এক অভূতপূর্ব প্রমাণ। তথ্যগুলি প্রাথমিক স্তরে একটি "ভারসাম্যপূর্ণ লিঙ্গ অনুপাত" এবং উচ্চ প্রাথমিক পর্যায়ে বালিকাদের সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে।
নুরেস সালামের ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষা দ্বারাও ইহা সমর্থিত, যাহা ৪০০ জন বিবাহিত ও বিধবা মুসলিম নারীর উপর পরিচালিত হইয়াছিল। উহাতে দেখা যায় যে, উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ২.৭৫% ছিলেন নিরক্ষর। পূর্ণ ৩৫% মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করিয়াছিলেন, এবং ১৪.৩৫% উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন। এই পরিসংখ্যান, যাহা এক তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করে, তাহা জেলার অতীতের চিত্রের সহিত সম্পূর্ণ বৈসাদৃশ্যপূর্ণ এবং নিশ্চিত করে যে, বিদ্যালয়ে গমনই এখন নূতন প্রথায় পরিণত হইয়াছে।
"গুণগত মানের" প্রতিবন্ধকতা: এক ভঙ্গুর বিজয়
শিক্ষায় "প্রবেশাধিকারের" এই বিজয়, দুর্ভাগ্যবশত, "ধারাবাহিক 'গুণগত মানের' প্রতিবন্ধকতা" দ্বারা গুরুতরভাবে খর্বিত হইতেছে। বালিকারা বিদ্যালয়ে থাকিলেও, তাহারা যে শিক্ষা গ্রহণ করিতেছে তাহা প্রায়শই নিম্নমানের, এবং ব্যবস্থাটি তাহাদিগকে ধরিয়া রাখিতে সংগ্রাম করিতেছে।
- ঝরিয়া পড়া/ধারণক্ষমতা: DISE-এর তথ্য শ্রেণি I (১৭৪,০৫৩ শিক্ষার্থী) হইতে শ্রেণি VIII (১৩৬,০৫৭ শিক্ষার্থী) পর্যন্ত "মোট তালিকাভুক্তিতে এক ধীর অথচ স্থির পতন" প্রদর্শন করে। ইহা ইঙ্গিত দেয় যে, যদিও বালিকাদের অনুপাত অধিক, সকল শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যাই অগ্রগতির সাথে সাথে সংকুচিত হইতেছে, যাহা উভয় লিঙ্গের ক্ষেত্রেই এক উল্লেখযোগ্য 'ড্রপআউট' বা বিদ্যালয়-ত্যাগের সমস্যার প্রতি নির্দেশ করে।
- দুর্বল পরিকাঠামো: শিক্ষণ পরিবেশের গুণমান একটি প্রধান সংকট। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, জেলার মাত্র ৬৬.৮% বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল এবং মাত্র ১০.২% বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ছিল। এই মৌলিক আধুনিক পরিকাঠামোর অভাব মানসম্পন্ন শিক্ষাকে প্রায় অসম্ভব করিয়া তোলে এবং কম্পিউটার সাক্ষরতার নিম্ন হারের জন্য দায়ী।
- বালিকাদের জন্য সুবিধা: যদিও DISE প্রতিবেদনে ৯৭.২% বিদ্যালয়ে বালিকাদের শৌচাগার থাকার কথা বলা হইয়াছে, গবেষণাপত্রটি গুণগত প্রমাণ দাখিল করিয়া দেখায় যে, এই পরিসংখ্যান বিভ্রান্তিকর হইতে পারে। ইহা উল্লেখ করে যে, "বহু বিদ্যালয়েই মহিলাদের শৌচাগারের প্রতিকূল পরিস্থিতি" রহিয়াছে এবং "ছাত্রীদের অভিভাবকগণ তাঁহাদের কন্যাদের নিরাপত্তা লইয়া উদ্বিগ্ন"। একটি সুবিধার সহজলভ্যতা এবং দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ বা নিরাপত্তার কারণে উহার ব্যবহারযোগ্যতার মধ্যে এই যে ব্যবধান, তাহা এক জটিল প্রতিবন্ধকতা, যাহা কেবল পরিসংখ্যান দ্বারা অনুধাবন করা সম্ভব নহে।
উপসংহার
মুর্শিদাবাদের মুসলিম নারীদের শিক্ষাগত অবস্থান এক গভীর বৈপরীত্যের আখ্যান। তৌফিক ইমরোজ খালেদীর গবেষণা যেমন প্রমাণ করিয়াছে, এই সম্প্রদায় "পরিবর্তনের এক বৈপরীত্যের" (paradox of change) মধ্য দিয়া চলিতেছে।
একদিকে, এই অগ্রগতি অনস্বীকার্য এবং অতিশয় প্রশংসনীয়। লক্ষ্যভিত্তিক সরকারি প্রকল্পসমূহ প্রবেশাধিকারের পথে দীর্ঘদিনের বাধাগুলিকে সফলভাবে অপসারণ করিয়াছে। মুসলিম নারীদের সাক্ষরতার হার পুরুষদের তুলনায় দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাইতেছে এবং লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যবধান সংকুচিত হইতেছে। এক অসামান্য পরিবর্তনে, বালিকারা এখন জেলার উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।
অন্যদিকে, এই অগ্রগতি "ভঙ্গুর"। ইহা গুণমানের ঊর্ধ্বে সংখ্যার বিজয়। তাহারা যে শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার লাভ করিয়াছে, তাহা পর্যাপ্ত সম্পদের অভাবে জর্জরিত, বিদ্যুৎ ও কম্পিউটারের ব্যাপক অপ্রতুলতায় পীড়িত। তদুপরি, অধিকাংশ পরিবারের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটে নাই। দারিদ্র্য আজিও কিশোরীদের একটি বিড়ির মাদুর এবং একটি পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে একটিকে বাছিয়া লইতে বাধ্য করে। সাংস্কৃতিক ভ্রান্ত ধারণাসমূহ, যেগুলিকে প্রায়শই ভ্রান্ত ধর্মীয় ব্যাখ্যার দ্বারা ন্যায্য প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়, তাহা আজিও নারীশিক্ষাকে "অপচয়" বা "নৈতিক ঝুঁকি" হিসাবেই অবলোকন করে।
মুর্শিদাবাদের মুসলিম রমণীরা শিক্ষালয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর সংগ্রামে জয়ী হইয়াছেন। পরবর্তী, এবং আরও অনেক কঠিন সংগ্রামটি হইল, একটি মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জন এবং পরিশেষে, সেই শিক্ষাকে ব্যবহার করার সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভের সংগ্রাম।
তথ্যসূত্র
Ali, M. D. Hasan. “Causes and Consequences of Out-migration: A Study in Murshidabad District, West Bengal, India.” International Journal of Development Research 8, no. 1 (2018): 18189–94.
Altaf H., and Arjun Chandra Das. “Education of Marginalized Muslim Girls at Higher Secondary Level in Murshidabad District, West Bengal.” International Journal of Multidisciplinary Research and Growth Evaluation 4, no. 4 (2023): 1061–67.
Biswas, Subrata, and Prasenjit Deb. “Role of Public Libraries in Empowering Women of Lalgola Community Development Block in Murshidabad district of West Bengal: An Analysis from Parents’ Perception.” Library Philosophy and Practice (e-journal), no. 3577 (2019).
Biswas, Subrata, and Prasenjit Deb. “Role of Public Libraries in Information Literacy for Women Empowerment: With special reference to Kanyashree girls of Nabagram in Murshidabad District of West Bengal.” Library Philosophy and Practice (e-journal), no. 4319 (2020).
Census of India. Primary Census Abstract for Total Population, Scheduled Castes and Scheduled Tribes: India, States and Union Territories. New Delhi: Office of the Registrar General & Census Commissioner, Ministry of Home Affairs, Government of India, 2011.
Dutta, A., and A. Sen. Reducing Underage Marriage and School Dropout in West Bengal. International Growth Centre, University of Oxford, 2017.
Gazi, A. R. “The Status of Muslim Women in West Bengal.” PhD diss., University of Calcutta, 2015.
Hossain, M. I. “Socio-economic and Educational Status of Muslim Women: A Comparative Outlook.” Journal of Education and Practice (2013).
Hussain, N., M. Z. Abbas, and S. Owais. “Muslims in West Bengal: Trends of Population Growth and Educational Status.” Islam and Muslim Societies: A Social Science Journal 5, no. 1 (2012).
International Institute for Population Sciences (IIPS) and ICF. National Family Health Survey (NFHS-4), 2015-16: India. Mumbai: IIPS, 2017.
International Institute for Population Sciences (IIPS). National Family Health Survey (NFHS-5), 2019-21. Mumbai: IIPS, 2021.
Islam, M. S. “Socio-economic Status of Muslim Women in West Bengal.” PhD diss., Jamia Millia Islamia University, 2021.
Jana, P. K. “Educational Status of Muslim Women in West Bengal.” PhD diss., University of Kalyani, 2016.
National Sample Survey Office (NSSO). Social Consumption: Education and Health, NSS 71st Round, January–June 2014. New Delhi: Ministry of Statistics and Programme Implementation, Government of India, 2014.
Office of the Registrar General & Census Commissioner, India. Population Census 2011. Table PCA: Primary Census Abstract C.D. Block Wise, West Bengal - District Murshidabad - 2011. New Delhi: Office of the Registrar General & Census Commissioner, 2011.
Rahaman, Mustafijur. “Educational Status of Muslim Women: A Geographical Study in Murshidabad District, West Bengal.” PhD diss., Aligarh Muslim University, 2020.
Salam, Nures. “Education and Empowerment of Muslim Women in the District of Murshidabad, West Bengal.” IMPACT: International Journal of Research in Humanities, Arts and Literature (IMPACT: URHAL) 7, no. 3 (2019): 235–42.
Shaikh, L. M., and S. K. Chowdhuri. “Socio-economic Marginalization of Muslim Women: A Case Study of Murshidabad District in West Bengal, India.” International Journal of Advances in Engineering and Management (2021).
Sopher, David E. “A Measure of Disparity.” The Professional Geographer 26, no. 4 (1974): 389–92.