ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা: নাওম চমস্কি ও ইলান পাপ্পে'র দৃষ্টিকোণ থেকে এক নতুন আলো
ভূমিকা
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব, একটি এমন বিষয় যা পৃথিবীজুড়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত। এর পেছনের ইতিহাস, রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং মানবিক বিপর্যয়ের এক গভীর বিশ্লেষণ পাওয়া যায় নাওম চমস্কি ও ইলান পাপ্পের যৌথ লেখনী “অন প্যালেস্টাইন” [On palestine] বইটিতে। এবং বইটি ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন এই সংঘাতের পেছনে দীর্ঘদিনের ইতিহাস, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলা লুকিয়ে আছে। “অন প্যালেস্টাইন” বইটি এই সমস্যা নিয়ে এক গভীর ও মানবিক বিশ্লেষণ প্রদান করেছে, যেখানে নাওম চমস্কি ও ইলান পাপ্পে তাদের অভিজ্ঞতা এবং গবেষণার ভিত্তিতে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংঘাতের পর্যালোচনা করেছেন।
বইয়ের সংক্ষিপ্ত সারাংশ
বইটি শুরু হয় ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘর্ষের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দিয়ে। চমস্কি এবং পাপ্পে প্যালেস্টাইন অঞ্চলের প্রাথমিক ইতিহাস, ব্রিটিশ উপনিবেশ, এবং ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া আলোচনা করেছেন, যা আজকের পরিস্থিতির মূল কারণ। তারা দেখিয়েছেন কীভাবে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল এবং কিভাবে এটি আজকের মানবাধিকার সংকটে পরিণত হয়েছে। এছাড়া ও চমস্কি এবং পাপ্পে, দুইজনই নিজেদের রাজনৈতিক এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বইটি লিখেছেন। চমস্কি, একজন মার্কিন দার্শনিক এবং সমালোচক, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং তার ভূমিকা নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। অন্যদিকে, পাপ্পে, একজন ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ, ইসরায়েলের সিয়োনিস্ট আন্দোলন এবং তার পক্ষ থেকে প্যালেস্টিনীয়দের প্রতি দমনমূলক নীতির সমালোচনা করেছেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বইটিকে আরও সমৃদ্ধ এবং বহুমুখী করে তুলেছে। চমস্কি বইটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন, যেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের অবিচল সমর্থনের সমালোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্যালেস্টাইনিদের অধিকার খর্ব করেছে এবং ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে সহায়তা করেছে। চমস্কি যুক্তরাষ্ট্রের অস্বচ্ছ নীতির প্রভাব এবং তার ফলাফলকে তুলে ধরেছেন, যা আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে বিপজ্জনক।
লেখক পরিচয়
ইলান পাপ্পে একজন প্রবাসী ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ এবং সমাজতান্ত্রিক কর্মী। তিনি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের কলেজ অব সোশ্যাল সায়েন্সেস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর প্যালেস্টাইন স্টাডিজের পরিচালক। নাওম চমস্কি একজন আমেরিকান অধ্যাপক এবং জনবুদ্ধিজীবী যিনি ভাষাবিজ্ঞান, রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং সামাজিক সমালোচনায় তার কাজের জন্য পরিচিত। কখনও কখনও 'আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের জনক' বলা হয়, চমস্কি বিশ্লেষণমূলক দর্শনের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব এবং জ্ঞানীয় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আর মজার বিষয় এই যে এরা দু'জনই ইহুদী ধর্মের সাথে জড়িত।
বইটির মূল বিষয়বস্তু
ইতিহাসগত প্রেক্ষাপট:- চমস্কি এবং পাপ্পে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘর্ষের মূল কারণ সম্পর্কে একটি ইতিহাসগত দৃষ্টিকোণ প্রদান করেন, যেখানে তারা ২০ শতকের শুরুর দিক, ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন এবং ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ঘটনা বিশ্লেষণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
লেখকরা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করেছে, কখনও কখনও শান্তি প্রচেষ্টার বা প্যালেস্টিনীয় অধিকার রক্ষার মূল্যেও, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারা বিশ্বরাজনীতি এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। বইটিতে চমস্কি ও পাপ্পে পশ্চিমা মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও আলোচনা করেছেন। তারা বলছেন, মিডিয়া প্যালেস্টাইন এবং ইসরায়েল বিষয়ে প্রায়ই একপেশে রিপোর্ট করে, যা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং ইসরায়েলের পক্ষকে পক্ষপাতমূলকভাবে সমর্থন করে। এই ধরনের প্রচারণা প্যালেস্টাইনিদের পক্ষে সহানুভূতি তৈরি করতে বাধা দেয়।
বইটির আকর্ষণীয় দিক
এই বইটি শুধু ইতিহাস বা রাজনীতি নিয়ে নয়, বরং মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং শান্তির একটি গভীর আলোচনাও করে। চমস্কি ও পাপ্পে মনে করেন, শান্তির জন্য একমাত্র পথ হলো প্যালেস্টিনীয়দের অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করা এবং মানবাধিকার ও সমতার ভিত্তিতে একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধান খোঁজা।প্যালেস্টাইন ইস্যুতে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বইটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পশ্চিমা মিডিয়ার ভূমিকাকে সামনে আনা, যেখানে সংবাদ মাধ্যম প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েল নিয়ে যে একপেশে প্রতিবেদন করে, তা কিভাবে জনমত গঠন করে এবং ইসরায়েলের পক্ষকে সমর্থন করে। যা ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘর্ষের ইতিহাস এবং এর সাথে জড়িত বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক গতিশীলতা সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। এই বইটি নাওম চমস্কি এবং ইলান পাপ্পে-এর মধ্যে কথোপকথনের মাধ্যমে প্যালেস্টাইন ইস্যু, ইসরায়েলি দখল, এবং আমেরিকার ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করেছে।
বইটির গুরুত্বপূর্ণ বার্তা
বইটির গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হলো, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাধান শুধুমাত্র রাজনৈতিক সমঝোতা নয়, বরং এটি মানবাধিকার, ন্যায্যতা ও স্বাধীনতার প্রশ্ন। নাওম চমস্কি এবং ইলান পাপ্পে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় আন্তর্জাতিক সমাজের অব্যাহত উদাসীনতার সমালোচনা করেছেন এবং ইসরায়েলের দখলদারিত্ব, পশ্চিমা শক্তির পক্ষপাতিত্ব ও মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা শান্তির পক্ষে একটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম এবং অধিকারকে গুরুত্ব না দিলে কোন প্রকৃত শান্তি আসবে না। বইটি পাঠকদেরকে বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং মানবিক সংকটের প্রতি আরও গভীরভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।
আমার মতামত
বইটি আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং চিন্তা উদ্রেককারী ছিল। নাওম চমস্কি এবং ইলান পাপ্পে এর মধ্যে কথোপকথনের মাধ্যমে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘর্ষের ইতিহাস, বর্তমান পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভূমিকা সম্পর্কে একটি গভীর বিশ্লেষণ পেয়েছি। বইটি পড়ে আমি প্যালেস্টাইনির মানবাধিকার এবং স্বাধীনতার সংকট সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে উঠেছি। বিশেষত, চমস্কি এবং পাপ্পে-এর দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে বিষয়টিকে নতুনভাবে দেখতে সাহায্য করেছে। চমস্কি যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এবং তার নীতির সমালোচনা করেছেন, সেখানে পাপ্পে ইসরায়েলি দখল ও সিয়োনিজমের বিপক্ষে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলেছেন।এই বইটি আমাকে প্রশ্ন করতে এবং বিষয়টি সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছে। আমি মনে করি, এটি প্রতিটি পাঠকের জন্য অপরিহার্য, যারা বিশ্ব রাজনীতি, মানবাধিকার এবং ন্যায্যতার বিষয়ে সচেতন হতে চান। "অন প্যালেস্টাইন" কেবল একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নয়, বরং এটি একটি মানবিক আবেদন, যা আমাদের প্যালেস্টাইনিদের অধিকার রক্ষায় আরও সক্রিয় এবং সচেতন হতে উৎসাহিত করে।
কেন পড়া উচিত?
প্যালেস্টাইন ইস্যু সম্পর্কে সঠিক, নিরপেক্ষ এবং বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিকোণ পেতে “অন প্যালেস্টাইন” বইটি একটি অপরিহার্য রচনা। এটি আপনাকে ইসরাইল-প্যালেস্টিন সংঘাতের গভীরে নিয়ে যাবে এবং আপনাকে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকটগুলোর মধ্যে একটি সম্পর্কে ভাবতে উৎসাহিত করবে। এছাড়া ও বইটি পশ্চিমা বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তা, আন্তর্জাতিক রাজনীতির পক্ষপাতিত্ব, এবং মিডিয়ার ভূমিকাকে সমালোচনা করে, যা পাঠকদেরকে সংঘাতের গভীরে পৌঁছাতে এবং একটি ন্যায্য সমাধানের জন্য সচেতন করতে উৎসাহিত করবে।
মূল্যায়ণ
“অন প্যালেস্টাইন” বইটি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের এক গভীর ও বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণ, যা শুধু রাজনৈতিক ইতিহাস নয়, বরং মানবাধিকার এবং ন্যায্যতার প্রশ্নও তুলে ধরে। চমস্কি এবং পাপ্পে, তাদের প্রখর দৃষ্টিভঙ্গি ও গবেষণার মাধ্যমে, বিশ্বকে জানাতে চেয়েছেন যে, ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও স্বাধীনতা কেবলমাত্র রাজনৈতিক সমঝোতা নয়, বরং একটি মানবিক সংকট, যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত শান্তি সম্ভব নয়। তারা পশ্চিমের নিষ্ক্রিয়তা এবং ইসরায়েলের দখলদারিত্বের প্রতি বিশ্বব্যাপী সমর্থনকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন এবং একটি ন্যায্য শান্তির পক্ষে গভীর আহ্বান জানিয়েছেন। "অন প্যালেস্টাইন" পাঠককে শুধুমাত্র একটি সংঘাতের ইতিহাস জানায় না, বরং এটি একটি মানবিক আন্দোলনের আহ্বানও, যেখানে মানবাধিকার, ন্যায্যতা, এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীজুড়ে সকলের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।আশা করি পাঠকরা অবশ্যই পছন্দ করবেন বর্তমান সময়ে বেশ সাড়া জাগানো বই এটি।