বিজ্ঞান, হৃদয় ও মস্তিষ্ক: বাস্তবতা ও আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে এক সামগ্রিক জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
“কুরআনিক বিশ্বতত্ত্ব এমন এক পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানব্যবস্থা উপস্থাপন করে, যা শরীর, মন ও হৃদয়—এই তিনটি মাধ্যমের মাধ্যমে অভিজ্ঞতাভিত্তিক, যুক্তিনির্ভর ও আত্মিক জ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটায়। এই ত্রিমাত্রিক মডেল বস্তুজগত ও আত্মিক বাস্তবতা—দুটোকেই গভীরভাবে বোঝার সুযোগ সৃষ্টি করে।”
মানবসভ্যতার বিকাশ মূলত জ্ঞানের অনুসন্ধানের ফল। প্রাচীন দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভব পর্যন্ত এই অনুসন্ধান অব্যাহত থেকেছে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক বিপ্লব মানবচিন্তায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। কিন্তু সেই বিপ্লব থেকেই জন্ম নেয় ‘সায়েন্টিজম’ (Scientism)—একটি ধারণা যা বলে, “সত্য জানার একমাত্র উপায় হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।”
তবে এই সায়েন্টিজম বা বৈজ্ঞানিক একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি অতিপ্রাকৃতিক, নৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্নগুলোকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে, ফলে চেতনা, নৈতিকতা, বা স্রষ্টার অস্তিত্বের মতো মৌলিক মানবপ্রশ্নগুলো অমীমাংসিত থেকে যায়। এই প্রবন্ধে সায়েন্টিজমের সীমাবদ্ধতাগুলো তুলে ধরা হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে কীভাবে কুরআনের দৃষ্টিতে একটি সমগ্রতাপূর্ণ জ্ঞানতত্ত্ব—যা অভিজ্ঞতা, যুক্তি ও আত্মিক অন্তর্দৃষ্টি—এই তিনের সমন্বয়ে গঠিত—বাস্তবতাকে আরও গভীরভাবে বোঝার সুযোগ দেয়।
সায়েন্টিজমের আধিপত্য ও তার জ্ঞানতাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা
আজকের বৌদ্ধিক জগতে সায়েন্টিজম একপ্রকার আধিপত্য বিস্তার করেছে। এই মতবাদ অনুযায়ী, কেবল সেই জ্ঞানকেই সত্য বলা যায় যা প্রমাণযোগ্য ও পরীক্ষাযোগ্য। ফলে ধর্ম, নৈতিকতা ও অতিপ্রাকৃতিক সত্যগুলোকে হয় অসত্য নয়তো ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
নিঃসন্দেহে বিজ্ঞান চিকিৎসা, প্রযুক্তি ও শিল্পক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটিয়েছে। কিন্তু এই সাফল্যই অনেককে ভুলভাবে বিশ্বাস করিয়েছে যে বিজ্ঞানই সত্যের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস। এর ফলে এমন প্রশ্ন—যেমন জীবনের উদ্দেশ্য কী, নৈতিকতার ভিত্তি কোথায়, মৃত্যুর পর কী আছে, বা স্রষ্টা আছেন কি না—এসবকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ বলে গণ্য করা হয়।
কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা গুরুতর। বিজ্ঞান বলতে পারে জীবন কীভাবে কাজ করে, কিন্তু বলতে পারে না কেন জীবন আছে—কারণ উদ্দেশ্যের প্রশ্ন বিজ্ঞানীর পরীক্ষাগারে মাপা যায় না। একইভাবে, নৈতিক সত্য কোনো পরীক্ষানির্ভর পর্যবেক্ষণ থেকে উদ্ভূত হয় না; বিজ্ঞান বলতে পারে না কী ন্যায়, কী অন্যায়। মৃত্যু ও পরকাল সম্পর্কিত বিষয়ও বিজ্ঞানের আওতার বাইরে, কারণ এগুলো অদৃশ্য বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
সবচেয়ে মৌলিকভাবে, স্রষ্টা (আল্লাহ) যেহেতু অতীন্দ্রিয় ও সীমাহীন, তিনি বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে ধরা পড়েন না। তাঁকে পরীক্ষাগারে বন্দি করা বা কোনো যন্ত্র দিয়ে মাপা সম্ভব নয়।
ফলে, বিজ্ঞান প্রায়শই মানুষের অস্তিত্বসংক্রান্ত বড় প্রশ্নগুলোর (যেমন “আমরা কেন এখানে?” বা “নৈতিকতার ভিত্তি কী?”) হ্রাসবাদী (reductionist) বা অনুমাননির্ভর উত্তর দেয়—যা মানুষের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যবোধ বা আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করে। এর ফলেই দেখা দেয় অস্তিত্বগত বিভ্রান্তি, অর্থহীনতার বোধ (nihilism), এবং আধ্যাত্মিক শূন্যতা ও মানসিক ক্লান্তি।
অতএব, বিজ্ঞান বস্তুজগত বোঝার জন্য অপরিহার্য হলেও, তার সীমা আছে। বাস্তবতার পূর্ণ উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন একটি সামগ্রিক জ্ঞানতত্ত্ব (holistic epistemology)—যেমনটি কুরআন উপস্থাপন করে—যেখানে অভিজ্ঞতা, যুক্তি ও আত্মিক অন্তর্দৃষ্টি একসাথে কাজ করে, এবং যা মানুষকে বস্তুজগতের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক বাস্তবতার সঙ্গেও সংযোগ ঘটাতে শেখায়।
কুরআনিক জ্ঞানতত্ত্ব: সত্যের ত্রিমাত্রিক পথ
কুরআনিক বিশ্বতত্ত্ব এমন এক পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানব্যবস্থা উপস্থাপন করে, যা অভিজ্ঞতাভিত্তিক (Empirical), যুক্তিনির্ভর (Rational) এবং আত্মিক (Spiritual)—এই তিনটি জ্ঞানপদ্ধতির সমন্বয়ে গঠিত। এটি শরীর, মন ও হৃদয়—এই তিন মাধ্যমের মাধ্যমে মানুষকে বস্তুজগত এবং আত্মিক বাস্তবতা উভয়কেই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে।
১. অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞান (শরীর):
কুরআন মানুষকে আহ্বান জানায় প্রকৃতির দিকে তাকাতে—তার শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য ও কার্যপ্রণালী পর্যবেক্ষণ করতে। এগুলো আল্লাহর প্রজ্ঞা ও শক্তির নিদর্শন বা “আয়াত” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষের শরীর তার ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এই সৃষ্টিজগতকে অনুভব করে এবং তা থেকে জ্ঞানের বীজ সংগ্রহ করে চিন্তাভাবনার ভিত্তি তৈরি করে।
إِنَّ فِى خَلْقِ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَٱخْتِلَـٰفِ ٱلَّيْلِ وَٱلنَّهَارِ لَـَٔايَـٰتٍۢ لِّأُو۟لِى ٱلْأَلْبَـٰبِ
“নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং রাত-দিনের পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।”
(সূরা আলে ইমরান ৩:১৯০)
এই দৃষ্টিভঙ্গি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে স্বীকৃতি দেয়, তবে সতর্ক করে দেয় যেন মানুষ প্রকৃতিকে শুধুমাত্র যান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে না দেখে, বরং তার গভীরে থাকা অর্থ ও উদ্দেশ্যকেও চিনে নেয়।
২. যুক্তিনির্ভর জ্ঞান (মন):
কুরআন যুক্তি, চিন্তা ও মননশীলতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। কুরআনে প্রায়ই ব্যবহৃত হয় শব্দগুলো—“ইয়াতাফাক্কারুন” (তারা চিন্তা করে), “ইয়াকিলুন” (তারা বুদ্ধি ব্যবহার করে) এবং “ইয়াতাদাব্বারুন” (তারা গভীরভাবে ভাবনা করে)—যা মানুষকে যুক্তি ও বুদ্ধি প্রয়োগে উৎসাহিত করে।
أَوَلَمْ يَتَفَكَّرُوا۟ فِىٓ أَنفُسِهِم ۗ مَّا خَلَقَ ٱللَّهُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَآ إِلَّا بِٱلْحَقِّ وَأَجَلٍۢ مُّسَمًّۭى ۗ وَإِنَّ كَثِيرًۭا مِّنَ ٱلنَّاسِ بِلِقَآئِ رَبِّهِمْ لَكَـٰفِرُونَ
“তারা কি নিজেদের মধ্যে চিন্তা করে না? আল্লাহ আসমান ও জমিন এবং এ দু’টির মধ্যে যা কিছু আছে, সবই এক নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও সময়সীমার জন্য সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু অনেক মানুষই তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাৎ অস্বীকার করে।” (সূরা আর-রূম ৩০:৮)
এখানে বুদ্ধি মানুষকে পর্যবেক্ষিত ঘটনাগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে, বিশ্লেষণ করতে ও ফলাফল নির্ণয় করতে সাহায্য করে। তবে কুরআন সতর্ক করে দেয়—যুক্তি ও জ্ঞান যদি আত্মিক ভিত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তবে তা অহংকার ও বিদ্রোহে রূপ নিতে পারে, যেমনটি দেখা গিয়েছিল ইবলিসের ক্ষেত্রে।
অতএব, কুরআনের মতে প্রকৃত জ্ঞান আসে তখনই, যখন অভিজ্ঞতা, যুক্তি ও আত্মিক উপলব্ধি একত্রে কাজ করে—যেখানে শরীর দেখে, মন ভাবে, আর হৃদয় অনুভব করে।
৩. আত্মিক জ্ঞান (হৃদয়):
কুরআনে “কল্ব” (قلب) বা হৃদয়কে জ্ঞানের কেন্দ্র বা আধ্যাত্মিক বোধের আসন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি এমন এক জ্ঞানবোধ ধারণ করে, যা ইন্দ্রিয় বা যুক্তির সীমার বাইরে — নৈতিকতা, সত্য, ও অস্তিত্বের গভীর অর্থ হৃদয়ই অনুধাবন করতে সক্ষম।
أَفَلَمْ يَسِيرُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ فَتَكُونَ لَهُمْ قُلُوبٌۭ يَعْقِلُونَ بِهَآ أَوْ ءَاذَانٌۭ يَسْمَعُونَ بِهَا ۖ فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى ٱلْأَبْصَـٰرُ وَلَـٰكِن تَعْمَى ٱلْقُلُوبُ ٱلَّتِى فِى ٱلصُّدُورِ
“তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না, যাতে তাদের এমন হৃদয় হয় যা দ্বারা তারা চিন্তা করতে পারে, অথবা এমন কান হয় যা দ্বারা তারা শুনতে পারে? প্রকৃতপক্ষে অন্ধ হয় না চোখ, বরং অন্ধ হয় সেই হৃদয়সমূহ, যা বক্ষের মধ্যে অবস্থিত।” (সূরা আল-হাজ্জ ২২:৪৬)
এই আয়াতের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, হৃদয় শুধুমাত্র অনুভূতির স্থান নয়; বরং এটি সত্য উপলব্ধির কেন্দ্র। যখন হৃদয় পরিশুদ্ধ ও অহংকারমুক্ত হয়, তখন তা আল্লাহর দিক থেকে আগত হেদায়াত বা নির্দেশনা গ্রহণে সক্ষম হয়। এমন হৃদয়ই জীবনের অর্থ, পরকাল, এবং স্রষ্টার উপস্থিতি অনুভব করতে পারে।
কুরআনের দৃষ্টিতে, জ্ঞানের পরিপূর্ণতা তখনই ঘটে যখন ইন্দ্রিয় (শরীর), বুদ্ধি (মন) ও হৃদয় (আত্মা) — এই তিনটি একত্রে কাজ করে। হৃদয় এই ত্রিমাত্রিক জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তর, যা মানুষকে কেবল জগৎকে বোঝার নয়, বরং তার অন্তর্নিহিত অর্থ ও স্রষ্টার উদ্দেশ্য অনুধাবনের পথ দেখায়।
একীভূত দৃষ্টান্ত: বীজের উপমা
একটি ছোট্ট বীজ, প্রথমে তুচ্ছ মনে হলেও, সময়ের সঙ্গে তা একটি জীবন্ত বৃক্ষে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়াটি কেবল জৈববিজ্ঞানের ফল নয়, বরং এক উচ্চতর জ্ঞানের ছাপ, যা নিছক দৈব বা কাকতালীয় নয়। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, বীজটি আসলে এক আধ্যাত্মিক নিদর্শন, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—স্রষ্টা আছেন, যিনি প্রজ্ঞা ও জীবনচক্রের নকশা রচনা করেছেন।
কুরআনের দৃষ্টিতে, সত্য তখনই সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়, যখন শরীর পর্যবেক্ষণ করে, মন চিন্তা করে, আর হৃদয় শ্রবণ করে। অর্থাৎ, দর্শন (empirical observation), বিবেচনা (rational reflection) ও আধ্যাত্মিক অনুধাবন (spiritual intuition) — এই তিনটি পদ্ধতি একত্রে কাজ করলে জ্ঞানের পূর্ণতা ঘটে। বীজের বৃদ্ধি এই সমন্বিত জ্ঞানতত্ত্বের এক সুন্দর প্রতীক।
আল্লাহর বাস্তবতা ও সমন্বিত অনুসন্ধানের প্রয়োজন
কুরআন কোনো শুষ্ক দার্শনিক যুক্তিতে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায় না; বরং এটি আহ্বান জানায় মানুষের গভীরে নিহিত সেই ফিতরাহ্ (স্বভাবগত ঈশ্বর-চেতনা)-কে। কুরআনের আহ্বান শুধু যুক্তি বা ইন্দ্রিয়ের প্রতি নয়, বরং সম্পূর্ণ মানুষ—শরীর, মন ও হৃদয়—এর প্রতি।
এই ত্রিমাত্রিক জ্ঞান বা সমন্বিত অনুসন্ধান (holistic inquiry) তিনটি পথের মাধ্যমে বাস্তবতা ও স্রষ্টার চিহ্নকে উন্মোচিত করে—
১. প্রায়োগিক নিদর্শন (Āyāt Kauniyyah – Cosmic Indicators):
প্রকৃতি কেবল পরমাণু ও শক্তির সমষ্টি নয়; এটি আল্লাহর প্রজ্ঞা, যত্ন ও সৃজনশীল নকশার প্রতিফলন।
إِنَّ ٱللَّهَ فَالِقُ ٱلْحَبِّ وَٱلنَّوَىٰ ۖ يُخْرِجُ ٱلْحَىَّ مِنَ ٱلْمَيِّتِ وَمُخْرِجُ ٱلْمَيِّتِ مِنَ ٱلْحَىِّ ۚ ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ ۖ فَأَنَّىٰ تُؤْفَكُونَ
“নিশ্চয়ই আল্লাহই দানা ও আঁটির বিদারক; তিনিই জীবিতকে মৃত থেকে এবং মৃতকে জীবিত থেকে বের করে আনেন। এটাই আল্লাহ, তাহলে তোমরা কেমন করে বিমুখ হচ্ছ?”
(সূরা আল-আন‘আম ৬:৯৫)
বীজ অঙ্কুরোদ্গম, বৃষ্টিচক্র, কিংবা জীবজগতের মৃত্যু ও পুনর্জন্ম—এসব প্রক্রিয়া বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যাযোগ্য হলেও, কুরআন আমাদের আহ্বান জানায় এগুলিকে বার্তা (message) হিসেবে দেখতে, কেবল যান্ত্রিক প্রক্রিয়া (mechanism) হিসেবে নয়।
এইভাবে, কুরআনিক জ্ঞানতত্ত্ব মানুষকে শেখায় — বাস্তবতা বোঝা মানে কেবল দেখা নয়, বরং দেখার পেছনের উদ্দেশ্য অনুভব করা; আর এই অনুভবই মানুষকে স্রষ্টার দিকে পথ দেখায়।
২. যুক্তিনির্ভর চিন্তা – তাফাক্কুর (মনন ও ভাবনা)
কুরআন সরাসরি মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন রাখে—যেসব প্রশ্ন আমাদের ভাবতে বাধ্য করে, আমাদের ভ্রান্ত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে।
أَمْ خُلِقُوا۟ مِنْ غَيْرِ شَىْءٍ أَمْ هُمُ ٱلْخَـٰلِقُونَ
“তারা কি কিছু ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে, নাকি তারাই নিজেদের স্রষ্টা?” (সূরা আত-তূর ৫২:৩৫)
এটি কেবল একটি অলঙ্কারমূলক প্রশ্ন নয়; বরং গভীর যুক্তিনির্ভর চ্যালেঞ্জ। কীভাবে এমন একটি জটিল ও সুশৃঙ্খল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কোনো কারণ ছাড়াই, সম্পূর্ণ শূন্য থেকে তৈরি হতে পারে? এই প্রশ্ন আমাদের ভাবতে শেখায় যে, বিশ্বের নকশা ও সঙ্গতি আসলে একটি পরিকল্পিত সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে।
৩. আধ্যাত্মিক অনুধাবন – হাদস (অন্তর্দৃষ্টি ও অন্তঃসাক্ষ্য)
যৌক্তিক বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের পরও মানুষের ভেতরে থাকে এক নীরব কণ্ঠ—হৃদয়ের কণ্ঠ। কুরআন এই অন্তর্দৃষ্টি বা অন্তঃসাক্ষ্যকে স্বীকার করে, যা আমাদের ভেতর থেকেই আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয়।
وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنۢ بَنِىٓ ءَادَمَ مِن ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ ۖ قَالُوا۟ بَلَىٰ ۛ شَهِدْنَآ ۛ أَن تَقُولُوا۟ يَوْمَ ٱلْقِيَـٰمَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَـٰذَا غَـٰفِلِينَ
“আর স্মরণ কর, যখন তোমার প্রভু আদমসন্তানদের পিঠ থেকে তাদের বংশধরদের বের করে তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী করলেন— ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’ তারা বলল, ‘অবশ্যই, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।” (সূরা আল-আরাফ ৭:১৭২)
এই আয়াতে বলা হয়েছে এক প্রাথমিক অঙ্গীকারের মুহূর্তের কথা—যখন আত্মাগুলো জন্মের পূর্বে আল্লাহর প্রভুত্বের স্বীকৃতি দিয়েছিল। কুরআনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষের আত্মার গভীরে এই ঐশী চেতনার প্রতিধ্বনি রয়ে গেছে। যদিও পৃথিবীর জীবন, ভোগবিলাস ও ব্যস্ততা আমাদের ভুলিয়ে দেয়, তবুও অন্তরের গভীরে আমরা ইতিমধ্যেই জানি—আমাদের এক স্রষ্টা আছেন, যাঁর সঙ্গে আমাদের সেই প্রাচীন সম্পর্ক আজও বেঁচে আছে।
জ্ঞানক্ষেত্রের বিভাজনের সমালোচনা
কুরআনের অন্যতম গভীর সমালোচনার বিষয় হলো জ্ঞানকে ভাগ করে দেখা বা জ্ঞানক্ষেত্রের বিভাজন — যা কেবল আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাতেই নয়, প্রাচীন যুগের অনেক ব্যবস্থাতেও দেখা যায়। আজ আমরা প্রায়ই এক ধরনের বিভাজন সৃষ্টি করি—বিজ্ঞানকে ধরা হয় নিরপেক্ষ, যৌক্তিক ও সার্বজনীন, আর ধর্মীয় বিশ্বাসকে মনে করা হয় ব্যক্তিগত, আবেগনির্ভর ও যাচাই-অযোগ্য। এর ফলে আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে সমাজের বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়, যেন তা কেবল ব্যক্তিগত বা সাংস্কৃতিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বিশ্বের প্রতি বোঝাপড়াকে অসম্পূর্ণ করে তোলে।
কিন্তু কুরআন এই বিভাজনকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে। কুরআনের দৃষ্টিতে জ্ঞান কোনো বিচ্ছিন্ন বস্তু নয়। বিজ্ঞান, নৈতিকতা, শিল্প ও আধ্যাত্মিকতা—সবই পরস্পর সংযুক্ত, এগুলো আল্লাহ ও মহাবিশ্বকে বোঝার একই অনুসন্ধানের বিভিন্ন দিক। কুরআন শেখায়, জ্ঞানের এক দিককে গ্রহণ করে অন্য দিককে উপেক্ষা করা মানে হলো জ্ঞান-অসততা বা আধ্যাত্মিক ভণ্ডামি করা।
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ ٱلْكِتَـٰبِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍۢ
“তোমরা কি কিতাবের এক অংশে বিশ্বাস করো আর অন্য অংশে অবিশ্বাস করো?”
(সূরা আল-বাকারা ২:৮৫)
এই আয়াত মূলত আহলে কিতাবদের উদ্দেশ্যে বলা হলেও, এর বার্তা চিরন্তন ও সার্বজনীন। সত্যের আংশিক গ্রহণ আসলে সত্যের পূর্ণতাকে বিকৃত করে। আজকের বিশ্বে যেসব মতবাদ প্রমাণযোগ্য বিজ্ঞানের মূল্য দেয়, কিন্তু অদৃশ্য বা অতীন্দ্রিয় বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, তারা আসলে একই ভুলে পড়ে—সত্যকে অসম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করে।
কুরআনের দৃষ্টিতে হৃদয় (ক্বালব), বুদ্ধি (‘আকল), ও ইন্দ্রিয় (হাওয়াস) — এই তিনটি শক্তিই জ্ঞান অর্জনের অপরিহার্য মাধ্যম। যদি যুক্তিকে ওহি থেকে, অথবা বিজ্ঞানকে আধ্যাত্মিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, তবে প্রত্যেকের প্রকৃত ভূমিকা বিকৃত হয়ে যায়। তখন বুদ্ধি কেবল ঠান্ডা যুক্তিতে পরিণত হয়, বিজ্ঞান তার বিস্ময় হারায়, আর হৃদয় জ্ঞান-অনুসন্ধান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
কুরআনের মতে সঠিক জ্ঞান হলো এই তিন শক্তির সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয়— বাস্তব পর্যবেক্ষণ, যৌক্তিক বিশ্লেষণ ও আধ্যাত্মিক অনুধাবন—এই তিনের মিলনে মানুষ সত্যকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারে। এই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের জ্ঞানকে গভীরতা, সততা ও উদ্দেশ্য প্রদান করে। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এই বিশ্ব কেবল তথ্যের সমষ্টি নয়—বরং এটি এমন এক সত্তা, যাকে অভিজ্ঞতা ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে বোঝা যায়।
উপসংহার
আজকের পৃথিবীতে, যেখানে বিজ্ঞানকে প্রায়ই চূড়ান্ত সত্যের একমাত্র উৎস হিসেবে দেখা হয়, সেখানে আমাদের প্রয়োজন একটি সামগ্রিক ও ভারসাম্যপূর্ণ জ্ঞানচর্চার দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে যুক্তি ও আধ্যাত্মিকতা উভয়কেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিজ্ঞান নিঃসন্দেহে ভৌত জগতের কার্যপ্রণালি ও নিয়মাবলি ব্যাখ্যা করতে অসাধারণ দক্ষ, কিন্তু এটি জীবনের অর্থ, উদ্দেশ্য, ও স্রষ্টার অস্তিত্বের মতো গভীর প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে অক্ষম। কুরআনিক জ্ঞানতত্ত্ব (epistemology) এমন এক মডেল উপস্থাপন করে, যা পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণকে (empirical inquiry) স্বাগত জানায়, তবে এটিকে আরও বৃহত্তর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক কাঠামোর মধ্যে স্থাপন করে। কুরআন শেখায়, প্রকৃত বোঝাপড়া কেবল ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি দিয়েই সম্ভব নয়, বরং এর সঙ্গে থাকতে হবে হৃদয়ের (ক্বালব) আধ্যাত্মিক সংবেদনশীলতা, যা গভীর অর্থ ও অতীন্দ্রিয় সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম।
এই দৃষ্টিভঙ্গি সায়েন্টিজমের (scientism) সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করে—যে মতবাদ মনে করে, কেবল বিজ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞানের একমাত্র পথ। কুরআন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আত্মার প্রকৃতি, পরকাল, ও ঈশ্বরীয় উদ্দেশ্য—এসব এমন সত্য, যা বিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে ধরা পড়ে না। অতএব, যদি আমরা এই সমন্বিত জ্ঞানদৃষ্টিভঙ্গি পুনরায় গ্রহণ করি, তাহলে বিশ্বাস ও যুক্তির মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে মানবজ্ঞান আরও গভীর, পূর্ণাঙ্গ ও আত্মিকভাবে তৃপ্তিকর হয়ে উঠবে। বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং তারা একে অপরকে সমৃদ্ধ করে মানবজাতিকে সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।