বিলকিস বানু: ন্যায়ের অদম্য সংগ্রাম
মার্চ ৩, ২০০২ সালে গুজরাটের আহমেদাবাদ শহর পার্শবর্তী রান্ধিকপুর গ্রাম থেকে পাঁচ মাস গর্ভবতী ২১ বছর বয়সি বিলকিস বানু যখন গোধরার সব্রামতি ট্রেন দুর্ঘটনার পর ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গার আঁচ থেকে প্রাণ বাঁচাবার জন্য তার ৩ বছরের মেয়ে, স্বামী এবং অন্যান্য পরিবারের সাথে পালাচ্ছিল তখন পশু হিংস্র ২০-৩০ দুষ্কৃতীর দল কাস্তে, তলোয়ার ও লাঠিসোঁটা নিয়ে বিলকিস ও তার পরিবারের ওপর হামলা চালায়। তার ওপর অসহনীয় যৌন নির্যাতন হয়। বিলকিস, তার মা এবং আরও তিন নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হন, যদিও তার পরিবারের অন্য ছয় সদস্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বিলকিস অশ্রুপূর্ণ আর্তনাদ করা সত্ত্বেও এই অত্যাচারীরা তাকে রেহাই দেয়নি। ঘটনাক্রমে তিন বছরের মেয়ে সমেত কয়েক জন পরিবার সদস্য মারা যায়। এই নিশৃংশকা সাধারণ মনে এক বিরাট শ্রীহরণ সৃষ্টি করে। উদ্বর্তী বিলকিস বিচারের দাবিতে দিন গুনতে থাকে। আজ প্রায় ২১ বছর পেরিয়ে ২০২৪ সাল।
প্র্রথমে তো স্থানীয় পুলিশ বিলকিস বানুর মামলা প্রযাখ্যান করে। কিন্তু অটলভাবে স্থির বানু ন্যায়ের তলবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (NHRC) নিকটবর্তী হয়। অবশেসে বিচারের দাবিতে তিনাকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে দ্বারস্থ হতে হয়। ঘটনার গম্ভীরতা বিবেচনা করে, সুপ্রিম কোর্ট সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (CBI)-কে এই বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দেয়।
২০০৪ প্রথম জানুয়ারীতে সিবিআই ডিএসপি কেএন সিনহা গুজরাট পুলিশের কাছ থেকে তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৪, ১৯ এপ্রিলে সিবিআই চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদাবাদের কাছে ছয় পুলিশ কর্মকর্তা এবং দুই চিকিৎসক সহ ২০ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করে। কিন্তু পরে পরেই রাজ্যে প্রমাণের সাথে সম্ভাব্য কারচুপির প্রবণতা থাকায় মামলাটিকে গুজরাট থেকে বোম্বে হাই কোর্টে স্থানান্তর করা হয়।
এবার মামলা শুরু হয় বোম্বে হাই কোর্টে। লম্বা চার বছর অপেক্ষার পর ২১ জানুয়ারি ২০০৮-এ আদালতের সিদ্ধান্ত আসে - হত্যা, ধর্ষণের দায়ে ১১ জন অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি ৭ জনের মুক্তি। (তাছাড়া মামলা চলাকলীন দুজনের মৃত্যু হয়ে যায়।) যদিও দেরিতে, বিশেষ করে বিলকিস বানু এবং দেশের সহস্র নির্যাতিত নারীর জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের পর আদালতের এই রায় একটি দীর্ঘশ্বাস এবং স্বস্তির লক্ষণ হয়ে দাঁড়ায়।
এর পরও ২০০৯, ২০১১, ২০১৬ এবং ২০১৭ অবদি সিবিএই, হাই কোর্ট, অভিযুক্ত, বিলকিস বানু নিয়ে বিভিন্ন বিচার চলতে থাকে। যাইহোক, এই সকল ক্ষেত্রে বম্বে হাইকোর্ট পূর্বের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা বহাল রাখে। অনুরূপ, বাকি অভিযুক্তদের জন্যেও শাস্তি বাড়াতে অস্বীকার করে।
২০১৭ মামলা আবার কেন্দ্রের সুপ্রিম কোর্টে আসে। ২০১৯ পর্যন্ত বিভিন্ন রায়ের আদান প্রদান হয়। কোর্ট বিলকিস বানুর জন্য ক্ষতিপূরণেরও আদেশ দেয়। ২০১৭-এর এক রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বোম্বে হাইকোর্টের সিদ্ধান্তে বিরুদ্ধে দুই ডাক্তার এবং চার পুলিশ সদস্যের আপিল খারিজ করে দেয়।
২০২২ মে মাসে দোষী রাধেশ্যাম শাহ গুজরাট হাইকোর্টের ১৭ জুলাই, ২০১৯ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে। কোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ গুজরাট সরকারকে শাহের অকাল মুক্তির আবেদন বিবেচনা করার আদেশ দেয়। ফলতঃ ২০২২, ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবসে রাধেশ্যাম সহ ১১ জন অভিযুক্তদের গুজরাট সরকার দ্বারা গোধরা সাব-জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
স্বাধীনতার দ্বিবস মনে হয় বানুর জন্য আবার অন্ধকার হয়ে যায়। অন্যদিকে, অমানবিক প্রবেশের বিভিন্ন মঞ্চে মুক্তিপ্রাপ্ত আসামিদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়। কিন্তু নিরলস সংগ্রামী এখনও আশাবাদের শিখা দেখে। বিলকিস বানু আবার সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারে টোকা দেন। গত ৮ জানুয়ারী সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারের রেহাই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে এবং রাজ্য সরকারে বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে। আবার স্বাধীন হয়ে স্বাধীনতা উজ্জাপন করবে বিলকিস বানু এবং দেশের নারীত্ববাদ। কিন্তু খবর কাগজে আবার ধোঁয়াশা দেখা যাচ্ছে - ১১ আসামির মধ্যে ৯ জন নিখোঁজ!
পরিষ্কার যে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা আবেদনকারীকে বছরের পর বছর দৌড়াচ্ছে। বিচার ব্যবস্থাকে আরও বাস্তবসম্মতভাবে মেরামত করা চায় যাতে ন্যায়বিচারের ভারসাম্য বজায় থাকে। বিলিকিস বানু নারী অধিকারের অমর প্রতীক হয়ে দাঁড়ান যা তথাকথিত সোচ্চার নারীবাদীরা দেখায় না।