উম্মতের প্রতি নবীজির ﷺ আকুল মমতা: প্রার্থনা, অশ্রু ও সীমাহীন যত্নশীলতা
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মদ ﷺ-কে এমন একটি মহান মর্যাদা দান করেছেন, যা ইতিহাসে আর কারও ভাগ্যে জোটেনি। নবী করিম ﷺ সেই মহামানব, যাঁকে আল্লাহ তাআলা “রহমাতুল্লিল আলামিন” সমগ্র জগতের জন্য রহমত হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
আল্লাহ বলেন:
﴿لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ﴾ (সূরা আত-তাওবা: ১২৮)
অর্থ: “তোমাদের মধ্য থেকেই এমন এক রাসূল তোমাদের কাছে এসেছেন, তোমাদের কষ্ট তাঁর কাছে কষ্টদায়ক, তিনি তোমাদের কল্যাণের প্রতি গভীরভাবে আগ্রহী, আর মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ও করুণাময়।” এই আয়াত নবী করিম ﷺ-এর হৃদয়ের গভীর মমতা ও ভালোবাসা প্রকাশ করে। তিনি সেই নবী, যিনি উম্মতের জন্য রাত জেগে ইবাদত করতেন, দিনে দাওয়াত ও পরিশ্রম করতেন, আর তাদের জন্য অশ্রু ঝরাতেন।
এক হাদীসে বর্ণিত আছে— নবী ﷺ যখন হযরত ইবরাহিম (আঃ)-এর দোয়া পড়লেন:
﴿فَمَن تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي﴾ (সূরা ইবরাহিম: ৩৬)
অর্থ: “যে আমার অনুসরণ করবে, সে তো আমারই অন্তর্ভুক্ত।” এই আয়াত পাঠ করে নবী ﷺ-এর মুখ থেকে অনায়াসে বেরিয়ে এলো: “হে আমার রব! আমার উম্মত! আমার উম্মত”
এবং তাঁর চোখ অশ্রুতে ভিজে গেল। তখন আল্লাহ তাআলা জিবরাঈল (আঃ)-কে পাঠালেন এবং বললেন, “আমার প্রিয় নবী কেন কাঁদছেন?” নবী ﷺ বললেন, “হে আল্লাহ! আমি আমার উম্মতের চিন্তায় কাঁদছি।” তখন আল্লাহ বললেন, “আমি তোমাকে তোমার উম্মতের ব্যাপারে এমনভাবে সন্তুষ্ট করব যে তুমি কখনোই অসন্তুষ্ট হবে না।” এই দৃশ্য এমন এক ভালোবাসার উদাহরণ, যা ইতিহাসের পাতায় অনন্য। আল্লাহর প্রিয় নবী ﷺ উম্মতের জন্য রাত্রিবেলা কাঁদছেন — এটি মানবতার ইতিহাসে অকল্পনীয় এক মমতার নিদর্শন।
নবী ﷺ তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ত্যাগ ও ধৈর্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মক্কার উত্তপ্ত মরুভূমিতে যখন কুরাইশরা তাঁকে নির্যাতন করত, তিনি ধৈর্য ধরতেন। কাঁটা, পাথর, উপহাস, রক্তক্ষরণ— সব সহ্য করেও তাঁর মুখে অভিযোগ ছিল না, বরং দোয়া ছিল:
“اللهم اهدِ قومي فإنهم لا يعلمون”
অর্থ: “হে আল্লাহ! আমার জাতিকে হিদায়াত দিন, তারা জানে না।” তায়েফের ঘটনার সময়ও যখন তাঁকে পাথর মেরে আহত করা হয়, রক্তে ভিজে যান, তখনও তিনি বলেন: “اللهم إن لم يكن بك غضب علي فلا أبالي”
অর্থ: “হে আল্লাহ! যদি তুমি আমার প্রতি রাগান্বিত না হও, তবে আমি কিছুই পরোয়া করি না।” এমন দয়া ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত আর কোথাও নেই।
হিজরতের সময়ও নবী ﷺ সমস্ত আরাম ও সুখ ত্যাগ করলেন। প্রিয় জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে যেতে গিয়ে বললেন: “হে মক্কা! তুমি আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়, কিন্তু তোমার মানুষ আমাকে থাকতে দেয়নি।” মদিনায় পৌঁছে নবী ﷺ নতুন এক উম্মতের ভিত্তি স্থাপন করেন। দিনরাত দাওয়াত, শিক্ষা, ও কল্যাণে ব্যস্ত থাকতেন। তবুও মুখে হাসি, হৃদয়ে কৃতজ্ঞতা, আর জিহ্বায় আল্লাহর প্রশংসা থাকত। এক রাতে হযরত আয়েশা (রাঃ) দেখলেন, নবী ﷺ সিজদায় পড়ে কাঁদছেন, এমনকি মাটি অশ্রুতে ভিজে গেছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো ক্ষমাপ্রাপ্ত, তবু কেন এত কাঁদছেন?” নবী ﷺ বললেন:
“أفلا أكون عبدًا شكورًا؟”
অর্থ: “আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?” এবং আরও বললেন, “আমি আমার উম্মতের গুনাহের জন্য দোয়া করছি।”
আরেকটি হাদীসে নবী ﷺ বলেছেন:
“لكل نبي دعوة مستجابة، وإني اختبأت دعوتي شفاعةً لأمتي يوم القيامة.”
অর্থ: “প্রত্যেক নবীর একটি কবুলযোগ্য দোয়া আছে। আমি আমার সেই দোয়াটি কিয়ামতের দিনে আমার উম্মতের জন্য শাফাআতের জন্য রেখে দিয়েছি।” এই ভালোবাসা এমন, যা মৃত্যুর পরও শেষ হয়নি, বরং আরো গভীর হয়েছে।
উহুদের যুদ্ধক্ষেত্রে নবী ﷺ আহত হলেন, মুখ রক্তে ভরে গেল, তবুও তিনি বললেন:
“اللهم اغفر لقومي فإنهم لا يعلمون”
অর্থ: “হে আল্লাহ! আমার জাতিকে ক্ষমা কর, তারা জানে না।” এটি তাঁর সীমাহীন ধৈর্য ও করুণার প্রকাশ। নবী ﷺ প্রায়ই ক্ষুধার্ত থাকতেন, অথচ অন্যদের খেতে দিতেন। কখনও কখনও কয়েক দিন ধরে তাঁর ঘরে চুলা জ্বলত না। একবার একজন মানুষ এলেন ও বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমার কিছুই নেই।” নবী ﷺ নিজের চাদরটি তাঁকে দিয়ে বললেন, “এটি বিক্রি করে তোমার পরিবারের জন্য ব্যয় কর।”
নবী ﷺ বলেছিলেন:
“ما لي وللدنيا؟ إنما أنا كراكبٍ استظلّ تحت شجرةٍ ثم راح وتركها.”
অর্থ: “আমার দুনিয়ার সঙ্গে কী সম্পর্ক? আমি তো এক পথিক, যে ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চলে যায়।” এই হলো সেই নবী, যিনি পৃথিবীর ধনসম্পদ ত্যাগ করে মানবতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।
জীবনের শেষ মুহূর্তেও নবী ﷺ বলছিলেন:
“أمتي، أمتي”
অর্থ: “আমার উম্মত, আমার উম্মত।”
তিনি আরও বলেছিলেন:
“إنما مثلي ومثل أمتي كمثل رجل أوقد نارًا، فجعل الفراش وهذه الدواب تقع فيها، وأنا آخذ بحجزكم وأنتم تقحمون فيها.” অর্থ: “আমার ও আমার উম্মতের উদাহরণ সেই ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ্বালায়, পতঙ্গগুলো তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর আমি তোমাদের টেনে বাঁচানোর চেষ্টা করি, কিন্তু তোমরা তবুও তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছো।”
এভাবে নবী ﷺ আমাদের জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য জীবনভর চেষ্টা করেছেন। তিনি এমনকি কোরবানির সময়ও উম্মতের কথা ভোলেননি — এক কোরবানি নিজের জন্য এবং আরেকটি তাঁদের জন্য করলেন, যাঁরা কোরবানি করতে অক্ষম। আজকের বস্তুবাদী পৃথিবীতে, যখন উম্মত বিভক্ত ও দুর্বল, নবী ﷺ-এর সেই আহ্বান আবার শোনা যায় — “হে আমার উম্মত! ঐক্যবদ্ধ হও, ন্যায় প্রতিষ্ঠা কর, দয়া কর, ভালোবাসা ছড়াও।” নবী ﷺ-এর জীবন আমাদের শেখায় — ইসলাম কেবল নামাজ-রোজার ধর্ম নয়, বরং ত্যাগ, সেবা, আন্তরিকতা ও মানবতার কল্যাণের এক পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টান্ত।
“হে আল্লাহ! আমাদের নবী ﷺ-এর ভালোবাসা আমাদের হৃদয়ে দান কর, তাঁর সুন্নাহ্ অনুসরণের তাওফিক দাও, তাঁর পথে চলার শক্তি দাও, এবং কিয়ামতের দিনে আমাদেরকে তাঁর হাউজে কাওসারের পাশে তাঁর সাক্ষাৎ দান কর।”آمين، ثم آمين