নিশ্চয় নাফস মন্দ কর্মের নির্দেশদাতা

আজ বিশ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই চোখে পড়ে সমগ্র মানবকুলের অহর্নিশি ফিতনা, ফ্যাসাদ, গুনাহ ও পাপে লিপ্ত থাকা এবং পার্থিব জীবনের কাজকর্মে ব্যতিব্যস্ততা। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, এর কারণ কী? এর প্রতুত্তরে হইতো অধিকাংশ লোকেই বলবে যে শয়তান। শয়তানই হল সমস্ত গুনাহের মূল উৎসাহদাতা ও পরামর্শদাতা। হ্যাঁ, এটি সত্যি যে বর্তমানে শয়তানই হল মানবকুলের পথভ্রষ্টকারী ও গুনাহখাতার নির্দেশদাতা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কী কেবল সে-ই দায়ী? না, ভেবে দেখুন রমজানের মতো পবিত্র মাসে যদি শয়তান কে সত্যিই শিকলবদ্ধ করা হয় তবে মানুষ কেনই বা গুনাও করে? অতএব কেবল সে-ই দায়ী নয় বরং সমস্ত কিছুর মূল নির্দেশদাতা হল নাফস। 

যেহেতু এই নফসই ছিল প্রথম গুনাহর উৎসাহদাতা। ইবলিশ শয়তান আল্লাহ তায়ালাকে প্রথম অমান্য (নাফারমানি) করেছিল কেবল তার নাফসের ইচ্ছাকে (অহংকার ও হিংসা) পূরণ করার জন্য। কেবল নাফসের অনুসরণ করার জন্যই আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাত থেকে বিতাড়িত করে জাহান্নামে চিরকালের জন্য ফেলে দেয়। অথচ সে আশি হাজার বছর আল্লাহর ইবাদতে রত ছিল। এমনকি সে ছিল সমস্ত ফেরেস্তাগনের সুদক্ষ বিজ্ঞ শিক্ষক মহাশয়। কিন্তু এই গুনাহর ফলে পরিশেষে সে একজন শয়তানে পরিণত হয়। অথচ সেই সময় না ছিল কোনো দুনিয়া, না ছিল কোনো মানুষ, না ছিল কোনো শয়তান, ছিল তো কেবল নাফস। তাই তো বলা হয় এই নাফসই হল সমস্ত কুকর্মের প্রধান উৎসাহদাতা।

অতঃপর একই নাফসের ফাঁদে পড়েছিল মানবকুলের আদি পিতামাতা আদম ও হাওয়া (আঃ)।  ইবলিশ তিনাদের নাফসে চিরজীবী ও অমর হওয়ার আকাঙ্খা ও লোভ  জাগিয়ে তুলে। ফলে চিরস্থায়ী জান্নাত থেকে বহিঃসকৃত হয়ে এই দুনিয়ায়ে ফানি ধ্বংশপ্রাপ্ত নিকৃষ্ট স্থানে অবস্থান করতে হয়। আর এমনই ভাবে তিনাদের ছেলে কাবিল পূনরায় শয়তানের ওয়াসওসায় নাফসের ফাঁদে পড়ে হত্যার মত বড়ো গুনাহর সূত্রপাত করে সমগ্র বিশ্বে । যার মূল কারণ ছিল নাফসে জেগে ওঠা হিংসা ও লোভের আকাঙ্খা। অতঃপর ক্রমানুসারে মানুষ জন্মাতে থাকে ও একই কারণে তারা ভিন্ন ভিন্ন পাপে প্রবৃত্ত হয়ে পড়ে। এমনকি আজও একের পর এক প্রজন্ম এর কবলে পড়ে রয়েছে। খুব অল্প সংখ্যক লোক ব্যতীত কেউ এর হাত থেকে পরিত্রাণ পায়নি এবং কিয়ামত পর্যন্তও এই পরম্পরা চলতেই থাকবে। যেহেতু নিশ্চয় সে হচ্ছে এমন এক চরম শত্রু যে নিজের শরীরের মধ্য়েই অবস্থিত। ফলে সে হচ্ছে ঠিক আপনজনের মধ্য হইতে চুরি করে নিজ ঘরেই বসে থাকা চোরের ন্যায়। যাকে পাকড়াও করা মহা মুশকিল ও এক দুস্তর বিষয়। ঠিক তেমনই নফসের হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া খুব কঠিন ও তার ঔষধও খুব জটিল। 

এছাড়াও সে হচ্ছে সকল বিশ্ববাসীর প্রেমিক বা প্রেমিকা। তাকে সকলেই ভালোবেসে থাকে। এই পৃথিবীতে যদি কোনো এক পুরুষ বা কোনো এক নারী কাউকে ভালোবেসে থাকে তবে সে একেবারেই চোখ থাকতে অন্ধে পরিণত হয়ে যায়। তার প্রেমিকার কোনো খুঁত দেখার ক্ষেত্রে দৃষ্টিহীন হয়ে যায়। যদিও কোনো খুঁত বা মন্দ থেকে থাকে তবে সেটিকেও সে ব্যক্তিটি সুদৃষ্টিতে নেত্রপাত করে। কেবল সেই প্রেমিকাকেই সম্পূর্ণরুপে সুদক্ষ ও যোগ্য রুপে দৃষ্টিপাত করে। ঠিক তেমনই হল এই নাফস। এই নাফস যদি কোনো মন্দ কর্মে নির্দেশ দেয় তবে মানবসমাজ চোখ, বিবেক, জ্ঞান, হুস থাকা সত্বেও অজ্ঞাত অন্ধের মতো তারই অনুসরণ করে থাকে। তার কোনো মন্দ দেখতে পায় না। তাই তো কোনো এক আরবী কবি বলেছেন, 

যার প্রতি প্রেম-ভালোবাসা জেগে যায় তার কোনো খুঁত কেই না দেখতে পাই

এমনকি কোনো কিছুই নয় যদি তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যায়

এবং সন্তুষ্টপূর্ণ চক্ষু সর্বপ্রকারের খুঁত খুজতে অক্ষম

কিন্তু শত্রুতাপূর্ণ অক্ষি মন্দ কর্মের উৎসাহে সক্ষম।

কিন্তু এই নাফস হতে বাঁচার উপায় কী? তার থেকে একমাত্র রক্ষা পাওয়ার পদ্ধতি হল তাকে অবহেলিত (যালিল) করতে থাকা যতক্ষণ না তাকে লাগাম পড়িয়ে দেওয়া হয়। তাকে লাগাম পড়াতে তিনটি উল্লেখযোগ্য উপায় রয়েছে তন্মধ্যে প্রথমটি হল আল্লাহর নিকট ক্রন্দনরত হয়ে করুণভাবে সহায়তা চাওয়া যেন সেই বান্দার প্রতি মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে যান ও বান্দাকে রহমত বর্ষণ করেন। কেননা কুরআনে মাজিদের সূরা ইউসূফের ৫৩নং আয়াতে উল্লেখিত রয়েছে যে,      ان النفس لأمرة بالسوء إلا ما رحم ربي  অর্থাৎ, নিশ্চয় নাফস মন্দ কর্মের নির্দেশদাতা ব্যতীত তাদের যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। সুতরাং, নাফস হতে পরিত্রাণ পেতে হলে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করিয়ে তিনার রহমত তীব্রভাবে চাইতে হবে এবং নিজের আপ্রাণ চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে। 

তৎপর নাফসকে যালিল করার দ্বিতীয় উপায়টি হল ইচ্ছা, আকাঙ্খা, যৌনসঙ্গকামনা, লিপ্সা থেকে বিরত থাকা। কেননা একটি চঞ্চল জানোয়ারের খাওয়াদাওয়া যখন কমিয়ে দেওয়া হয় তখন কিন্তু সেও শান্ত হয়ে পড়ে । অতএব, সাহওয়াতকে যদি হ্রাস করানো যায় তবে নাফসের চঞ্চলতাও ঝিমিয়ে পড়বে।

এবং তৃতীয় উপায়টি হল অতি মাত্রায় ইবাদতের বোজকে নাফসের প্রতি বাড়িয়ে দেওয়া। একটি গাধার উপর খাবার কমিয়ে বোজ বাড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে সেও কিন্তু কাবু হয়ে পড়ে। ঠিক তেমনই নাফসের প্রতি ভার বৃদ্ধি করলে সেও ঠিক কাবু হয়ে পড়বে। সুতরাং, পরিশেষে সকলেরই স্মরণ করা উচিত যে নাফস ও শয়তান হল এমন এক চরম শত্রু যাদের সহিত সর্বদা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এবং তাদের পরাজিত সেই কিয়ামতের দিনে জয়লাভ করে পূনরায় মানবকুলকে জান্নাতে প্রবেশ করতে হবে। 



Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter