কোরবানীর গুরুত্ব ও মর্যাদা

ইসলামী ক্যালেন্ডারের সর্ব
 শেষ মাস হচ্ছে জিল-হজ্জ,  যার অনন্তে শুধু উপাসনা,  উপভোগ, পৃতি, ভালোবাসা, সুখ ও বলিদানে পূর্ন ।

মুসলিম জাতী তাদের আদি পিতা ও মহত্ব নবী হজরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর অনুসরণ করে এই মাসের দশ তারিখে  কুরবানী উদযাপন করেন,
যার মহত্ব ইসলামী জগতে অগণ্য ।

কুরবানী হলো ইসলামের একটি শি’য়ার বা মহা নিদর্শন। আল্লাহ তাআলা কুরবানীর মর্যাদা বর্ণনা করে কোরআন শরীফে ইরশাদ করেন যে-
فصل لربك وانحر
 অর্থাৎ:- তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে উপাসনা করো ও কুরবানী করো। (সূরা কাওসার-২ নঃ আয়াত)।

কুরবানী বা বলিদান হচ্ছে আল্লাহ তাআলার একটি মহান বিধান, যার প্রচলন ইসলামের প্রথম নবী হযরত আদম (আঃ) থেকে নিয়ে শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ও সমস্ত নবীর যুগেই ছিল ।

ইব্রাহিম (আঃ) বা খলিলুল্লাহ আল্লাহর একজন এত মর্যাদাবান নবী ছিলেন, যিনার গৌরবে আল্লাহ তাআলা তাঁকে 'উলুল আজাম'  বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন । আল্লাহ তাআলা সমস্ত নবীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা তাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছেন, তবে ইব্রাহিম (আঃ) থেকে যে পরীক্ষাটি নেওয়া হয়েছিল সেটি আরও বেশী কঠিন ও কষ্টদায়ক ছিল ।

আল্লাহর তরফ থেকে ইব্রাহিম (আঃ)-কে তাঁর রাস্তায় নিজ পুত্র ও কলিজার টুকরো  ইসমাইল (আঃ)-কে বলিদানের নির্দেশ দেন। 

ইসমাইল (আ:) ছিলেন ইব্রাহিম (আ:)-এর সবচেয়ে বড় আনন্দ ও খুশি, কিন্তু যখন আল্লাহর নির্দেশ এলো তখন তাঁর কলিজার সম্পর্কের সত্ত্বেও আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য নিজের স্বপ্নকে কার্যকর করতে অগ্রসর হলেন।

বাড়ি ফিরে এসে স্ত্রী হাজেরা (রাঃ)-কে বললেন যে আমার সুপুত্রকে  সুন্দর করে সাজিয়ে দাও, আমরা এক নিমন্ত্রণে যাব! স্বামীর কথা শুনে স্ত্রী তাড়াতাড়ি নিজ পুত্রকে সাজিয়ে প্রস্তুত করলেন। তিনি স্ত্রী হাজেরার কাছে সাজিয়ে গুজিয়ে উত্তম পোশাক পরিয়ে, ছুরি এবং রশি  সাথে  করে ইসমাইল (আঃ)-কে নিয়ে রওনা দিলেন জঙ্গলের দিকে। 
শয়তান ধোকা দেওয়ার উদ্দেশে হযরত হাজেরা (রাঃ), ইসমাইল (আঃ) এবং ইব্রাহিম (আঃ)-কে শত প্রতারণার পরও নিরাশ হয়ে ফিরে আসে। ইব্রাহিম (আঃ)  নিজের ছেলেকে নিয়ে যখন জঙ্গলে পৌছলেন তখন বললেন: হে আমার পুত্র আল্লাহর রাস্তায় তোমাকে বলিদানের নির্দেশ এসেছে।
কোরআন শরীফে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন:- 
 فلما بلغ معه السعي قال يا بني إني أرى في المنام أني أذبحك (سورة الصافات ١٠٢) 
 অর্থাৎ:- অতঃপর যখন সে পিতার সাথে চলাফেরার বয়সে উপনীত হল, ইব্রাহিম (আঃ)  তাকে বললেন যে হে বৎস স্বপ্নে আমার প্রতি প্রত্যাদেশ এসেছে যে আমি তোমাকে জবাই করছি (সূরা-সাফফাত ১০২)

কতইনা মহান ইবরাহীম (আঃ)-এর ঈমানের দৃঢ়তা! কি খোদা অনুগত্য! 
সুতরাং ইবরাহীম (আঃ) নিজের প্রতিপালকের নির্দেশের  অনুগত্য করতে দ্বিধা বোধ করলেন না। তিনি নিজের  পালনকর্তা কে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করে নিজের একমাত্র পুত্রের বলিদানের দিকে অগ্রসর হলেন ।

ইসমাইল (আঃ) নিজের পিতার প্রশ্নের উত্তরে বললেন: আমার পিতা আল্লাহর আদেশ কে অনুগত্য করতে আমি দ্বিধাবোধ করিনা । আপনার প্রতি যা ওহি হয়েছে,  তা বাস্তবায়ন করুন।
يا أبت افعل ما تؤمر ستجدني إن شاء الله من الصابرين ( الصافات ١٠٢ ) 
 অর্থাৎ: হে পিতা! আপনার প্রতি যা ওহি হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করুন। আল্লাহ চাহে তো আমাকে ধৈর্য্যশীল হিসেবে পাবেন। (সূরা আস-সাফ্ফাত : ১০২)

কেমন আশ্চর্যময় দৃশ্য! আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পিতা কর্তৃক পুত্রের কুরবানী, আল্লাহু আকবার! যখন পিতা পুত্র উভয়েই রবের ফায়সালার ওপর অবনতচিত্তে রাজি, তখন পিতা পুত্রকে উপূর করে শোয়ালেন । 
فلما اسلما وتله بالجبين ( الصافات ١٠٣ )
 অর্থাৎ: যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল তখন ইব্রাহিম (আঃ) তাঁকে জবাই করার জন্য শায়িত করলেন । (আস- সাফফাত ১০৩)

ছুরি চালাবার আগে পুত্র বলল: আব্বা- জান আমার তিনটি আবদার রক্ষা করুন! 

প্রথমতঃ আমার হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে দিন যেন নড়াচড়ার কারণে আপনার কষ্ট না হয়, এবং আপনার শরীরে রক্তের ছিটে না পড়ে। 

দ্বিতীয়তঃ আপনার চোখে কাপড় বেঁধে নিন, যেন ভালোবাসা ও আদরের নিমিত্তে ছুরি চালানো বন্ধ না হয়ে যায়। 

তৃতীয়তঃ  আমার রক্তাক্ত জামাটি আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দিবেন যেন তাঁর অন্তরে একটু স্বস্তি আসে। 

যখন পিতা পুত্রের গলায় ছুরি চালাচ্ছেন, তখন সেটি ভোতরা হয়ে গেছে। দুবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে  ইব্রাহিম (আ:) যখন পাহাড়ের দিকে ছুরিটাকে নিক্ষেপ করলেন, তখন একটি পাথরের ওপর পড়ে তা ছুরির আঘাতে দু'খন্ড হয়ে গেল। ছুরির এটাই বক্তব্য যে:
الخليل ويأمرني بالقطع والجليل ينهانى
অর্থাৎ:  খলিল আমাকে কাটতে আদেশ করেন, আর জলিল (আল্লাহ) আমাকে নিষেধ করেন।

তৎক্ষণাৎ জিব্রাইল আমিন আলাইহিস সালাম জান্নাত থেকে একটি দুম্বা নিয়ে ইব্রাহিম (আঃ)এর ছুরি ইসমাইল আলাইহিস সালামের গলায় পৌঁছানোর আগেই হাজির হলেন, এবং ইসমাইল আলাইহিস সালামকে সরিয়ে দুম্বাটি রেখে দিলেন। তারপর দুম্বা কোরবানি হয়ে গেল ।

তখন রবের পক্ষ থেকে আওয়াজ আসলো যে: 
وناديناه أن يا إبراهيم قد صدقت الرؤيا إنا كذلك نجزي المحسنين وفديناه بذبح عظيم وتركنا عليه في الاخرين ( سورة الصافات ١٠٤-١٠٨ )
 অর্থাৎ:- তখন আমি তাকে ডাক দিলাম এই ইব্রাহিম তুমিতো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দেই। নিশ্চয়ই এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে জবাই করার জন্য এক মহান জন্তু দিলাম। আমি তার জন্য এই বিষয়টিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি  ( সুরা-সাফফাত ১০৪-১০৮ )।

হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর কুরবানী আল্লাহ কবুল করে নিলেন এবং স্মরণিকা স্বরূপ সেই কোরবানীর ধারা কিয়ামত পর্যন্ত জারি করে দিলেন। এখনও প্রতি বৎসর সেই স্বরনকেই উজ্জীবিত করা হয় ।

কোরবানীর ফজিলত-মর্যাদা অগণ্য। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনায় ১০ বছর থাকাকালীন প্রত্যেক বছরই কোরবানী করেছেন।  
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কোরবানীর অনেক মর্যাদা বর্ণনা করেছেন । 
একদা এক সময় রাসুলুল্লাহকে সাহাবায়ে কেরামগণ  (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন "হে আল্লাহর রসূল কোরবানীর প্রথাটি কি?"  নবী তখন ইরশাদ করলেন "তোমাদের আদি পিতা ইব্রাহিম (আঃ)-এর সুন্নত"। সাহাবারা পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, "এতে আমাদের কি লাভ?" আল্লাহর নবী (সাঃ) ইরশাদ করলেন "কোরবানীর পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি পাওয়া যায়"। (ইবনে মাজাহ হাদিস - ৩১২৭)

কোরবানীর ফজিলত অসংখ্য। আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আঃ)-এর ঘটনাকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন; বারবার আমাদেরকে কোরআন শরীফে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। 
আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সাঃ)  বর্ণনা করেন যে:
ما عمل آدمي من عمل يوم النحر أحب الى الله من إهراق الدم ( ترمذي )
অর্থাৎ: কোরবানী দিবসে আল্লাহর কাছে আদাম জাতের সর্ব প্রিয় আমল হল (কুরবানীর) রক্তপাত (তিরমিযী শরীফ) ।

কোরবানীর দিনে জবাই করা পশুর শিং, চুল, খুর  ইত্যাদি অঙ্গের পরিণাম পূণ্য কিয়ামতের দিনে দেওয়া হবে। জবাই করা পশুর এক ফোটা রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বে আল্লাহ তাআ'লা কুরবানী কবুল করে নেন।
কোরবানির ফজিলত এতই আছে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
من كان له سعة فلم يضح فلا يقربن مصلانا (ابن ماجه)

 অর্থাৎ:- আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: যে কোরবানী করার ক্ষমতা থাকার সত্ত্বেও  কুরবানী করল না, সে যেন  আমাদের ঈদগাহে না আসে।

কোরবানীর ফজিলত লিখে সমাপ্তি করা অসম্ভব। তাই সমস্ত মুসলিম জাতির প্রতি আবেদন যদি কুরবানী করার ক্ষমতা থাকে তো নিশ্চয়ই নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতকে অনুসরণ করে কোরবানী করুন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter