ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজায় প্যালেস্টাইনের ভূমি দখলের জন্য ইসরাইলি উপনিবেশের চেষ্টার বিশ্লেষণ

ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি উপনিবেশের প্রসার একটি দীর্ঘদিনের এবং জটিল বিষয়, যা প্যালেস্টাইনের ভূমি দখল করার জন্য ইসরাইলের ক্রমাগত প্রয়াসকে প্রতিফলিত করে। এই প্রসঙ্গে, আমরা দেখতে পাই যে, ইসরাইলের প্যাভলিক পরিকল্পনা একদিকে যেমন প্যালেস্টাইনের ভূমি দখল, অন্যদিকে তেমনি তাদের অধিকার বিস্তারের চেষ্টা। ইসরাইলের পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যে এ ধরনের পরিকল্পনা বর্ণিত এবং বাস্তবায়িত হয়েছে, এবং একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে পাল্টে উঠেছে। তাছাড়া, গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে যখন ইসরাইলি উপনিবেশবাদী কার্যক্রমের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হুমকির কারণে স্থানীয় জনগণের জীবনে বৈষম্য এবং সংকট সৃষ্টি হয়েছে। প্যালেস্টাইনের ভূমি দখলের জন্য ইসরাইলের ক্রমাগত উপনিবেশবাদী কার্যক্রম একটি অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা, যা শুধুমাত্র প্যালেস্টাইনি জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করছে না, বরং আন্তর্জাতিক আইনেরও স্পষ্ট লঙ্ঘন করছে। ইসরাইলের এই ভূমি দখল, বিশেষত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজায়, প্যালেস্টাইনের জনগণের বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘদিনের বৈষম্য এবং সহিংসতার ইতিহাসের অংশ। আন্তর্জাতিক আদালত এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন রায়ের মাধ্যমে এই দখলদারি কার্যক্রমের অবৈধতা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে, যা ইসরাইলের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিবাদকে প্রমাণিত করে।

ইসরাইলি উপনিবেশের ইতিহাস

ইসরাইলের উপনিবেশবাদী পরিকল্পনা ১৯৪৮ সালের পর থেকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর, ইসরাইল গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের অধিকাংশ ভূমি দখল করে নেয় এবং সেখানে বসতি স্থাপন শুরু করে। এই কর্মকাণ্ড ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৪২ নম্বর প্রস্তাবনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ইসরাইলের দ্বারা দখলকৃত অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার এবং প্যালেস্টাইনের জনগণের অধিকার রক্ষা করতে হবে। তখন ইসরাইল ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ গাজা উপত্যকায় বিস্তৃত হয়ে এর অধিকাংশ ভূমি দখল করে নেয়। তাদের লক্ষ্য ছিল ভূমির ওপর কৌশলগত আধিপত্য স্থাপন করা। তখন থেকেই গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইসরাইলি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য পদ্ধতিগত উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়।

ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস ও জাতিসংঘের সমালোচনা

২০০৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (ICJ) ইসরাইলের পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন এবং এর ফলে গঠিত দেওয়াল সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক রায় দেয়। আদালত স্পষ্টভাবে জানায় যে, ইসরাইলের এ কার্যক্রম আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষত চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে। এই রায় অনুযায়ী, ইসরাইলকে অবিলম্বে বসতি স্থাপন বন্ধ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্যালেস্টাইনের অধিকার রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, ইসরাইলের বসতি স্থাপন ও ভূমি দখলকে বারবার অবৈধ ঘোষণা করেছে। ২০১৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২৩৪৪ নম্বর প্রস্তাবনায় ইসরাইলের বসতি স্থাপনকে "আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ" হিসেবে অভিহিত করে এবং এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়া, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলও এই দখলদারিত্বকে বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

“তুফান আল-আকসা” এবং ইসরাইলি প্রতিক্রিয়া

প্যালেস্টাইনের প্রতিরোধ গোষ্ঠী, বিশেষত হামাস, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর "তুফান আল-আকসা" নামক একটি বড় আক্রমণ শুরু করে। এটি একটি ঐতিহাসিক প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করা হয়, যা ইসরাইলের ওপর বড় ধরনের আঘাত হানে। এই আক্রমণের মাধ্যমে গাজার গিলাফ গাজার মতো অঞ্চলগুলোর ওপর প্যালেস্টাইনিরা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, যা ইসরাইলের জন্য এক বড় ধাক্কা ছিল। হামাসের এই সফল আক্রমণ ইসরাইলি বাহিনীর দুর্বলতা এবং প্যালেস্টাইনের প্রতিরোধ শক্তির প্রমাণ দেয়। এর পর, ইসরাইলি সরকারের মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনঃপর্যালোচনা ও আরো শক্তিশালী করার চিন্তা বৃদ্ধি পায়।

গাজায় পুনরায় বসতি স্থাপনের চ্যালেঞ্জ

১৯৯৭ সালের পরে, যখন ইসরাইল গাজা থেকে সরে গিয়ে তার উপনিবেশগুলো গুঁড়িয়ে দেয়, তখন তারা ভাবতে শুরু করেছিল যে গাজার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে কিছু ইসরাইলি নেতৃবৃন্দ, যেমন বেন গিভির ও সমুত্রিচ, গাজায় পুনরায় বসতি স্থাপনের পক্ষে ছিল। কিন্তু গাজার ভূমি পুনরায় দখলের জন্য একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়:

১. প্রতিরোধের শক্তি: গাজার প্রতিরোধ বাহিনী প্রতিনিয়ত ইসরাইলের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যা পুনরায় বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়াকে দুরূহ করে তোলে।

২. কঠিন ভূগোল ও জনসংখ্যা: গাজায় ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস করে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই শরণার্থী। এই সংকীর্ণ এলাকা এবং উচ্চ জনঘনত্ব যে কোনো স্থায়ী বসতি স্থাপনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধক।

৩. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: গাজার ভূমি পুনরায় দখল করা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে, এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এই ধরনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাবে।

ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের উপর ইসরাইলি মনোযোগ

গাজার মতো ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেও ইসরাইলি বসতি স্থাপন অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছিল এবং এখন সেটি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের জমি ইসরাইলের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিকল্পনায় অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এতে করে ইসরাইলের নিরাপত্তা মুল্যায়ন এবং "ইসরাইলি ভূখণ্ড" প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়ে ওঠে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ৫ লক্ষাধিক ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারী রয়েছেন, যাদের অধিকাংশই অবৈধভাবে জমি দখল করে বসবাস করছে। ইসরাইলের উপনিবেশবাদী নীতির মূল ভিত্তি হল "পবিত্র ভূমি" অথবা "আল-আরদ আল-মিওয়াদ" ধারণা, যা বাইবেলের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এমনকি একাধিক ইসরাইলি নেতার মতে, গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ভূমি ইহুদি জাতির জন্য প্রাকৃতিকভাবে "অধিকার" এবং একে ইসরাইলের ইতিহাসের অংশ হিসেবে দেখানো হয়।

উপসংহার

এভাবে, ইসরাইলের ভূখণ্ড দখল এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজায় বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা কখনই সহজ নয়। বিশেষ করে গাজায় পুনরায় বসতি স্থাপন করার জন্য কয়েকটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যেমন প্রতিরোধ শক্তি, উচ্চ জনঘনত্ব এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া। প্যালেস্টাইনের অধিকার রক্ষার জন্য একসাথে কাজ করা এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আইনী সমাধানের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা একটি অপরিহার্য দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসরাইলের প্যালেস্টাইনের ভূমি দখল এবং বসতি স্থাপন কার্যক্রম শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, এটি আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবতার বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অপরাধ। আন্তর্জাতিক আদালত এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন রায় ইসরাইলের এই কার্যক্রমের অবৈধতা স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্যালেস্টাইনের জনগণের জন্য ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ইসরাইলের দখলদারি বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একত্রিত হয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একমাত্র পথ হল প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়া এবং ইসরাইলের অবৈধ উপনিবেশবাদী কার্যক্রমের অবসান ঘটানো।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter