শান্তির খোঁজে: দক্ষিণ কোরিয়ার পপ তারকা থেকে মুসলমান – দাউদ কিমের জীবনের গল্প
জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যা মানুষকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। কোনো এক ঘটনাবহুল সময়, কিছু অনুভব, কিংবা সত্যের খোঁজে একাকী যাত্রা—এইসবই মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার তরুণ গায়ক এবং ইউটিউবার কিম কিউন-উ, যিনি পরবর্তীতে ‘দাউদ কিম’ নামে পরিচিত হন, এমনই এক হৃদয়গ্রাহী পরিবর্তনের সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর নিজের জীবনে। একসময় তিনি ছিলেন নামকরা K-pop তারকা, তাঁর ছিল হাজার হাজার ভক্ত, স্বপ্নের মতো ক্যারিয়ার। কিন্তু সেই ঝলমলে জীবনের আড়ালেও কোথাও যেন একটা ফাঁকা জায়গা ছিল, একধরনের অস্থিরতা। সেই অস্থিরতার জবাব খুঁজতে খুঁজতেই তিনি একদিন পৌঁছে গেলেন শান্তির সেই পথে—যার নাম ইসলাম।
তবে এই যাত্রার শুরুটা এমন ছিল না। বরং, ছোটবেলা থেকেই দাউদ কিমের মনে ইসলাম সম্পর্কে গেঁথে গিয়েছিল ভয় আর ঘৃণার এক চিত্র। তিনি পশ্চিমা মিডিয়া এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতি থেকে যা শিখেছিলেন, তাতে ইসলাম ছিল এক হিংস্র ধর্ম, মুসলমান মানেই সন্ত্রাসী, ধর্মান্ধ এবং কঠোর। তাঁর মতে, “আমি আগে ভেবেছিলাম মুসলমানরা সবসময় যুদ্ধ করে। ওদের ধর্মটা ভয়ংকর।” এটাই ছিল তাঁর মনে গড়ে ওঠা ইসলাম সম্পর্কে প্রথম ধারণা।
কিন্তু জীবন তাঁকে নিয়ে যায় এমন এক জায়গায়, যেখানে সব ভুল ধারণা ভেঙে পড়ে। যখন তিনি মুসলিমদের বাস্তব জীবনে দেখেন, তাদের ভালোবাসা, নম্রতা, আতিথেয়তা অনুভব করেন—তখন তিনি নিজেই চমকে যান। তাঁর মনের মধ্যে তৈরি হওয়া সেই নেতিবাচক ছবির সাথে মুসলিমদের আসল আচরণের ছিল আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর নতুন চিন্তা, এক নতুন যাত্রা—যেটা পরে তাঁকে এনে দেয় জীবনের সবচেয়ে বড় শান্তি।
দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজব্যবস্থা ও দাউদের শৈশব জীবন
দক্ষিণ কোরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে আধুনিকতা, প্রযুক্তি এবং বিনোদনের এক বিশাল দুনিয়া তৈরি হয়েছে। তরুণরা সেখানে ছোটবেলা থেকেই প্রতিযোগিতার মধ্যে বেড়ে ওঠে—ভালো নম্বর, ভালো চাকরি, অথবা মিডিয়াতে বড় হওয়া—এসব নিয়েই তাদের স্বপ্ন। ইসলাম বা ধর্মীয় মূল্যবোধ সেখানে খুব একটা আলোচনার বিষয় নয়। আর মুসলমানদের নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে অনেক ভুল ধারণা ও ভয় কাজ করে, বিশেষ করে পশ্চিমা মিডিয়া থেকে যেসব বার্তা আসে, তার প্রভাব কোরিয়ার সমাজেও পড়ে।
এই সমাজেই বড় হয়েছেন কিম কিউন-উ। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তাঁর এক ধরনের ভালোবাসা ছিল। স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে তিনি গিটার বাজাতেন, গাইতেন, আর স্বপ্ন দেখতেন একদিন বড় মিউজিক স্টার হবেন। তাঁর সেই স্বপ্ন সফলও হতে থাকে—K-pop ট্রেইনি হিসেবে তিনি প্রশিক্ষণ নেন, টিভিতে আসেন, ইউটিউবে জনপ্রিয়তা পান। কিন্তু এই চকচকে জীবনের পেছনে একটা প্রশ্ন সবসময় তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াত—‘আমি সত্যিকারের সুখী তো?’ সেই উত্তর খুঁজতে গিয়েই শুরু হয় তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায়।
মুসলিম সমাজের সঙ্গে প্রথম পরিচয় এবং ইসলামের প্রতি ভালো লাগা
যখন দাউদ কিম প্রথম মুসলিম দেশের মানুষের সংস্পর্শে আসেন, তখন তাঁর ভেতরের অনেক ধরণের সন্দেহ ভেঙে যায়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দুবাই—এই দেশগুলোতে ভ্রমণের সময় তিনি কাছ থেকে মুসলিমদের জীবনধারা দেখতে পান। প্রথমদিকে তিনি ভেবেছিলেন মুসলমানরা হয়তো রুক্ষ, কঠোর বা ভীতিকর হবে—কারণ ছোটবেলা থেকে মিডিয়া তাঁকে সেভাবেই শিখিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে যা দেখলেন, তা সম্পূর্ণ উল্টো। মুসলমানরা ছিলেন অতিথিপরায়ণ, বিনয়ী, সদয় এবং অত্যন্ত আন্তরিক।
আসলে দাউদের ইসলাম সম্পর্কে ভয় আর ভুল ধারণাগুলো তৈরি হয়েছিল পশ্চিমা মিডিয়া থেকে পাওয়া তথ্য দিয়ে। ছোটবেলায় তিনি পশ্চিমা টিভি চ্যানেল ও সংবাদের মাধ্যমে বারবার শুনেছেন—ইসলাম একটা হিংস্র ধর্ম, মুসলমানরা সহিংস, রক্তপিপাসু এবং সবসময় যুদ্ধ নিয়ে থাকে। তাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল, “মুসলিম” শব্দটা মানেই যেন সন্ত্রাসী। তিনি বলেছিলেন, “আমি ভেবেছিলাম ইসলাম মানেই যুদ্ধ আর ভয়।” এই ভয়ের চিত্র আরও প্রবল হয়েছিল ৯/১১-পরবর্তী বিশ্বে, যখন মিডিয়াতে মুসলমানদের সবসময় নেতিবাচকভাবে দেখানো হতো।
কিন্তু যখন বাস্তবে তিনি মুসলিমদের সাথে দেখা করলেন, কথা বললেন, তাদের আতিথেয়তা, ব্যবহার ও নম্রতা দেখলেন—তখন তাঁর মনের সব ভয় এক এক করে ভেঙে যেতে লাগলো। তিনি ভাবলেন, “এরা কি সেই মানুষ, যাদের নিয়ে মিডিয়াতে এত ভয় দেখানো হতো?” তাঁর এই বাস্তব অভিজ্ঞতাই তাঁর চিন্তার পুরো ধারা পাল্টে দেয়।
কুরআন পাঠ এবং আত্মার মধ্যে শান্তির উন্মেষ
ইসলামের প্রতি এই আকর্ষণ শুধু বাহ্যিক ভালো লাগায় থেমে থাকেনি। দাউদ কিম ঘরে ফিরে এসে ইন্টারনেটে কুরআনের ইংরেজি অনুবাদ পড়তে শুরু করেন। তিনি ইউটিউবে ইসলামিক বক্তাদের বক্তব্য শোনেন, বিভিন্ন মুসলিম স্কলারদের ব্যাখ্যা বোঝার চেষ্টা করেন। ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে শুরু করেন—ইসলাম শুধু কিছু নিয়মের ধর্ম না, বরং এটা একটা পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যেখানে মানুষের আত্মা, চিন্তা, ব্যবহার, সমাজ—সবকিছুই একটি ভারসাম্যের মধ্যে থাকে।
তাঁর সবচেয়ে ভালো লেগেছিল ইসলামের "তাওহীদ" বা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস। তিনি বলেন, “এই একেশ্বরবাদ আমাকে এক অসাধারণ শান্তি দিয়েছে। আমি এখন জানি, আমার একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, যিনি আমার সবকিছু জানেন, আমাকে ভালোবাসেন, এবং তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন।” এই বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে তাঁর ভেতরের দুঃখ, হতাশা, একাকীত্ব—সব কেটে যেতে শুরু করে। যেন এক নতুন আলো তাঁর জীবনে প্রবেশ করলো।
ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত এবং এক সাহসী পদক্ষেপ
যখন তাঁর মনে ইসলামের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে যায়, তখন দাউদ কিম সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলমান হবেন। যদিও বিষয়টা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। এক অমুসলিম সমাজে, তারকা জীবন কাটিয়ে, নিজের বিশ্বাস বদলানো—এটা অনেক সাহসের কাজ। তবুও তিনি ঠিক করেন, জীবনের সত্যের জন্য যদি জনপ্রিয়তা ছাড়তে হয়, তাহলেও তিনি রাজি।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি কালেমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। নতুন নাম নেন—দাউদ কিম। সে মুহূর্তটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে আবেগময় ছিল। তিনি বলেন, “শাহাদাহ পড়ার পর মনে হলো, আমি যেন নতুন জন্ম নিলাম। আমার ভিতরটা যেন একদম পরিষ্কার হয়ে গেল।” অনেকেই তাঁকে সমালোচনা করেছে, অনেকে সন্দেহ করেছে, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল অটুট। তিনি বলেন, “মানুষের নয়, আমি আল্লাহর জন্য এই পথ বেছে নিয়েছি।”
রমজানের রোজা, ওমরাহ এবং আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি প্রথমবার রমজান মাসে রোজা রাখেন। রোজা রাখা শরীরের জন্য কষ্টকর হলেও তাঁর মনে ছিল প্রশান্তি। তিনি বলেন, “রোজার সময় আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, কিন্তু আমার মন এত শান্ত ছিল, যা আগে কখনো অনুভব করিনি।” এরপর সুযোগ পেয়ে তিনি সৌদি আরবে যান এবং পবিত্র মক্কায় গিয়ে ওমরাহ পালন করেন।
কাবা শরীফের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমি এখানে আছি। আমি আল্লাহর ঘরে এসেছি! এটা আমার জীবনের সবচেয়ে সৌভাগ্যের মুহূর্ত।” ওমরাহ তাঁর জীবনে আরও একধাপ আত্মিক পূর্ণতা নিয়ে আসে।
নিজের দেশে মসজিদ গড়ার স্বপ্ন ও ইসলামের দাওয়াহ
দাউদ কিম শুধু নিজের জন্য ইসলাম গ্রহণ করে থেমে যাননি। তিনি চেয়েছেন যেন দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যান্য মানুষও ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে, ভুল ধারণা ভাঙতে পারে। এজন্য তিনি ইনচিওন শহরে জমি কিনে একটি মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার বানানোর উদ্যোগ নেন। সেখানে নামাজ পড়ার জায়গা থাকবে, ইসলামের ক্লাস হবে, এবং অনলাইনে দাওয়াহ করার জন্য মিডিয়া স্টুডিও গড়ে তোলা হবে।
তিনি এক ভিডিওতে বলেন, “আমি চাই, একদিন কোরিয়ার রাস্তায়ও আজানের সুমধুর ধ্বনি শোনা যাবে। মানুষ ইসলামকে ভয় না করে, ভালোবাসবে।” এই কথা শুনে হাজারো মানুষ তাঁর কাজকে সমর্থন জানায়, মুসলমানরা তাঁর পাশে দাঁড়ায়।
পরিবার ও বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া—পরিবর্তনের পরে সম্পর্ক
ইসলাম গ্রহণ করার পর দাউদের পরিবার প্রথমদিকে খুব অবাক হয়ে যায়। তাঁর অনেক বন্ধু দূরে সরে গিয়েছিল, কেউ কেউ খারাপ মন্তব্যও করেছিল। কোরিয়ার মতো ধর্ম নিরপেক্ষ এবং সংস্কারপন্থী সমাজে একজন মুসলমান হওয়া অনেক সময় প্রশ্নের জন্ম দেয়। তবে দাউদ কিম কখনো রাগ করেননি। বরং ধৈর্য ধরে সবার সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন।
তিনি পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন—ইসলাম তাঁকে খারাপ করেনি, বরং আরও ভালো মানুষ বানিয়েছে। ধীরে ধীরে পরিবারের অনেকে বিষয়টা বুঝতে শুরু করে। তাঁর মা, যিনি একসময় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, এখনো ইসলামে আসেননি, কিন্তু ছেলের এই বদলে যাওয়া ব্যবহার তাঁকে ভাবায়। বন্ধুরাও যারা আগে দূরে ছিল, ধীরে ধীরে আবার যোগাযোগ করতে শুরু করে।
এক নতুন জীবনের সুর
দাউদ কিমের জীবনযাত্রা একটা প্রমাণ—মানুষের আসল শান্তি শুধু বাহ্যিক সফলতায় আসে না। টাকা, খ্যাতি, জনপ্রিয়তা—সবই থাকলেও যদি আত্মা খালি থাকে, তবে সেটা পূর্ণতা নয়। আর ইসলাম সেই শূন্য আত্মাকে পূর্ণ করে। আজ দাউদ কিম একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বজুড়ে দাওয়াহর কাজ করছেন। তিনি যেভাবে ইসলামের সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করেছেন, তা অন্যদের কাছেও পৌঁছে দিতে চান। তাঁর জীবনের এই পথ আমাদের শেখায়—যদি মন থেকে সত্য খোঁজি, আল্লাহ আমাদের পথ দেখান।