ইসলামের নির্দেশিত ব্যবসা বাণিজ্যের সঠিক পথ

ইসলাম এমন একটি সর্বজনীন জীবনধারা যা সৃষ্টিজগতকে সমস্ত দিক থেকে নির্দেশনা প্রদান করেইসলাম মানুষকে ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক তার জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে সঠিক পথ নির্দেশনা করেইসলামের শিক্ষাগুলি মানবতার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ মানদণ্ড প্রদান করে যা সমস্ত সময়ের জন্য প্রযোজ্যমহান আল্লাহ বলেন,

ومَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ

"আর আমরা কিতাবে কোনো কিছুই বাদ দেইনি।" (Al-Quran, 6:38)

ব্যবসা-বাণিজ্য জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশএটি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক কল্যাণের জন্য অপরিহার্যইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে একটি সম্মানজনক পেশা হিসেবে বিবেচনা করে এবং সম্পর্কে সুস্পষ্ট উত্তম নির্দেশনা প্রদান করে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ বলেন,

الْحَلَالُ بَيّن وَالْحَرَامَ بَيِّن وَبَيْنَهُمَا مُشَبّهَاتٌ

"হালাল স্পষ্ট, হারাম স্পষ্ট, আর তাদের মধ্যে রয়েছে সন্দেহজনক বিষয়।"

ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হালাল হারামকে বিবেচনায় রেখে ব্যাবসা করা উচিতহালাল হারামের অর্থ হল বৈধ অবৈধ অর্থাৎ যেসব বিষয়কে কুরান হাদিসে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে তা বৈধ আর যেসবকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলি অবৈধ এবং কঠোরভাবে নিষিদ্ধসমাজের বিষয়বস্তুকে হালাল হারাম বলে পৃথক করে দেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হল মানবসমাজের কল্যাণ তথা সমস্ত মানুষের যাতে ব্যাবসা বাণিজ্য দ্বারা উপকার হয় সেই উদ্দেশ্যয়েই হালাল হারামের পৃথকীকরণ। 

কিন্তু বর্তমান সমাজে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা সম্পর্কে মানুষের সঠিক জ্ঞান না থাকায় হালাল-হারামের বিষয়টি একেবারে উপেক্ষিত হচ্ছেআর কিছু লোভী ব্যবসায়ী দ্রুত ধনী হওয়ার আশায় বিভিন্ন অনৈতিক অবৈধ কর্মকাণ্ড নির্দ্বিধায় করে যাচ্ছেতারা প্রতারণা, কম ওজন, কালোবাজারি, ভেজাল, মিথ্যা শপথ ইত্যাদির মাধ্যমে এক অত্যন্ত অনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেএর কারণে কিছু মানুষের ভাণ্ডারের ধন উপচে পড়ছে তো কিছু লোকের তাদের দ্বারা শোষিত দারিদ্র্যতা এত বেড়ে যাচ্ছে যে সময়মত খাবারের জন্য তাদেরকে দুশ্চিন্তায় ডুবতে হচ্ছেব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলাম এই সব বিষয়কে হারাম ঘোষণা করেছে। 

বাংলায় যাকে ব্যবসা বাণিজ্য বলা হয় ইংরেজিতে তার জন্য ‘commerce’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় যা ফরাসিkom’res’ শব্দ থেকে এসেছেঅর্থাৎ জীবিকাবৃত্তি, পেশা, কারবার, যত্ন, উদ্যম, চেষ্টা, অভিপ্রায়, উদ্দেশ্য, অনুসন্ধান, ব্যবহার, আচরণ, সওদাগরি ইত্যাদিব্যবসা শব্দের জন্য ইংরেজিতে আরও একটি শব্দ প্রায়ই ব্যবহার করা হয় সেটি হল Business, যা এসেছে প্রাচীন শব্দ Bysing থেকেযার অর্থ যে কোন কাজে ব্যস্ত থাকাতবে ব্যবসা হিসেবে সব ব্যস্ততায় বিবেচিত নাসাধারণভাবে ব্যবসা বলা যায় অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে সামাজিক আইনগতভাবে বৈধ কর্মপ্রচেষ্টাকে সে ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্থাপিত হোক কিংবা হোক প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েব্যবসার জন্য আরবীতে সর্বাধিক প্রচলিত শব্দটি হল তিজারাত (تجارة) এর অর্থ বাণিজ্যকারবার ইত্যাদি। 

কুরআনে আল্লাহ্ তাআলার বানী রয়েছে যে তিনি শুধুমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তবে শুধু নামায, রোযা, হজ্জ যাকাত আদায় করার নামই ইবাদত নয় একইসাথে আল্লাহ্ তাঁর রাসূলের হুকুম অনুসারে যে কোন কাজই করা হোক তা ইবাদত হিসেবে বিবেচিত হবেআর হালাল উপার্জন ছাড়া  ইবাদত কবুলের আশা রাখা বৃথা আর হালাল উপার্জনের উত্তম পন্থাগুলির মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে একটি অন্যতম পন্থাএজন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম তাঁর অধিকাংশ সাহাবী হালাল ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর জোর দিয়েছেন এবং নিজেরাও এরই মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেনকারণ কারো ব্যবসা-বাণিজ্য আয়-রোজগার যদি হারাম হয় তার কোনো আমল দু' আল্লাহর কাছে কবুল হয় না প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেন,

إن الله طيِّب لا يقبل إلا طيبًا. وإن الله أمر المؤمنين بما أمر به المرسلين فقال تعالى: يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا ﴾ [المؤمنون: ٥١]. وقال تعالى: ﴿ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ ﴾ [البقرة: ١٧٢]، ثم ذكر الرجل يطيل السفر أشعث أغبر يمد يديه إلى السماء: يا رب يا رب, ومطعمه حرام، ومشربه حرام، وغذي بالحرام، فأنى يستجاب له؟!

অর্থাৎ- নিশ্চয় আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র এবং তিনি পবিত্র ছাড়া কিছুই গ্রহণ করেন নাআর তিনি মুমিনদেরকে সেই নিদের্শ দিয়েছেন, যা রাসূলগণকে দিয়েছিলেনতিনি বলেন, “হে রাসূলগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু ভক্ষণ করো এবং সৎ কর্ম করো।" তিনি আরো বলেন, "হে মু'মিনগণ, তোমরা আমার প্রদত্ত রিযিক থেকে পবিত্র বস্তুগুলোই ভক্ষণ করো।" তারপর তিনি এমন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন যে দীর্ঘ সফর শেষে মলিন শরীরে দু'হাত বাড়িয়ে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করে, হে আমার রব, হে আমার রব! (এভাবে দু' করতে থাকে) অথচ তার আহার্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, অধিকন্তু সে হারাম দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েছে, তা হলে কীভাবে তার দু' কবুল হতে পারে?

ব্যবসা-বাণিজ্য বৈধ বা হালাল হওয়ার জন্য কিছু বিষয় মেনে চলা করা অপরিহার্যসেগুলোকে বাদ দিয়ে ব্যবসা বৈধ হয় নাঅবশ্য পরিপালনীয় বিষয়গুলো হলো

সততা বিশ্বস্ততা অবলম্বন করা

অর্থাৎ কোনোরকমের ছল-চাতুরির  অনৈতিক কলা কৌশলের আশ্রয় না নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করাএটি ব্যবসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়এই বৈশিষ্ট্যগুলো অতিক্রম না করে কারো পক্ষে পরিপূর্ণ মু'মিন হওয়া সম্ভব নয়অসৎ ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে রাসূলুল্লাহ্ বলেছেন,

إِنَّ التُجَّارَ يُبْعَثُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فُجَّارًا إِلَّا مَنْ اتَّقَى اللَّهَ وَبَرَّ وَصَدَقَ.

ব্যবসায়ীগণ কিয়ামতের দিন পাপাচারী হিসেবে উত্থিত হবেতবে সেই সব ব্যবসায়ী এদের ব্যতিক্রম, যারা আল্লাহকে যথাযথ ভয় করে এবং ন্যায়পরায়ণতা সততার পথে চলে।'

হালাল পথ অবলম্বন করা। 

উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলামের সর্বদা একই নির্দেশ রয়েছে, হালাল রাস্তা অবলম্বন করে উপার্জন করাএবং সর্বকালের জন্য নিষেধ রয়েছে অবৈধ পথ বা হারাম অবলম্বন করা থেকেআল্লাহ্ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ

হে ঈমানদারগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের ধন-সম্পদ ভক্ষণ করো না।” (Al-Quran, 4 : 29)

পণ্যের যুক্তিসঙ্গত মূল্য নির্ধারণ

পণ্যের মূল্য এমনভাবে নির্ধারণ করা উচিত যাতে বিক্রেতার ক্ষতি ক্রেতার কষ্ট না হয়ইমাম মালিকের একটি মত, হানাফী মাযহাবএবং শাফিঈদের দুটি মতের একটি অনুসারে জনকল্যাণের কথা বিবেচনা করে শাসক ইচ্ছা করলে তা নির্ধারণ করতে পারেনপণ্যের মূল্য এমনভাবে নির্ধারণ করা উচিত যাতে বিক্রেতার ক্ষতি ক্রেতার কষ্ট না হয়ইমাম মালিকের একটি মত, হানাফী মাযহাবএবং শাফিঈদের দুটি মতের একটি অনুসারে জনকল্যাণের কথা বিবেচনা করে শাসক ইচ্ছা করলে তা নির্ধারণ করতে পারেনযদি ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত দাম বাড়ায় এবং সাধারণ মুসলমানের তাতে বিপত্তি অসুবিধা হয় তখন বিচারক জ্ঞানী বিচক্ষণ ব্যক্তিদের পরামর্শক্রমে মূল্য নির্ধারণ করে দেবেন। 

লাভের পরিমাণ যুক্তিসঙ্গত হওয়া  

কোন পণ্যের কত মূল্য হতে হবে ব্যাপারে সরাসরি কুরান হাদিসে কিছু বলা নেইআবার এমন কোন নিষেধাজ্ঞাও নেই যে সমস্ত পণ্যে একই রকম লাভ বা মুনাফা করা যাবে নাএই বিষয়টিকে শারি'আতে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে যাতে স্থান কাল পরিবেশের উপর নির্ভর করে তা নির্ণয় করা যায়তবে ইসলামে অতিবেশি লাভ করা নিষিদ্ধকারণ এটা এক ধরনের শোষণ নিপীড়নআর এমন ক্রেতা যে পণ্যের মূল্য জানেনা তার কাছ থেকে বেশি মূল্য আদায় করা ইসলামে নিষিদ্ধএবং একাজ ফাকিহগণের দৃষ্টিতে প্রতারণা ঠকানোযে এমন ভাবে মুনাফা হাসিল করে তাকে হাদিসে নিন্দা করা হয়েছে 'মুস্তারসিল' বা অতি মুনাফাখোর বলে

أَيُّمَا مُسْلِمٍ اسْتَرْسَلَ إلى مُسْلِمٍ فَغَبَنَهُ فِي الْبَيْعِ

অর্থাৎ- ‘যে মুসলিম অপর মুসলিমের নিকট থেকে অতিরিক্ত মূল্য আদায় করল সে তার সঙ্গে ব্যবসায় প্রতারণা করল।’

উপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার হয় যে ইসলামে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ, যেমন ব্যবসা, লেনদেন ইত্যাদি সম্বন্ধে সকলের জন্য সুবিধাজনক উপযুক্ত নির্দেশনা উপদেশ দেওয়া হয়েছেইসলামের এই নির্দেশনা অনুসারে ব্যবসা বাণিজ্য করলে ব্যবসা ইহকালের পরকালের জীবনের একটি সফলতার কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং তাতে সমাজের কল্যাণ হবে একইসাথে যেহেতু ইসলামের নির্দেশ মেনে ব্যবসা করলে কেউ ব্যবসার মধ্যে কোনরূপ অসাধু কার্যকলাপের আশ্রয় নিতে পারবেনাইসলামের এইসব নির্দেশনাগুলি পালন করলে শোষণ-বঞ্চিত সুখী সমৃদ্ধ একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।  

তথ্যসূত্রঃ

Mahbubur Rahman, Mohammad. Outline of Halal Business in Islam: An Analysis. Islami Ain O Bichar. Vol. 16, Issue: 61. January-March, 2020.

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter