বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ কী বিনাশের পথে?

বিগত জুলাই মাসে বাংলাদেশে আরম্ভ হয়েছিল কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলনই ক্রমে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়, যা এক বীভৎস আকার নেয়। ছড়াতে থাকে হত্যার লীলা, জলতে থাকে পুরো দেশ। এই দৃষ্টান্ত দেখে স্মরণে আসে সেই ফরাসি লেখক ভিক্টর হ্যিগোর রচিত ‘লেস মিজরেবল’ উপন্যাসের বিবৃতিটি, “দেশে ছোটখাটো রাজদ্রোহের ঘটনা ঘটছে। গরম গরম লেখা কাগজে কাগজে, গরম গরম বক্তৃতা সভায় সভায়, সময়ে সময়ে রাজপথে সামান্য সংঘর্ষও পুলিশে ও নাগরিকে। বলা বাহুল্য, এ সব নাগরিকের অথিকাংশই ছাত্র। যে কোনো দেশে যে কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের পুরোভাগে স্থান নিয়েছে চিরদিনই এই দুঃসাহসী ছাত্রসমাজ”। বাস্তবেই তার সেই কথার জলজ্যান্ত প্রমান আবারও ফুটে উঠল আন্তর্জাতিক মহলে।

কিন্তু এই আন্দোলনের পেছনে কী কেবল ছাত্রদেরই হাত রয়েছে না এর নেপথ্যে রয়েছে কোনো মুখোস পড়া শক্তি? সোফোক্লিসের ‘আন্তিগোনে’ নাটকে আন্তিগোনের একটা সংলাপ ছিল। ‘উন্মত্ত জনতা আসলে একটা ভেড়ার পাল। কোনও শক্তি তাকে যেদিকে পরিচালিত করবে, প্রত্যেকে যুক্তিহীন মানসিকতা নিয়ে সেদিকেই অগ্রসর হবে।’ তার মানে কী সত্যিই এর পেছনে হাত রয়েছে সেই পাকিস্তান সমর্থিত রাজাকারদের যারা আজও চর রূপে নিজস্ব ক্রীয়াকার্য চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের হেফাজত জামাত ও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি(বিএনপি)-এর মতো ধর্মনিরপেক্ষ বিপক্ষীপন্থীদের হাত কি নেই? এই আন্দলোনে দেখা গিয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুরের বিশাল এক মূর্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করা, ধ্বংশ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম, গণভবনে হয়েছে তান্ডব ও লুঠতরাজ। ভেঙে ছারখার করে দেওয়া হয়েছে আওায়ামী পার্টি অফিসগুলি। আক্রমণ করা হয়েছে অনেক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। এই সকল দৃশ্য দেখে কী মনে হয়? সত্যিই কী এই আন্দোলনের নিশ্চিত অভিমুখ কোটা প্রত্যাহার ছিল? না! এটা  ছিল একটা উপলক্ষ্যমাত্র, একটা মুখোশ। যা পরবর্তী আন্দোলনে সেই মুখোশ খুলে গেল। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য মোটেই বৈষম্যের ও স্বজনপোষন বন্ধের ছিলনা বরং নেপথ্যে ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার বিনাশ। তারা, বাংলাদেশের সেই ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শকে ভাঙতে চাইছে যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ছিলেন একজন গান্ধীজীর ন্যায় ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব পন্থী মহান ব্যক্তিত্ব। তার কৃতীত্বের ফলে, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি স্তম্ভস্বরূপ হয়ে উঠেছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু বলতেন, স্বাধীন বাংলাদেশ হিন্দু মুসলিম, বাঙালি-অবাঙালি সকলের, প্রত্যেককে রক্ষা করাই প্রত্যেকের ধর্ম হবে। তাঁর স্বপ্ন ছিল, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় আন্দোলন যে জাতির মজ্জায়। তার স্বাধীন সত্তা প্রথিত হবে ধর্মীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে। সমাজে সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের অভ্যাস ও আচরণ থাকবে, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। দেশকে একসূত্রে বাঁধবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি-আশ্রয়ী উদার বাঙালিত্ব। অবশ্য সেই স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বিএনপি-জামাত জমানায়। যদিও বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই পূনরায় চলে তাঁর মেয়ে সদ্য প্রাক্তন প্র্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই মতাদর্শকে ফিরিয়ে আনতে প্রাণপণ চেষ্টা করে; যেটি ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়, সঙ্গে নিয়েই চলা, তবে মাথায় তুলে নয়। কিন্তু বড়ো দুঃখেরই বিষয় যে, সেই মতাদর্শটিও আজ অন্তর্ধান হতে চলেছে। কত আশ্চর্যনক ব্যাপার যে, আজকের প্রজন্ম সেই দেশ পিতার মূর্তি ভাঙছে। যে মানুষটা সাধারণ মানুষের হৃদগভীরে ও মনের অন্তরে স্বাধীনতা অর্জনের যে অভীপ্সা তার এক বীজ রোপন করে, একটা জাতিকে জাগিয়ে তুলে মুক্তি যুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে দিতে পেরেছিলেন। যে সোনার বাংলার স্বাধীনতার জন্য আহব্বান দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি, তখন রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব’। সেই মহান বীরপুরষকেই কয়েক বছরের মধ্যে গুলি করে মারা হয়েছিল ১৭৭৫সালের ১৫ই আগস্ট। আমাদের দেশেও তেমনি ঘটেছিল ১৯৪৮ সালে। স্বাধীনতার আঁতুড়ে গন্ধ তখনও দেশ থেকে মিলিয়ে যায়নি, তার মধ্যেই গুলি করে মারা হল গান্ধীজিকে। আসলে এটাই বোধহয় ইতিহাসের অন্ধ বিচার। বিপরীত শক্তির বুদ্ধি ভ্রংশ মানসিকতা এভাবেই বোধহয় দেশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে চায়। গান্ধীজি ছিলেন একজন ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবাপন্ন মানুষ। মুজিবুর রহমানও তাই ছিলেন। মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোকে তিনি সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের স্বপ্ন ছিল আবার বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে হবে। সেই অশুভ স্বপ্ন বহু বাংলাদেশির মনে তিনি গেঁথে দিয়ে ছিলেন। জিয়াউর রহমানের কৌশলে আবার বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল জামাতরা। ১৯৮৮-তে এরশাদ ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় ধর্ম বলে ঘোষণা করেছিল। এমনকি, ২০০১ সালেই মৌলবাদীরা ওসামা বিন লাদেনের ছবি নিয়ে মিছিল করেছিল। তাতে স্লোগান ছিল, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ আজ সত্যি আমরা দেখলাম ‘সোনার বাংলা’কে একদল ধর্মোন্মাদ আফগানিস্তান ও পাকিস্তান বানিয়ে তুলছে। আজ তারাই ছাত্র আন্দোলনের মুখোশ পরে সুর চড়িয়ে স্লোগান দিয়েছে, ‘ভারত যাদের মামাবাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি।’ গত মার্চে বিএনপিই এই ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগানটি তুলেছিল। অতএব, আওয়ামী রাজের পতন এবং জামাত, বিএনপি, প্রচ্ছন্ন পাকিস্তানের এই জোটের উত্থান অর্থই হল, চরম ভারত বিরোধিতার সূত্রপাত। অবশেষে প্রশ্ন জাগে; গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সংবিধানকে সম্মান জানাতে পারেনা যে আন্দোলন, সে কী একদিন নিজের রোষানলে নিজেই ছাই হয়ে যাবে না? বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ কী বিনাশের পথে?

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter