ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরূদ্ধে আইসিসি-র গ্রেফতারি পরোয়ানা কতটা কার্যকর
ফিলিস্তিনি জনগণের মৃত্যুর সংখ্যা ৪৪ হাজার পেরিয়ে যাওয়ার পর, হেগ-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট - আইসিসি) ইসরাইলি আবেদন নাকচ করে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তার প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে 8 অক্টোবর ২০২৩ থেকে কমপক্ষে ২০ মে ২০২৪ পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং ফিলিস্তিনি জনগণের চলমান গণহত্যার পিছনে তাদের জড়িত থাকা অনিস্বীকার্য। পরোয়ানায় হামাস নেতা মুহাম্মদ ডাইফেরও নাম অন্তর্ভুক্ত। যাইহোক, এখন প্রশ্ন উঠছে - আইসিসির পরোয়ানা অপরাধীদের বিরুদ্ধে বাস্তবায়নে কতটা কার্যকর - বিশেষ করে এই ক্ষেত্রে নেতানিয়াহু এবং তার অপরাধী সহায়ককে গ্রেফতার করতে?
৭ অক্টোবরের পূর্বে
প্রায় ইউরোপে বিশেষ করে জার্মানিতে নাজি সরকারের ঐতিহাসিক নির্যাতন ও নিপীড়ন ইহুদের প্রাণ রক্ষার্থে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করে। আশ্রয়হীন ইহুদিদের একমাত্র শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করেছিল বর্তমান ফিলিস্তিনের পূর্বপুরুষরা। কিন্তু উগ্রবাদী ভাবাদর্শ নিয়ে ইহুদি জাতীয়তাবাদী জায়নবাদ (Zionism) মুসলিম জনসংখ্যায় অধ্যুষিত অটোমান প্যালেস্টাইনকে নিজ রাষ্ট্র বানাবার উদ্দেশ্যে কিছু পশ্চিমা শক্তির সহয়তায় ঔপনিবেশিকতার মাধ্যমে কাজ শুরু করে। স্থানীয় আরব মুসলমান প্রতিরোধ করলেও অঞ্চলে ইহুদি পরিযান প্রবাল বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্যালেস্টাইনের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য সংঘর্ষ শুরু হয়। ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তির সহায়তায় ১৯৪৮ সালে ইসরাইল এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তারপর, ৭ অক্টোবর ২০২৩ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বহু উপায়ে অত্যন্ত অত্যাচার ঘটতেই থাকে ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার ওপর। ইসরাইলি উপনিবেশিক শক্তি ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা স্বশাসনের জন্য তাদের সংকল্পে অনড়। গাজা হয়ে ওঠে বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার যেখানে লাখ লাখ শরণার্থী নাকবার পর আশ্রয়ের জন্য এসে বসে। অঞ্চলটি সমুদ্র এবং স্থল সীমানা দ্বারা বেষ্টিত, তবে এক অবাস্তব স্থিতিস্থাপকতা যা এক সহস্র হারা ফিলিস্তিনি যুবককে কারাগারেও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখায়।
গত বছর ৭ অক্টোবরে, হামাসের নেতৃত্বে গাজা প্রতিরোধ বাহিনী ইসরায়েলের উপর আকস্মিক হামলা চালিয়ে ১২০০ জনকে হত্যা এবং অনেককে বন্দী করে। ফিলিস্তিনিদের এই অপ্রত্যাশিত জাগরণে পুরো বিশ্ব হতবাক। যাইহোক, ইসরায়েল চুপ করে থাকার নয়। এখনও ইসরায়েল হামলা চালাচ্ছে যখন মৃতের সংখ্যা ৪৪০০০ ছাড়িয়েছে, লক্ষাধিক আহত এবং পুরো এলাকা বাস্তুচ্যুত। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরতি এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্থায়ী প্রতিষ্ঠার দাবি উঠেছে। যাইহোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার অন্যান্য কিছু দেশ সবসময় জাতিসংঘে যৌথ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যায়। একইভাবে, মুক্ত ফিলিস্তিনের দাবিতে বিশ্বজুড়ে জনবিক্ষোভ ও সংহতি প্রচার দেখা দিচ্ছে। আফ্রিকার মতো ঔপনিবেশিক নৃশংসতার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দেশগুলো ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আদালতে টেনে নিয়ে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে।
আইসিসি-র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
ফলস্বরূপ, সমস্ত তথ্য পর্যালোচনা করে, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এই সমস্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। তবে, প্রশ্ন থেকে যায় - ইসরায়েলি গণহত্যাকারী নেতাদের গ্রেপ্তারে কতটা কার্যকর?
২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য দায়ীদের অভিযুক্ত করে থাকে। বর্তমানে এটি একমাত্র স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত যা রোম সংবিধি (Rome Statute) নামে একটি চুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়।
বাস্তবায়নে বাঁধা
যাইহোক, আন্তর্জাতিক আদালত অনেক সমস্যায় জর্জরিত রয়েছে যেমন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে এর অক্ষমতা যেহেতু আদালতের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী নেই। এটা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর ওপর। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলের এই ক্ষেত্রে, দোষী ব্যক্তিরা যদি স্বাক্ষরকারী দেশ জার্মানিতে প্রবেশ করে তবে সেখানকার সরকার অবিলম্বে দোষীদের গ্রেপ্তার করবে। বর্তমানে, ১২৪টি দেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধিতে স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু চীন, ভারত, ইসরায়েল, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক সরকারই আইসিসির সদস্য নয়।
তাছাড়া অনেক সদস্য দেশও আইসিসির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে চলে। যেমন আর্জেন্টিনা, জার্মানি, হাঙ্গেরি এবং অন্যান্য দেশ আন্তর্জাতিক আদালতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের চরম কটাক্ষ করেছে। এমনকি হাঙ্গেরি আদালতের রায়কে অমান্য করে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে আমন্ত্রণ জানাবার কথা ভাবছে। তবে অনেক দেশই যেমন কানাডা, ইটালি, তুর্কি ও ইরান সত্যের প্রতীক হয়ে আদালতের সিদ্ধান্তকে বিশ্ব শান্তির উদ্দেশ্যে এক আবশ্যিক পদক্ষেপ বলে স্বাগতম জানিয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় - দোষীদের শাস্তি কে দেবে? পরোয়ানা জারি হওয়ার পরেও, ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে অনেক নির্দোষ নিহত। তারা শুধু সংখ্যা নয়; মানুষের মত মানুষ।