পাহেলগাম হত্যাকাণ্ড: ইসলামি মানবতা ও সহনশীলতার আলোকে এক মূল্যায়ন
ভূমিকা :
২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পাহেলগাম এলাকায় এক মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়। খবর অনুযায়ী, সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা একটি পর্যটকবাহী বাসে হামলা চালায়। এতে অন্তত ২৬ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান এবং অনেকে আহত হন। এই হামলার নৃশংসতা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, বরং মানবতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সামাজিক সম্প্রীতির উপর এক ভয়ানক আঘাত। এই প্রবন্ধে পাহেলগাম হামলার প্রেক্ষিতে ইসলামি মানবতাবোধ, সহনশীলতা ও শান্তির বার্তা তুলে ধরা হয়েছে। কাশ্মীরের পাহেলগামে সাম্প্রতিক হামলাটি অঞ্চলটির দীর্ঘকালীন সংঘাত, বিতর্কিত বর্ণনাপ্রবণতা এবং বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতির ভারে জর্জরিত বাস্তবতার আরও একটি মর্মান্তিক অধ্যায় হয়ে উঠেছে। ঘটনার তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যেমন প্রত্যাশিত ছিল, তেমনই ক্ষোভ ও দোষারোপের চেনা দৃশ্য হাজির হয়েছে। তবে এ ধরনের সহিংসতা কীভাবে প্রায়ই শাস্তি ছাড়াই ঘটতে পারে, সেই গভীর কাঠামোগত বাস্তবতাগুলোর বিশ্লেষণ করা এখন জরুরি।
এই ধরণের ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা যখন হয়, তখন তা দ্রুতই সরলীকৃত পরিচয়-ভিত্তিক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। ফলে এই জটিল ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত ইস্যুটি এমন এক খাঁচায় বন্দি হয়ে যায়, যেখানে রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা, গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং কাশ্মীরের অনির্ধারিত রাজনৈতিক অবস্থান ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল হয়ে যায়। এটি নিছক দুর্ঘটনাজনিত কোনো অপপ্রচার নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত মনোযোগ বিচ্যুতি, যা ক্ষমতার বৃহত্তর কাঠামো ও রাষ্ট্রের ভূমিকা থেকে চোখ ঘুরিয়ে দেয়।
ঘটনার প্রেক্ষাপট :
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, হামলাকারীরা বাস থামিয়ে যাত্রীদের ধর্মীয় পরিচয় যাচাই করতে চেয়েছিল। যাঁরা হিন্দু বলে সাড়া দিয়েছিলেন, তাঁদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়। এটি একটি সুপরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, যেখানে ধর্মীয় পরিচয়কে আক্রমণের ভিত্তি করা হয়েছে। এই ধরণের ঘটনা ভারতের বহুসাংস্কৃতিক পরিবেশে শুধু আতঙ্কই সৃষ্টি করে না, বরং সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে গভীর করে তোলে।
কৌশলগত ব্যর্থতা থেকে সাম্প্রদায়িক দোষারোপে এই বয়ানের পরিবর্তন এক গভীর নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক সংকটকে সাম্প্রদায়িক সংঘাতে রূপান্তরিত করেছে। এতে হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনা বেড়েছে এবং ধর্মীয় বিভাজন আরও গভীর হয়েছে। প্রত্যাশিতভাবেই পাকিস্তান হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে, অন্যদিকে ভারত ইন্দাস জলচুক্তি স্থগিত করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে—যা প্রকৃত শান্তির পথে কোনো পদক্ষেপ না হয়ে বরং রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল হিসেবে দেখা যায়। পাকিস্তান একে "যুদ্ধ ঘোষণা" হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এদিকে মূলধারার সংবাদমাধ্যম গোয়েন্দা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রসঙ্গে নীরব থেকেছে, বরং জাতীয়তাবাদী বক্তব্যকে আরও জোরদার করেছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবল ক্ষোভ ও অপপ্রচার, যা প্রায়শই সাম্প্রদায়িক ঘৃণায় পরিণত হয়ে মুসলিমদের ওপর নির্দিষ্টভাবে আক্রমণ এবং সমষ্টিগত শাস্তির পরিবেশ তৈরি করছে।
“মুসলিম জঙ্গি”, “ইসলামী সন্ত্রাস” — এই পরিচিত লেবেলগুলো আবারও সক্রিয় হয়েছে, শুধু রাজনীতিক বা সংবাদমাধ্যমের মুখে নয়, বরং এমন একটি প্রভাবশালী বয়ানের মধ্যেও, যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পরিসরেই কাশ্মীরের সহিংসতাকে ব্যাখ্যা করে থাকে। পশ্চিমা এবং ক্রমবর্ধমান হারে ভারতীয় বয়ানেও এই পরিভাষাগুলো এতটাই গেঁথে গেছে যে, এর মাধ্যমে পুরো একটি সম্প্রদায়কে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং মাটির বাস্তব জটিলতা থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলা হয়। এই নির্মিত দৃষ্টিভঙ্গিতে কাশ্মীর আর একটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কেন্দ্র নয়; বরং তা হয়ে ওঠে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ’-এর প্রতীকী ক্ষেত্র, যেখানে একটি বহুমাত্রিক সংকটকে সরল, একতরফা গল্পে পরিণত করা হয়।
এই বয়ান রচনায় গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা এমন এক 'নির্মিত সম্মতি'র পরিবেশ গড়ে তোলে, যার মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ন্যায়বিচারের জটিল লড়াইগুলো চটজলদি শিরোনামে রূপান্তরিত হয়ে তাদের মূল সত্তা হারিয়ে ফেলে। এই কাঠামোর ভেতরে ইসলামকে কেবল ভুলভাবে উপস্থাপনই করা হয় না, বরং তাকে সক্রিয়ভাবে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইসলামি চিন্তাধারা, যা উপনিবেশবাদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বের অবক্ষয়কে সমালোচনার লেন্সে দেখে, তা জনপরিসরে প্রায়শই নির্বাক করে দেওয়া হয় কিংবা চরমপন্থার মুখোশ পরানো হয়।
ইসলামে মানবজীবনের মর্যাদা :
ইসলামে প্রতিটি মানবজীবন অত্যন্ত সম্মানের ও মূল্যবান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন—
مِنْ أَجْلِ ذَٰلِكَ كَتَبْنَا عَلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنَّهُ مَن قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا ۚ وَلَقَدْ جَاءَتْهُمْ رُسُلُنَا بِالْبَيِّنَاتِ ثُمَّ إِنَّ كَثِيرًا مِّنْهُم بَعْدَ ذَٰلِكَ فِي الْأَرْضِ لَمُسْرِفُونَ
“এ কারণেই আমি বনী-ইসলাঈলের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবাপৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে। তাদের কাছে আমার পয়গম্বরগণ প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছেন। বস্তুতঃ এরপরও তাদের অনেক লোক পৃথিবীতে সীমাতিক্রম করে”। (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩২)
এই আয়াতটি ইসলামি নীতির মৌলিক ভিত্তি রচনা করে। এখানে ধর্ম, জাতি বা পরিচয়ের কোনও ব্যতিক্রম নেই। কোনো ব্যক্তি মুসলিম হোক বা অমুসলিম— যদি সে নিরপরাধ হয়, তবে তার প্রাণ সংরক্ষণ ইসলামের দৃষ্টিতে অপরিহার্য দায়িত্ব।
ধর্মীয় সহনশীলতার শিক্ষা :
ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীলতা ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দেয়। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, মদিনা সনদে মুসলিম, ইহুদি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। নবী করীম (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় কখনো কারও ধর্মবিশ্বাসের কারণে আঘাত করেননি; বরং নিরাপত্তা দিয়েছেন, সহনশীলতা দেখিয়েছেন এবং তাদের অধিকার রক্ষা করেছেন।
নবী (সা.)-এর মানবিক আচরণ :
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ، وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ مَا نَهَى اللَّهُ عَنْهُ
“প্রকৃত মুসলিম সে-ই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে এবং প্রকৃত মুহাজির সে-ই, যে আল্লাহ্ তা’আলার নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করে”। (বুখারি)
এই হাদীসে ‘মুসলমান’ শব্দ থাকলেও তা সর্বজনীন মানবিকতাকেই নির্দেশ করে। ইসলামি শরীয়ত স্পষ্টভাবে বলেছে, কাউকে ভয় দেখানো, আঘাত করা বা হত্যা করা সর্বাংশে নিষিদ্ধ— সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম। সুতরাং যারা পাহেলগামের মতো হামলা চালায় এবং ইসলামের নামে তা বৈধতা দেয়, তারা ইসলামি নীতির সঙ্গে প্রতারণা করছে।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান :
ইসলাম কোনো অবস্থাতেই সন্ত্রাস, জবরদস্তি বা উগ্রতা সমর্থন করে না। যারা ইসলামকে হাতিয়ার করে নিরীহ মানুষ হত্যা করে, তারা আদতে ইসলামবিরোধী কর্মে লিপ্ত। তারা একদিকে যেমন নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে, অন্যদিকে ইসলাম ও মুসলমানদের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে।
একটি দুঃখজনক দিক হলো, এই ধরনের হামলার ফলে গোটা মুসলিম সমাজ সন্দেহের চোখে পড়ছে। অথচ, প্রকৃত মুসলমান কখনো সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয় না। মুসলমান মানেই সে একজন বিশ্বস্ত, শান্তিপ্রিয় এবং মানবিক ব্যক্তি।
কাশ্মীর সংকট ও মুসলিম নেতৃত্বের করণীয় :
কাশ্মীর বহু বছর ধরে রাজনৈতিক ও সামরিক অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। এই অস্থিরতা যেমন মানবিক সংকট তৈরি করেছে, তেমনি কিছু উগ্রপন্থী গোষ্ঠী এই অঞ্চলের অসহায়তাকে পুঁজি করে সহিংসতা ছড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মুসলিম নেতৃত্বের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। তাদের উচিত শান্তির বার্তা প্রচার করা, বিভ্রান্ত তরুণদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা এবং ইসলামি মূল্যবোধের প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া।
ধর্মীয় পরিচয়ে আক্রমণ ইসলামের দৃষ্টিতে ঘৃণ্য :
যে কেউ কেবলমাত্র তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে আক্রমণের শিকার হবে— এটা ইসলামিক ভাবনায় সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। নবী করীম (সা.) নিজে কখনো কারও ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ছড়াননি। ইসলাম বলে, “তোমার ধর্ম তোমার জন্য, আমার ধর্ম আমার জন্য।” এটি একটি সহাবস্থানের ভিত্তি, যা পাহেলগাম হামলার মত ঘটনাকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
ভারতের মুসলিম সমাজের দায় :
ভারতের মুসলমানদের উচিত এই হামলার বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ জানানো। যখন কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইসলামের নাম ব্যবহার করে নৃশংসতা চালায়, তখন মুসলিম সমাজের দায়িত্ব হয় তা প্রত্যাখ্যান করা এবং স্পষ্ট করে বলা— এই কাজ ইসলামি শিক্ষার পরিপন্থী। সমাজ, গণমাধ্যম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকৃত ইসলাম প্রচার করতে হবে, যাতে উগ্রতা আর অপব্যাখ্যা স্থান না পায়।
উপসংহার :
পাহেলগাম হামলার মতো ঘটনার নিন্দা করাটা কেবল মানবিক কর্তব্য নয়, বরং ধর্মীয় দায়িত্বও। ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যেখানে একজন অপরিচিতকেও অভুক্ত রেখে নিজে খাওয়া নৈতিকভাবে অনুচিত। সেখানে কীভাবে এই ধর্মের নামে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করা হতে পারে?এটি ইসলাম নয়, বরং ইসলামের নামে চালানো ষড়যন্ত্র। মুসলিম সমাজকে এখনই সচেতন হতে হবে, ইসলামকে অপব্যবহারের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে এবং বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামের মানবিক রূপ তুলে ধরতে হবে। কেবল তবেই শান্তি, সহনশীলতা ও সৌহার্দ্যের পথ সুগম হবে।
এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা আরেক দফা প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষোভ বা পুরনো বুলি নয়; বরং এমন এক সত্য-অনুসন্ধান, যা সহিংসতার এই চক্রকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্যকারী বয়ান ও কাঠামোগুলোর সঙ্গে সরাসরি মোকাবিলা করতে পারে। কাশ্মীরের মানুষ, যারা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয়তাবাদ ও বৈশ্বিক উদাসীনতার মাঝে বন্দি, তাদের শুধু বলির পাঁঠা বানানো বা নীরব করে দেওয়া নয়, বরং মর্যাদা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং এমন একটি অধিকার পাওয়া উচিত—যার মাধ্যমে তারা ভয়ের নয়, বরং ন্যায়বিচারের প্রিজমে দেখা পায়।
এই সংগ্রামের জটিলতাকে পুনরুদ্ধার করে এবং প্রচলিত আধিপত্যশীল বয়ানগুলোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে তবেই আমরা কল্পনা করতে পারি এক ভিন্নতর, মানবিক ভবিষ্যৎ—যেখানে কাশ্মীর আর একটি জায়গামাত্র নয়, বরং একটি মানুষের কণ্ঠ, ইতিহাস, এবং অধিকারের দাবিতে অনড় অবস্থান।