ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে গাজা যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের চুক্তি স্বাক্ষর: শান্তির নতুন আশা না সাময়িক বিরতি?
প্রস্তাবনা
দীর্ঘ দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, হাজারো প্রাণহানি ও মানবিক বিপর্যয়ের পর অবশেষে গাজার আকাশে শান্তির এক ক্ষীণ রশ্মি দেখা দিয়েছে। ইসরায়েল সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে যে তারা হামাসের সঙ্গে গাজা যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের অস্থির রাজনীতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
যুদ্ধবিরতির এই উদ্যোগ কেবল দুটি শক্তির মধ্যে সামরিক বিরতি নয়, বরং এটি দীর্ঘকাল ধরে চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে। বহুবার ব্যর্থ আলোচনার পর এবার কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় এই চুক্তি সম্ভব হয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই চুক্তিকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে এক “অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ” হিসেবে দেখছে।
তবে, ইতিহাস বলে—ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে স্বাক্ষরিত অনেক যুদ্ধবিরতি শেষ পর্যন্ত টেকেনি। তাই প্রশ্ন উঠছে, এই চুক্তি কি স্থায়ী শান্তির সূচনা করবে, নাকি এটি শুধুই যুদ্ধের সাময়িক বিরতি? বিশ্লেষকদের মতে, আসল পরীক্ষাটি এখন শুরু হলো—চুক্তি কার্যকর করার পর উভয় পক্ষ কতটা আস্থা ও সংযম প্রদর্শন করতে পারে। সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসে, ইসরায়েলের শান্তি চুক্তি সহ, ইহুদিরা সর্বদা মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করেছে, আমরা মূসা (আঃ) এর জীবনে এবং আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) এর জীবনে প্রত্যক্ষ করতে পারি। বনু কুরাইজা তাদের শান্তি ও প্রতিরক্ষা চুক্তি বহুবার ভঙ্গ করেছে এবং তাই তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
চুক্তির পটভূমি
গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান শুরু হয় ২০২৩ সালের শেষ দিকে, যখন হামাস ইসরায়েলে রকেট হামলা চালায় এবং শতাধিক নাগরিককে বন্দী করে। এর জবাবে ইসরায়েল ব্যাপক বিমান হামলা ও স্থল অভিযান চালায়, যার ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। গাজার বেশিরভাগ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, হাসপাতাল, বিদ্যালয় ও মসজিদ পর্যন্ত রেহাই পায়নি।
এই সংঘাতের কারণে প্রায় ২০ লাখ গাজাবাসী চরম মানবিক সংকটে পড়ে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার ইসরায়েল ও হামাস উভয়কেই যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। তীব্র আন্তর্জাতিক চাপ এবং আরব দেশগুলোর উদ্বেগের প্রেক্ষিতে অবশেষে উভয় পক্ষ আলোচনায় বসতে রাজি হয়। কাতার, মিশর ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে কয়েক সপ্তাহের গোপন আলোচনার পর একটি প্রাথমিক চুক্তি সম্পন্ন হয়।
এই চুক্তির পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল মানবিক বিপর্যয় রোধ করা এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় সহায়তা পৌঁছানোর পথ খুলে দেওয়া। কারণ যুদ্ধের ফলে গাজার হাসপাতালগুলো প্রায় অচল হয়ে পড়ে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, এবং সাধারণ মানুষের জন্য খাদ্য ও পানি পর্যন্ত অপ্রতুল হয়ে ওঠে। তাই এই যুদ্ধবিরতি ছিল মানবিক প্রয়োজনেরও এক জরুরি দাবি।
চুক্তির প্রধান শর্তাবলি
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রথম ধাপের এই চুক্তিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা রয়েছে। প্রথমত, উভয় পক্ষ ৭২ ঘণ্টার জন্য যুদ্ধবিরতি বজায় রাখবে এবং এই সময় কোনো সামরিক অভিযান চালানো হবে না। দ্বিতীয়ত, হামাস ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে, বিনিময়ে ইসরায়েল ১৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিতে সম্মত হয়েছে। তৃতীয়ত, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবিক সহায়তা গাজায় প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হবে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজার কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে কিছুটা পিছু হটবে, যাতে মানবিক সহায়তা নিরাপদে পৌঁছাতে পারে। হামাসের পক্ষ থেকেও নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে তারা কোনো ধরনের রকেট হামলা বা আক্রমণ চালাবে না। উভয় পক্ষ একে অপরের সীমান্তে আক্রমণ না করার বিষয়ে মৌখিক অঙ্গীকার করেছে।
এই চুক্তিতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো “দ্বিতীয় ধাপের আলোচনার প্রতিশ্রুতি।” অর্থাৎ, প্রথম ধাপ সফল হলে উভয় পক্ষ একটি স্থায়ী শান্তি পরিকল্পনা এবং গাজার ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে আলোচনায় বসবে। তাই এটি কেবল একটি যুদ্ধবিরতি নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের সম্ভাবনামূলক ভিত্তি।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই চুক্তিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বাগত জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “এই যুদ্ধবিরতি গাজার মানুষের জন্য আশা ও জীবনের নতুন সম্ভাবনা এনে দেবে।” ইউরোপীয় ইউনিয়ন একে “শান্তির পথে সাহসী পদক্ষেপ” বলে অভিহিত করেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এই চুক্তিকে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “গাজায় প্রতিটি প্রাণের মূল্য রয়েছে। এই চুক্তি যদি একটি শিশুর জীবনও রক্ষা করতে পারে, তবে এটি সফল।” যুক্তরাষ্ট্র আশা প্রকাশ করেছে যে এই পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক কূটনৈতিক ভারসাম্য আনবে।
অন্যদিকে, কাতার ও মিশর—যারা এই আলোচনার মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালন করেছে—তারা উভয় পক্ষকে চুক্তি রক্ষার আহ্বান জানায়। মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি বলেন, “শান্তি শুধু অস্ত্রবিরতি নয়; এটি বিশ্বাস পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া।”
গাজার জনগণের প্রতিক্রিয়া
চুক্তির ঘোষণার পর গাজা সিটির রাস্তায় সাধারণ মানুষ নেমে আসে। কেউ কেউ কেঁদে ফেলেন, কেউ আবার একে অপরকে আলিঙ্গন করে শান্তির সম্ভাবনা উদযাপন করেন। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এই ঘোষণা গাজাবাসীর মনে সামান্য আশার আলো জাগায়।
তবে, আনন্দের মাঝেও ভয় ও অনিশ্চয়তা বিদ্যমান। বহু মানুষ এখনো তাদের প্রিয়জনদের খুঁজে পাননি। এক গাজাবাসী মা বলেন, “আমার ছেলে এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে, কিন্তু অন্তত আজ আমি শুনতে পাচ্ছি না বোমার শব্দ।” এই কথায় গাজার বাস্তবতার প্রতিফলন স্পষ্ট হয়—মানুষ এখনো শুধু বেঁচে থাকার সুযোগ খুঁজছে।
গাজার তরুণ প্রজন্মও বলছে, তারা স্থায়ী শান্তি চায়। তাদের মতে, শুধু যুদ্ধবিরতি নয়, এমন এক ভবিষ্যৎ দরকার যেখানে তারা শিক্ষা, কাজ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাবে। এই তরুণরাই আগামী দিনের ফিলিস্তিন গড়বে, যদি শান্তির পরিবেশ টিকে থাকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও কৌশলগত দৃষ্টিকোণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যে নতুন পরিবর্তন আনতে পারে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। কট্টর ডানপন্থী নেতারা প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন, কারণ তারা মনে করেন হামাসকে কোনো ছাড় দেওয়া মানে তাদের পুনরায় শক্তি অর্জনের সুযোগ দেওয়া।
অন্যদিকে, হামাসের ভেতরেও বিভক্তি রয়েছে। রাজনৈতিক শাখা কূটনৈতিক আলোচনাকে স্বাগত জানালেও সামরিক শাখা এখনো প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে চায়। এই দ্বৈত অবস্থান ভবিষ্যতে চুক্তি বাস্তবায়নে জটিলতা তৈরি করতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই চুক্তির সফলতা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক চাপ ও আঞ্চলিক সমর্থনের উপর। যদি যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিশর ও ইউরোপীয় দেশগুলো একযোগে পর্যবেক্ষণ ও সহায়তা অব্যাহত রাখে, তবে এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী শান্তির পথে একটি ভিত্তি হতে পারে।
মানবিক সংকট ও পুনর্গঠন
গাজায় যুদ্ধের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, প্রায় ৩০,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১০ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। হাসপাতালগুলোর অধিকাংশ ধ্বংস, ওষুধ ও খাদ্যের অভাবে মানুষ দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে চুক্তির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানবিক সহায়তা প্রবেশ নিশ্চিত করা। ইসরায়েল গাজার ওপর আরোপিত অবরোধ কিছুটা শিথিল করতে রাজি হয়েছে, যাতে খাদ্য, ওষুধ, পানি ও জ্বালানি প্রবেশ করতে পারে। রেড ক্রস এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এই প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে।
তবে, সহায়তা কার্যক্রমে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক জটিলতা থেকেই যাচ্ছে। অনেক সংস্থা আশঙ্কা করছে যে, যদি যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ হয়, তাহলে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়বে। তাই স্থায়ী শান্তি ছাড়া গাজার পুনর্জীবন সম্ভব নয়।
চ্যালেঞ্জ ও অনিশ্চয়তা
যুদ্ধবিরতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো আস্থার অভাব। অতীতে উভয় পক্ষই বারবার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। ফলে জনগণের মধ্যে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে—এই চুক্তিও হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভাজন রয়েছে। নেতানিয়াহুর জোট সরকারে এমন অনেক নেতা আছেন যারা যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করছেন। তাদের মতে, হামাসকে দুর্বল না করে যুদ্ধ থামানো মানে ভবিষ্যতের হুমকি তৈরি করা।
অন্যদিকে, হামাসও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৈধতা পাওয়ার লড়াই করছে। তারা চায় বিশ্ব তাদের শুধু “সন্ত্রাসী গোষ্ঠী” নয়, বরং একটি রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিক। এই রাজনৈতিক বাস্তবতাগুলো চুক্তির কার্যকারিতা জটিল করে তুলেছে।
উপসংহার
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে এই প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। গাজার বিধ্বস্ত জনগণের জন্য এটি অন্তত সাময়িক স্বস্তি ও আশা এনে দিয়েছে। তবে, বাস্তব শান্তি তখনই আসবে যখন উভয় পক্ষ আস্থা, মানবিকতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রদর্শন করবে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যুদ্ধের পর শান্তি স্থাপন করা সহজ নয়। এই চুক্তি হয়তো একটি দীর্ঘমেয়াদি পথচলার সূচনা। এখন সময় এসেছে আস্থা পুনর্গঠনের, রক্ত নয়—সম্মানের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খোঁজার।
যদি এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী শান্তিতে রূপ নেয়, তবে এটি শুধু গাজার মানুষের নয়, পুরো মানবতার জয় হবে। আর যদি ব্যর্থ হয়, তবে ইতিহাস আবারও রক্তে ভিজে যাবে। তবুও আশা করা যায়—এই চুক্তি হয়তো সেই প্রথম ধাপ, যা একদিন স্থায়ী শান্তির পথে নিয়ে যাবে।