চব্বিশের হজ্ব যাত্রা আর নজিরহীন ঘটনা: এক পর্যালোচনা 

সম্প্রতি মুসলিমদের এক বৃহৎ উৎসব ও তীর্থ যাত্রার মাস চলে গেল। মাসটি হলো আরবি ক্যালেন্ডার এর জিলহজ্ব মাস। যেই মাসে সারা বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায় তাঁদের স্মরণীয় উৎসব যা ঈদুল আযহা নামে জানা যায়। আর এই মাসেই তীর্থ যাত্রীরা তাঁদের অপরিহার্য মূলক কর্ম পূরণের উদ্দেশ্যে মক্কা ও মদিনার রওনা দেয়। এটি মুসলিমদের পাঁচ ঈমানী স্তম্ভের একটি। আর যতসব প্রক্রিয়া রয়েছে সব পূরণ করে খেতাব পান ‘হাজী’। 
এক সময় ছিল যখন হজ্ব যাত্রীরা কেউ পায়ে হেঁটে তো কেউ পশুর উপর চড়ে নয়তো কেউ আবার জল জাহাজে সওয়ার করে পৃথিবীর বিভন্ন কোণ থেকে এসে হাজির হতেন মক্কা ও মদীনায় । ধীরে ধীরে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে যাত্রার পরিবহন পদ্ধতিতেও বদল এসেছে। যেমন পায়ে হেঁটে থেকে পশু পরিবহন শেষ হয়ে আসে জল জাহাজ তেমনই জল জাহাজ থেকে রূপান্তরিত হল উড়ো জাহাজে যা এয়ার প্লেন বা ফ্লাইট নামে পরিচিত। 
মহান প্রভুর আদেশ মানতে আর তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্য সারা জীবন যথেষ্ট টাকা কড়ি সঞ্চয় করে জীবনের শেষ কালে বের হয় হজ্জের উদ্দেশ্যে। আমাদের গ্রাম বাংলা ও দক্ষিণ উপমহাদেশের এক রেওয়াজ বা প্রথা চলে আসছে যে হজ্জে রওনা দেওয়ার আগে আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো আর তাদের কাছে শেষ মাফের আদান প্রদান করা। আর তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকায় থাকে এক অবাক করা জিনিস সেটি হলো তাদের কবরের সঙ্গী অর্থাৎ দাফনের কাফন, কারণ অনেকেই বড়ো আশা করে যায় যে মক্কায় যেনো তার মৃত্যু হয়। কিন্তু এই বছর হজ্ব যাত্রীদের নিয়ে সারা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি হয় কারণ এই বছর অসহ্য তাপমাত্রা আর বিভিন্ন কারণের  ফলে হাজারের অধিক হজ্ব যাত্রীদের ইন্তেকাল করেন।

আসুন হজের গুরুত্ব ও ফযীলত কুরআন ও হাদীস দ্বারা জানা যাক:

কুরআন 
"وَلِلّٰہِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡہِ سَبِیۡلًا ؕ وَمَنۡ کَفَرَ فَاِنَّ اللّٰہَ غَنِیٌّ عَنِ الۡعٰلَمِیۡنَ"

বঙ্গানুবাদ: আর এই ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য; যার সামর্থ্য রয়েছে বাইতুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে এটা অস্বীকার করবে—আল্লাহ বিশ্বজগতের সবকিছু থেকে অমুখাপেক্ষী। (সুরা আল ইমরান, আয়াত :৯৭) 
"وَاَذِّنۡ فِی النَّاسِ بِالۡحَجِّ یَاۡتُوۡکَ رِجَالًا وَّعَلٰی کُلِّ ضَامِرٍ یَّاۡتِیۡنَ مِنۡ کُلِّ فَجٍّ عَمِیۡقٍ"
বঙ্গানুবাদ: মহান আল্লাহ তাআলা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আরো ইরশাদ করেন, আর মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা করুন। তারা আপনার কাছে আসবে দূর-দূরান্ত থেকে পদযোগে ও সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে আরোহণ করে। (সুরা হজ, আয়াত:২৭)
এই আয়াতের মধ্যে সামর্থ্য বলতে শারীরিক ও আর্থিক উভয় ধরনের সামর্থ্যকে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং, সামর্থ্যবান হলে সব ধরনের বাধা-বিপত্তি, দ্বিধা-সংশয় ও ভ্রান্ত ধারণা ছেড়ে দিয়ে অনতিবিলম্বে হজ আদায় করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য বাঞ্ছনীয়।
হাদীস 
হজের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলতে গিয়ে প্রিয় নবী (স.) ইরশাদ করেন, তোমরা ফরজ হজ আদায়ে বিলম্ব কোরো না। কেননা, তোমাদের জানা নেই, পরবর্তী জীবনে তোমরা কী অবস্থার সম্মুখীন হবে। (মুসনাদে আহমদ :২৮৬৭)  আর সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও যারা হজ্ব না করে মারা যায়, বিচার দিবসের একমাত্র সুপারিশকারী মহানবী (স.) তাদের ব্যাপারে অত্যন্ত শক্ত মনোভাব পোষণ করেছেন। মহানবি (স.) ইরশাদ করেন, সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও যে হজ না করে মারা যায়, সে ইহুদি হয়ে মারা যাক বা খ্রিষ্টান হয়ে মারা যাক, তাতে আমার কোনো পরোয়া নেই। (তিরমিজি :৮১২) দ্বিতীয় হাদিসটিতে হজের প্রয়োজনীয়তা কতটা তা স্পষ্ট।

হজ্ব অবস্থায় মৃত্যু
হজের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা এক দুঃখ নয় বরং এটা সৌভাগ্য। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম হাদীস শরীফে ইরশাদ করেছেন:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وسلم :
مِنْ خَرَجَ حَاجًّا فَمَاتَ كُتِبَ لَهُ أَجْرُ الْحَاجِّ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ خَرَجَ مُعْتَمِرًا فَمَاتَ كُتِبَ لَهُ أَجْرُ الْمُعْتَمِرِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ خَرَجَ غَازِيًا فَمَاتَ كُتِبَ لَهُ أَجْرُ الْغَازِي إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ
 (5467 المعجم الأوسط للطبراني)

বঙ্গানুবাদ: যে ব্যক্তি হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হয়ে মৃত্যুবরণ করবে, তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত হজের সওয়াব লেখা থাকবে। যে ব্যক্তি ওমরার উদ্দেশ্যে বের হয়ে মারা যাবে, তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত হজের সওয়াব লেখা থাকবে। যে ব্যক্তি জিহাদ উদ্দেশ্যে বের হয়ে মারা যায়, তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত জিহাদের সওয়াব লেখা থাকবে।

আর এক হাদীসে বর্ণিত রয়েছে: হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমরা মহানবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে এক সফরে ছিলাম। সে সময় ইহরাম অবস্থায় এক ব্যক্তি হঠাৎ উটের পিঠ থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙে মারা যায়। ফলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা সিদ্ধ পানিতে কুল গাছের পাতা দিয়ে তাকে গোসল দাও এবং তাঁর ইহরামের কাপড় দু’টি দিয়ে কাফন দাও। তবে তার শরীরে সুগন্ধি লাগাবে না এবং তার মাথা ঢাকবে না। কেননা কেয়ামতের দিন তাকে (ইহরামকারী মৃতব্যক্তিকে) তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় ওঠানো হবে। (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)

২৪ এর হজে মৃত্যুর কারণসুমূহ 
এবছরের হজ যাত্রীদের মৃত্যু সহজে কমিটিকে রিপোর্ট অনুযায়ী ১৩০১। আর এই মৃত্যুকে নিয়ে সারা বিশ্বে কটুক্তির তোলপাড় হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে অমুসলিমরা এই ঘটনাকে উক্ত করে বিভিন্ন খারাপ মন্তব্য ও অপব্যাখ্যা করে চলেছে। 
বিবিসি রিপোর্ট অনুযায়ী কারণ হতে পারে
 ১.প্রচণ্ড গরম
সৌদি আরবে নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ উচ্চ মৃত্যুর পিছনে একটি বড় কারণ বলে মনে করা হয়।৫০° বেশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাপের এক্সপোজার এড়াতে এবং হাইড্রেটেড থাকার জন্য সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সতর্কতা সত্ত্বেও, অনেক তীর্থযাত্রী তাপ চাপ এবং হিটস্ট্রোকের শিকার হয়েছেন। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের নিউজডে-তে নাইজেরিয়ান তীর্থযাত্রী আইশা ইদ্রিস বলেন, "শুধু ঈশ্বরের রহমতে আমি বেঁচে গিয়েছিলাম, কারণ এটি ছিল অবিশ্বাস্যভাবে গরম।”

২.অতিরিক্ত ভিড় এবং স্যানিটেশন সমস্যা
বিভিন্ন বিবরণ অনুসারে, সৌদি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা চরম পরিস্থিতিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে, যার ফলে হজযাত্রীদের জন্য মনোনীত অনেক এলাকায় সংকট দেখা দিয়েছে। তারা বলে যে আবাসন এবং সুবিধাগুলি খারাপভাবে পরিচালিত হয়েছিল, ভিড়ের তাঁবুতে পর্যাপ্ত শীতল এবং স্যানিটেশন সুবিধার অভাব ছিল। আমিনা (তার আসল নাম নয়), ইসলামাবাদের একজন 38 বছর বয়সী, বলেছেন: "মক্কার গরমে আমাদের তাঁবুতে কোনও এয়ার কন্ডিশনার ছিল না। যে কুলারগুলি বসানো হয়েছিল তাতে বেশিরভাগ সময় জল ছিল না।

৩.পরিবহনে সমস্যা
তীর্থযাত্রীদের প্রায়শই তীব্র গরমে দীর্ঘ দূরত্বে হাঁটতে বাধ্য করা হয়, কিছু রাস্তার প্রতিবন্ধকতা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে। একটি বেসরকারি গ্রুপের হজ সংগঠক মুহাম্মদ আছা বলেন, গ্রীষ্মকালে একজন সাধারণ হজযাত্রীকে প্রতিদিন অন্তত ১৫ কিলোমিটার হাঁটতে হতে পারে। এটি তাদের হিটস্ট্রোক, ক্লান্তি এবং উপলব্ধ পানির অভাবের মুখোমুখি হয়, "এটি আমার ১৮তম হজ, এবং আমার অভিজ্ঞতায়, সৌদি নিয়ন্ত্রকরা সাহায্যকারী নয়। তারা নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু তারা সাহায্য করে না," তিনি বলেছিলেন।

৪.অনথিভুক্ত হজ্বযাত্রা
হজ পালনের জন্য, একজন হজযাত্রীকে একটি বিশেষ হজ ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। কিন্তু কিছু ব্যক্তি যথাযথ নথিপত্র ছাড়াই পাঁচ দিনের তীর্থযাত্রায় যাওয়ার চেষ্টা করে, যদিও সৌদি কর্মকর্তারা ক্র্যাক ডাউন করার চেষ্টা করে। যথাযথ ডকুমেন্টেশন ছাড়াই তীর্থযাত্রীরা প্রায়ই কর্তৃপক্ষকে এড়িয়ে চলে, এমনকি যখন তাদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়।
 
৫.বয়স্ক এবং অসুস্থ হজ্বযাত্রী
আর একটি কারণ হজে প্রতি বছর অনেক মৃত্যু হতে পারে তা হল অনেক হজযাত্রী সারা জীবনযাপন করার পর আবার কেউ সারা জীবন হজের জন্য টাকা করে সঞ্চয় করে তাদের জীবনের শেষ দিকে হজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

উপসংহার 


হজ্ব যখন ঈমানের একটি স্তম্ভ তখন ঈমান পূর্ণ করতে সমর্থ্য অনুযায়ী মক্কা ও মদিনার দিকে রওনা দিতেই হবে। আরে প্রাচীন যুগ থেকে এই যাত্রার মধ্যে বিভিন্ন কষ্টও সহ্য করে এসেছেন। আজ তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় সে কষ্ট অবনতি হলেও অন্য কষ্টে সম্মুখীন হতে হয়। আর কখন মৃত্যুও হতে পারে, কিন্তু এই মৃত্যু দুঃখ নয় বরং মহা সৌভাগ্য। যেটি হাদিস হতে প্রমাণিত। এই বছর ২০২৪ এর হজ যাত্রায় প্রায় হাজারের অধিক মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু এই মৃত্যুর কারণ অধিকাংশ হজ কমিটির গাফিলতির ফল। কোথাও ফ্যাসিলিটি দেওয়াতে ব্যর্থ আবার কোথাও ম্যানেজমেন্টের কমতি।কিন্তু সারা বিশ্বে অমুসলিমরা অপব্যাখ্যা দিয়ে হজ্ব যাত্রাকে আর ইসলামের প্রতি বদনামের চক্রান্ত করছে। কিন্তু তারা মূল কারণ ছেড়ে প্রশাখা কারণ গুলোকে মূল বানায়। হজ্ব যাত্রা অবস্থায় মৃত্য কোনো দুঃখের বিষয় নয় বরং এক মহা সৌভাগ্যের বিষয়।

তথ্যসূত্র:


১. আল-কুরআন  শরীফ 
২. হাদীস শরীফ 
৩. The Guardian (Journal) 
France-Presse, Agence. 2024. “More than 550 Hajj Pilgrims Die in Mecca as Temperatures Exceed 50C.” The Guardian, June 18, 2024, sec. World news. https://www.theguardian.com/world/article/2024/jun/18/hundreds-of-hajj-pilgrims-die-in-mecca-from-heat-related-illness?CMP=Share_AndroidApp_Other.
৪. BBC 
Fatima, Zahra . 2024. “What’s behind Deaths at This Year’s Hajj Pilgrimage in Saudi Arabia?” Www.bbc.com. June 22, 2024. https://www.bbc.com/news/articles/c3ggj0809dqo.

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter