পারিবারিক জীবনে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

পরিবার মানে কত হৃদয়ের সামষ্টিক মেলবন্ধন, রক্তের টানে একত্রে বসবাস, যেখানে আছে জীবনের সহজাত প্রবাহ, আছে স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালবাসা। আছে উষ্ণ আবেগ, আছে অভিমান এবং যত্ন- আত্মীয়তার পরিচর্যার সম্মেলন। নিজ পরিবারই মানুষের প্রথম পাঠশালা। ইসলামী সমাজব্যবস্থায় পারিবারিক কাঠামোর এক বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে। মজবুত ইসলামী সমাজব্যবস্থা মূলত পারিবারিক ভিত্তির ওপর দন্ডায়মান। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চলমান বিশ্বায়নের তথাকথিত প্রগতি ও আধুনিকতার পশ্চিমা প্রভাবে মুসলিম পারিবারিক ব্যবস্থাপনাতেও বেশ শক্ত আঘাত আসছে। অত্যন্ত সুকৌশল ইসলামী সমাজের এই প্রাথমিক ভিত্তিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছে, ভেঙে টুকরো টুকরো হচ্ছে পরিবারের বন্ধন এবং ইহাই এখনকার সমাজে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। 

পরিবার একটি রাষ্ট্রের কিংবা সমাজের সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক। পরিবারের স্তম্ভ যত দৃঢ় হবে, আমাদের সমাজ ও তত বেশি শক্তিশালী হবে। কিন্তু এই ভিত্তি দুর্বল হলে গোটা সমাজ পতনের অতল গহ্বর পানে ছুটতে থাকবে। মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠা নানান সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে কাছের হলো পারিবারিক বন্ধন। আর এই বন্ধন আবদ্ধ সকল মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন আল্লাহ তা'আলা। তিনি পরিবারের সদস্য হিসাবে আল কুরআন ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহর মধ্যে দিয়ে আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য ও অধিকারের সীমারেখা এঁকে দিয়েছেন।

ইসলামের আত্মিক শান্তি ও সামাজিক শীতলতা যদি এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, তবে শুরুতেই ইসলামকে আমাদের পরিবারে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ইসলামের বাণী পৃথিবীর সর্বোচ্চ ছড়িয়ে পড়বে তখনই, যখন প্রত্যেক মুসলিম সন্তান বড় হয়ে ইসলামকে তার হৃদয়ে মূল বাণী হিসেবে মনে করে। পৃথিবীতে ন্যায় প্রণয়ন তখনই সম্পন্ন হবে, যখন পরিবারের সদস্যরা অন্যায় থেকে বিরত থাকবে। বাবা-মা তার সন্তানের হক নষ্ট করবে না, আবার সন্তান তার বাবা-মায়ের প্রতি নীতিপরায়ণ হবে। স্বামী - স্ত্রী একে অপরের দুর্বলতার সুযোগ নেবে না; বরং একজন আরেকজনের ঢাল স্বরূপ পরিণত হবে। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম সমাজে ইসলামের দেখিয়ে দেওয়া পথ অনুসরণ তো হচ্ছেই নাবরং কুরআনের আয়াত অপব্যবহার করে স্বামী স্ত্রী পরস্পরের অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে। নিজ কর্তব্য পালন না করে কেবল অধিকারের কথা বলছে। অভিভাবকগণ  সন্তানের ওপর তাদের অন্যায্য সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন।

মুসলিম পরিবারকে এসব অনাচার থেকে রক্ষা করা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের ওপর অনিবার্য। এ ছাড়া পরিবারে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে কুরআনে ভিন্ন ভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ব্যাখ্যা করেছেন।

যেকোনো পরিবারে যাত্রা শুরু হয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে। এই বন্ধন একটি পবিত্র বন্ধন; যার ধাপে ধাপে রয়েছে বরকতের প্রবাহ। আর এই বন্ধনের দ্বারাই এক পুরুষ ও এক নারী এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়, যার অপর নাম হলো - স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন এবং এই স্বামী ও স্ত্রী যখন বাবা মা হন, তখন তাদের নিজেদের সম্পর্কের ব্যাপারে আরো সচেতন হতে হয়। কারণ তাদের কথা কাটাকাটি, একে অপরের প্রতি বিরূপ আচরণ সন্তানের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। মা বাবার কাছেই সন্তান শেখে কিভাবে অপমান কিংবা জোর করে নিজের উদ্দেশ্য সফল করা যায়। আবার মা-বাবার কাছ থেকেই সন্তান সদ্যববহার এবং নীতিমালা শিখে থাকে।  সন্তানকে নামাজ আদায়ের শিক্ষা পরিবার দেবে, তেমনি তার নৈতিক মূল্যবোধ ও পরিবার থেকে পাওয়া শিক্ষার ফলেই গড়ে উঠবে এক আদর্শ সমাজ বা রাষ্ট্র।

যদিও সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে মা-বাবার কর্তব্য সম্পর্কে আমরা সকলেই কম বেশি জানি। অতীতের সমাজ আর এই সমাজ খুবই ভিন্ন। বর্তমান সমাজের লোভ-লালসা, সর্বত্র অশ্লীলতার প্রসার, এই সমাজের বিশেষত্ব; পশ্চিমা বিশ্বের সন্তানের ঈমান যদি মজবুত গড়ে তোলা না হয়, তাহলে অনতিদূরে নিত্যনতুন মুসলিম যুবসমাজ ধর্মান্তরিত হতে দ্বিধাবোধ করবে না। আর আমরা আমাদের সন্তান পালনে ব্যর্থ হলে উত্তরাধিকার সূত্রে এই ব্যর্থতা পরবর্তী সকল প্রজন্মকে ইসলাম থেকে আরও দূরে ঠেলে দেবে। তাই সন্তান কার সাথে কথা বলছে, কার সাথে মিশছে - এগুলো জানার জন্য মা-বাবাকে সন্তানের উত্তম বন্ধু হতে হবে। তার মনের কথা জানতে হবে, তাকে বুঝতে হবে। নিজেদের ব্যস্ততার বাহানা বানিয়ে আমরা সন্তানকে দূরে ঠেলে দিই। বিভিন্ন যান্ত্রিক তার হাতে ধরিয়ে দিই। শিশু বয়সে সন্তানের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেলে, পরবর্তীকালে তা কি ভয়ানক পরিণতি আনতে পারে তার উদাহরণ সমাজে অগণিত।

সন্তান লালনপালনের দায়িত্ববোধ

সন্তানকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে, নামাজ আদায়ের প্রতি মনোযোগী হতে, শিশুর শৈশব থেকেই প্রচেষ্টা করে যেতে হবে। কিন্তু সেই চেষ্টা বকাঝকা আর মারধর করে নয়। তাদের ইসলামের কাছে টানার বিভিন্ন কৈশল প্রয়োগ করতে হবে, এবং ইসলামে নামাজের গুরুত্বকে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। এছাড়া আগামী প্রজন্মকে পতনের হাত থেকে রক্ষার্থে আমাদেরকে কোরআনের উপর দৃষ্টিভঙ্গি ফেলে দিতে হবে।

কুরআনে আল্লাহ তায়ালা নবী - রাসূলদের সন্তান পালনের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। ইব্রাহিম আলাই সালাম কে আল্লাহ তা'আলা যখন মানবজাতির ইমাম ঘোষণা করেছিলেন, তখন তার প্রথম দোয়া ছিল পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। কারণ, যদি প্রজন্মান্তরে ইসলামের জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে পারি, তবেই আমরা ইসলাম সফল হবে; নয়তো ইমাম হিসাবে আমরা ব্যর্থ।

আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন:

رَبِّ اجْعَلْ هُذَا الْبَلَدَ آمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ

হে প্রভু, এই দেশকে নিরাপদ করুন এবং আমাকে এবং আমার সন্তানদের মূর্তি পূজা থেকে রক্ষা করুন। (সূরা ইব্রাহিম:৩৫)

رَبِّ اجْعَلْنِي القيم الصلوةِ وَ مِنْ دُرِّيَّتِي رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاء

হে আমার পালনকর্তা, আমাকে সালাত আদায়কারী এবং আমার অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন, হে আমাদের পালনকর্তা, এবং আমার দোয়া কবুল করুন। (সূরা ইব্রাহিম:৪০)

নিঃসন্দেহে সন্তান - লালন পালনের গুরুদায়িত্ব যাদের ওপর অর্পিত হয়েছে, সেই মা-বাবা আমাদের সর্বোচ্চ সম্মানের দাবীদার। মা বাবা আমাদের জন্য তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে দ্বিধাবোধ করেন না ; অথচ আমরা তাদেরকে তাদের প্রাপ্য সময়টুকু পর্যন্ত দিই না। আমরা আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করি না । কথা বলার সময় অন্যমনস্ক থাকি, তাদের আবেগ অনুভূতিকে তুচ্ছ করি।  অসম্মান করি , তারা আমাদের প্রতি যতটা দয়ালু ছিলেন, আমাদের ও তাদের প্রতি ঠিক ততটাই সহনশীল হতে হবে। কারণ বাবা-মায়ের দোয়া নিয়ে এবং তাদের সেবা করেই আমরা পৌঁছাতে পারি, আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্থাৎ জান্নাতে।

মোটকথা :-

পারিবারিক জীবনে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অসীম। এবং পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের ওপর এর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া অনেক অনিবার্য । কেননা পিতা-মাতা শিক্ষক ও সমাজের লোকদেরকে তাদের প্রজন্মের শিশু, কিশোর ও যুবকদের শিক্ষা দীক্ষা বিষয়ে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। আমরা যদি তাদের ভালো শিক্ষা দিয়ে থাকি তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে (পরকালে) আমরা নিজেরা ও সৌভাগ্যবান হব, এবং নতুন প্রজন্ম ও সৌভাগ্যবান হবে। এবং আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, আমরা যদি শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা করি, তখন তার পরিণতি আমাদেরকে ভোগ করতে হবে, এবং আমাদের প্রজন্ম কে ও  ভোগ করতে হবে।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter