ফিলিস্তিন প্রশ্নে পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক কপটতা উন্মোচিত

তথাকথিত পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী দল বিভ্রান্ত জ্ঞানতত্ত্বের বশীকরণ ব্যবহার করে সম্পূর্ণ মানবজাতির ওপর যে শ্রেষ্ঠত্ব ও হীনমন্যতার (superiority and inferiority) মুখোশ চাপিয়ে রেখেছে তা প্রতিপক্ষ দ্বারা বার বার অনাবৃত যদিও বৈশিক স্তরে চূড়ান্ত প্রভাব তৈরী করতে অসক্ষম। কিন্তু আজ উপনিবেশবাদের জন্মদাতা বেশ কয়েক পশ্চিমা দেশগুলির সমর্থিত ইসরায়েলি আধুনিক ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা হাজার হাজার ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যা তাদের মিথ্যা শ্রেষ্ঠতার যথা মানবিকতার দাবি নাকচ করে দেয়।    

মনুষ্যতের ওপর এই শ্রেষ্ঠত্ব ও হীনমন্যতার রেখা মুছে ফেলা আবশ্যিক। নচেৎ স্ব-দাবীকৃত শ্রেষ্ঠত্বের আড়ালে, এই জ্ঞানতত্ত্ব ইতিহাসে যেমন উন্মুক্ত উপনিবেশবাদ সৃষ্টি করেছিল ঠিক তেমনই বর্তমানে অদৃশ্য নব্য-সাম্রাজ্যবাদ (neo-imperialism) পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। শুধু আকৃতি এবং শব্দের পরিবর্তন, কর্ম একই থাকে - উদাহরণস্বরূপ, সংস্কার নাম পেয়েছে উন্নয়নের এবং বর্বরতা সন্ত্রাসবাদের যা তাদের বৈধতার সনদ প্রদান করে।  আকৃতি হয়েছে একটি শারীরিক সামরিক প্রতিষ্ঠা ছাড়াই রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক আধিপত্য গড়ে তোলা যেখানে ইতিহাসের উপনিবেশবাদে বিদেশী ভূখণ্ড অধিগ্রহণ করে সেখানে সেটেলমেন্ট তৈরী করা হত। (অবশ্যই এই কর্ম বতমানেও অনেক স্থানে অব্যাহত।)

শ্রেষ্ঠত্ব ও হীনমন্যতার উৎপত্তি 

পশ্চিমা তত্ত্বে এই ভয়ঙ্কর তত্ত্বের গর্ভধারণ শুরু হয় ১৫-১৬ শতকের পর ইউরোপে বুদ্ধিবৃত্তিক বিচ্যুতির অনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণের ফলে। ১৫ শতক পূর্বের ইউরোপীয় সমজ যাকে ইতিহাসবীদরা ডার্ক এইজ (Dark Age) বলে থাকে দারিদ্রতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, ধর্মীয় নির্যাতন, রাজকীয় কর্তৃত্ববাদ, কৃষক ও শ্রমিক শোষণ, নারী অমানবিককরণ এবং অন্যান্য অযৌক্তিকতায় ভর্তি ছিল। এইসব প্রতিষ্ঠিত অসঙ্গতি নিয়ে হতাশ হয়ে তখনকার পন্ডিতরা সমাধানসূত্র হিসাবে তাদের বিরোধী তত্ত্ব প্রদান করতে থাকে।  সমাজ একেবারে দুই চরম অবস্থানে পৌঁছায়। অবশেষে, যখন বিরাট শিল্প বিকাশ, অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক সফলতা এবং নাটকীয় জীবনধারার পরিবর্তন দেখা যায়, তারা এই প্রক্রিয়াটিকে বিশ্বের অন্যান্য অংশে প্রতিলিপি করতে শুরু করে। 

আরামকেদারাধারী চিন্তাবিদরা প্রমাণীকরণ করতে থাকে যে এটি সামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। আমরা এখন আমাদের শৈশবকে অতিক্রম করে আদর্শ সভ্যতায় পৌঁছেছি। বিশ্বের অন্যান্য অংশের অবস্থাও অনুরূপ। পশ্চিমার উন্নতি অর্জন করতে হলে যে কোন সামাজিক এবং পরিবেশগত নিয়মকে অতিক্রম করতে হবে।  তারা দাবি করে  সংস্কৃতি, ধর্ম, জাতিসত্তা, শিল্পকলা, সাহিত্য এবং সভ্যতার অন্যান্য সকল দিক বিবেচনায় পশ্চিমারা উন্নত। বিপরীতে অবশিষ্ট সকলকেই নিকৃষ্ট এবং অসভ্য হিসাবে চিহ্নিত করে। এখানেই শেষ নয়, জোর করে হলেও তারা তাদের বিকাশের নিয়মগুলি অন্য বিশ্বে প্রয়োগ করতে শুরু করে। আর এই সংস্কারে অজুহাতে শুরু হয় ঔপনিবেশিকতা। 

আসলে এর উৎপত্তি পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির সঙ্গে ঘটে।  সর্বপ্রথম চার্লস ডারউইন বিবর্তন তত্ত্বের (Evolution Theory) মাধ্যমে প্রমান করার চেষ্টা করে যে অন্যান্য জৈবিক প্রজাতির মতো, মানুষও প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিছু আদিম পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে। যাইহোক, পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের দ্বারা জীববিজ্ঞানের বাইরে অন্যান্য উন্নয়নের সাথে ডারউইনবাদ (Darwinism) এই তত্ত্বটি মিলিয়ে দেওয়া হয়। (কিছু বিশেষজ্ঞদের এমনও মতামত আছে যে এই বিপজ্জনক তত্ত্বটি হিটলারের নাৎসিবাদের (Nazism) উপর এক স্পষ্ট প্রভাব ফেলেছিল যা নর্ডিক জাতিকে (Nordic race) অন্যান্য জাতিগুলির থেকে উচ্চতর হিসাবে দেখে এবং ফলস্বরূপ হাজার হাজার ইহুদিদের হত্যা করা হয়।) যাইহোক, এই ডারুইনবাদে প্রভাবিত হয়ে হার্বার্ট স্পেন্সর মহাবিশ্ব, দর্শন এবং অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিবর্তন তত্ত্ব প্রয়োগ করেন। তারপর এডওয়ার্ড বার্নেট টাইলর তাঁর প্রিমিটিভ কালচার (Primitive Culture) গ্রন্থে সাংস্কৃতিক বিবর্তন ধারণাটিকে আরও দৃঢ় করে তুলে ধরেন। অনুরূপ পশ্চিমা মনস্কতারও বিবর্তন ঘটে? তাঁর মত অনুযায়ে, সমস্ত সংস্কৃতি তিনটি ক্রমিক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে: অসভ্যতা, বর্বরতা এবং অবশেষে, সভ্যতা (savagery, barbarism and civilization)। পশ্চিমারা এখন সভ্যতার পর্যায়ে আর অন্যরা অবশিষ্ঠ দুইয়ের যে কোন একে। 

প্যালেসটিন প্রাসঙ্গিক 

যাইহোক, তাদের ঔপনিবেশিক স্বার্থ বিশ্বের অনেক অংশ বিশেষ করে মুসলিম অঞ্চল আফ্রিকা, আরব বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে থেকে বেশ শক্তিশালী প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। তাছাড়া তাদের ক্রুসেডে অপমানের কথা খুব ভালো মনে আছে। ইসলামের এই প্রতিরোধী চেতনা পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠে। তাছাড়া, সভ্যতার সংঘর্ষের (Clash of Civilizations) মতো বিভাজনমূলক তত্ত্ব আসতে শুরু করে। এই সব তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই আজ প্রায় সব পশ্চিমা শক্তি মানবতা বিরোধী ইস্রাইলি নৃশংসতাকে সমর্থন জানাচ্ছে। অর্থাৎ, মানবিকতার মুখোশে তাদের উপনিবেশিক কপটতা বা দ্বিচারিতা প্রকাশ পাচ্ছে।

তবুও, দুঃখের বিষয় বিশ্ব বুদ্ধিজীবীদের এই উপলব্ধি হতে আজ প্রায় ২৮,০০০ উর্ধে ফিলিস্তিনি জনসাধারণ - মহিলা, বৃদ্ধ, শিশু কেউ বেতিক্রম নয় - ইস্রাইলি আক্রমণে দিন আলোতে প্রাণ হারাচ্ছে (শুধু মাত্র গত চার মাসে)। সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এই সংঘর্ষে গাজায় ১০০ জনের মধ্যে একজন নিহত হয়েছে। কি ভয়াবহ! আল-জাজীরা অনুসারে ১৩ ফেব্রুয়ারু অবদি ১২,১৫০ শিশু এবং  ৮,৩০০ জন মহিলা হত্যা হয়েছে। 

ফিলিস্তিনে ৩৬৫ কিলোমিটার ববর্গক্ষেত্রের ছোট এলাকা গাজা ভূখণ্ডের এক এক শহর ইস্রাইলি রকেট হামলায় ধ্বংস হয়ে বসবাসযোগ্যহীন হয়ে পড়েছে। আশ্রয়হীন জনসাধারণ মিসাইলের তাড়ায় এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পালাচ্ছে, কিন্তু সেখানেও রেহাই নেয়।  মিশর বর্ডার লাগা শেষ শহর রাফাহ পর্যন্ত ইস্রাইলি সেনা রকেট ছুড়ছে।  ফিলিস্তিনি মানুষের জন নিজ মাতৃভূমিই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। সামনে মিশর বর্ডার, বাঁয়ে নূনা ভূমধ্যসাগর, পিছনে ইস্রাইলি রকেট আর ধ্বংসস্তূপে বাড়ি ঘর, সুম্পূর্ণ শহর - হাসপাতাল, স্কুল কিছুই বাকি নয়।    

মানব সভ্যতার তথাকথিত ভূমি ইউরোপে কোনো সুরক্ষা খুঁজে না পেয়ে লাখ লাখ ইহুদি প্যালেস্টাইনে আশ্রয় চায়। তারা স্বাগত ছিল। কিন্তু, ইহুদিবাদে (Zionism) অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৪৮ সালে তারা ইস্রায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব মাতৃভূমিতে নিজ অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। বলা বাহুল্য, তথাকথিত শান্তির দাবীদার ব্রিটেন এবং অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি ইহুদি ও ফিলিস্তিনি আরব মুসলমানদের মধ্যে এই সংঘর্ষের আগুনদানকারী হিসেবে কাজ করে। 

তারপর নিজস্ব জনগণের জন্য পূর্ণাঙ্গ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে আন্দোলন গতি পায়। নাক্বা ১৯৪৮-৪৯, সুয়েজ সংকট (১৯৫৬), ছয় দিনের যুদ্ধ (১৯৬৭), ১৯৭৩ আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধ, লেবানন যুদ্ধ (১৯৮২), প্রথম ইন্তিফ়াদা (১৯৮৭-১৯৯৩), দ্বিতীয় ইন্তিফ়াদা (২০০০-২০০৫), গাজা যুদ্ধ ইত্যাদি এই স্বভূমি স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু উল্লেখযোগ্য মূহর্ত। এর মধ্যে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত এবং আশ্রয়হীন হয়েছে, আবার অনেকেই  তাঁর সন্তান হাতে স্বাধীনতার ধ্বজ অর্পণ করে সর্বকালের জন্য বিদায় নিয়েছে।    

পশ্চিমা বুদ্ধিতত্ত্বের বশীকরণে ধৃত বিশ্ববাসী নীরবতায় দর্শন করছে।  অবশই অনেকেই এই বশীকরণ থেকে মুক্ত হয়ে সত্য ও ন্যায়ের নিমিত্তে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছে। তাছাড়া, এই বাস্তবতা এখনও যদি কপটে থেকে যায়, ভবিষ্যতের ইতিহাস অবশই মনে রাখবে।  

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter