বাংলার জঙ্গল মহল - মন্দির রাজনীতির নতুন রণক্ষেত্র

রাম মন্দির প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক রায় দেওয়ার প্রায় তিন বছর আগে ২০১৭ সালের ২৩শে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি মহকুমার একটি পুরনো অটোরিকশা গ্রামের ধুলো মাখা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। শিউলিবোনা গ্রামের সাঁওতালি ছেলেমেয়েরা ওটাকে তাড়া করছিল এবং গতি বাড়ার সাথে সাথে আমি পরের দিন জামশালা গ্রামের কাছে একটি হনুমান মন্দিরের জাঁকজমক উদ্বোধনের ঘোষণা শুনতে পেলাম।

বাচ্চারা যেমন উত্তেজিত ছিল, তেমনি আমার প্রধান তথ্যদাতা জামশালার শ্যামল মান্ডিও শিউলিবোনার পরিবর্তে তাদের গ্রামে মন্দির নির্মাণের বিষয়ে উত্তেজিত ছিল। পরদিন রবন শোরেন নামে এক মধ্যবয়সী আদিবাসী ভদ্রলোকের সাথে সাক্ষাৎ হলো। তিনি আমাকে শিউলিবোনার আধা-ধর্মীয় হিন্দু কেন্দ্র 'সামায়িতা মঠ'-এর প্রসঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

‘সামায়িতা মঠ’ একটি উন্মুক্ত প্রার্থনা হলঘর চালায় এবং গ্রামে একটি রাস্তার পাশে মন্দিরের মতো মারাং বুরু নামে কাঠামো স্থাপন করেছে । সুশুনিয়া পাহাড় থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাঁওতালি দিশাম মন্দির যেটি সাঁওতাল ঐতিহ্যের ধর্মীয়- রাজনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। মন্দিরে তিনটি নির্মিত পাথর রয়েছে এবং এখন একটি নিমজ্জনযোগ্য পাম্প সেট লাগানো হয়েছে যা দর্শনার্থীদের প্রাথমিক সুযোগ-সুবিধাগুলি পাওয়ার জন্য একটি ওভারহেড ট্যাঙ্ক। রবন বলেন, “এগুলো সবই সম্প্রতিক উন্নতি।”

 ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর, পুরুলিয়া থেকে রাঁচির যাওয়ার সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৈরি এবং স্থানীয় স্বনির্ভর গোষ্ঠী পরিচালিত চশমোরের পাথরসাথী হোটেলে থাকার সিদ্ধান্ত নিই। হোটেলে কক্ষ অতি সহজেই পেয়ে গিয়েছিলাম যেহেতু সেই সময় মহামারীর ফলে বেশি ভ্রমনকারী আসত না। পথিমধ্যে প্রতিটি গ্রাম পার হতেই একটি করে হনুমান মন্দিরের মুখোমুখি হলাম। স্থানীয় এক যুবক আমার ভ্রমণ সঙ্গী ছিল যার নাম সুকুমার হাঁসদা, সে  আমার কৌতূহল দেখে বলল, "প্রথমে তারা একটি হনুমান মূর্তি রেখেছিল। তারপরে একটি বেদী এবং পরিশেষে একটি মন্দির তৈরি করে ছিল। ‘ওরা’ বলতে কারা জানতে চাইলে তিনি বলতে থাকেন, “হিন্দুরা ... তারা অনেক। বজরং দল, দুর্গা শক্তি, বনবাসী কল্যাণ আশ্রম....।”

আমরা বুঝতে পারলাম যে, হোটেলটি দুটো মন্দিরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। একটি ডুমারডিহ উপার পাড়ায় এবং অন্যটি ভেলাইডিহিতে। গ্রামের একটু ভেতরে তানাসিতে আরও একটি ছিল। তিনটিই লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ২০১৯ সালে প্রায় রাতারাতি নির্মাণ করা হয়েছিল। তার আগে সেখানে হনুমান মূর্তির উন্মুক্ত সংস্থাপন ছিল।

এই তিনটি গ্রামে মিশ্র জনসংখ্যা রয়েছে। হিন্দু অধ্যুষিত কয়েকটি সাঁওতাল জনগোষ্ঠী এবং উত্তর দিকে একটি ছোটখাটো মুসলিম বসতি রয়েছে। তিনটি মন্দির একটি লাউডস্পিকারে হনুমান চালিশা এবং রামায়ণ চালিত করেছিল যার মুখ ছিল মুসলিম বসতির দিকে। দৃশ্য দেখে ভয় পেয়েছিলাম। আমার প্রথম পরিদর্শনের সময় মুসলমানদের কেউই মন্দির সম্পর্কে কিছু বলেনি। তারা বলতেন যে, এই ধরনের নির্মাণ বা লাউডস্পিকার তাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করেনা যা আমার শহুরে কানের কাছেও বেশ কোলাহলপূর্ণ ছিল।

গত কয়েক বছর ধরে গ্রাম ঘুরে আমি জানতে পারি যে, তিনটি মন্দিরই গ্রামবাসীদের কাছ থেকে চাঁদার টাকা নিয়ে নির্মিত হয়েছিল যার মধ্যে হিন্দু ও সাঁওতাল উভয়ই ছিল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) এবং জয়পুরের বজরং দলের লোকেরা মন্দির নির্মাণের জন্য গ্রাম পর্যায়ে স্বেচ্ছা সেবক নিয়োগ করেছিল এবং এখন তারা মন্দির কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়।

সেই সময় সন্ধ্যাগুলি মন্দিরের জায়গার কাছে ভালভাবে কাটানো হত। মহন্ত (প্রধান পুরোহিত) রাম ও হনুমানের উপাসনা করেন ও মহান শক্তির গল্প বর্ণনা করেন। গ্রামবাসীদের বলা হয় যে সুদূর অতীতে তারা স্থানীয় রাজা এবং তাদের সুন্দরী কন্যাদের 'নির্মম মুসলিম শাসকদের' দ্বারা অপহরণের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।

জঙ্গল মহলের পটভূমি

২০০৮-২০১১ সালের মধ্যে জঙ্গল মহল (পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলা) স্বাধীন ভারতে হিংসার অন্যতম রক্তাক্ত পর্ব দেখেছিল। এই সময়কালে মোট ৫০৫ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছিল।

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি জার্নাল নিবন্ধে একটি অনুদৈর্ঘ্য, মিশ্র পদ্ধতি অধ্যয়নের উপর ভিত্তি করে আমরা রিপোর্ট করেছি যে, গৃহযুদ্ধের পরপরই বিদ্রোহী সারিবদ্ধ দল জয়লাভ করলেও তাদের ধারাবাহিকতা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির দ্বারা ব্যবহৃত সহিংসতার প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। জঙ্গলমহলের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে কিষেণ জি ও তাদের সহযোগী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী ) বা সিপিআই(এম) নিয়ন্ত্রিত হরমাদ বাহিনীর মৃত্যুর পর মাওবাদী বিদ্রোহীদের আকস্মিক অন্তর্ধান সাংগঠনিক শূন্যতার সৃষ্টি করে। এই শূন্যতা কখনই পূরণ করা হয়নি এবং ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) সরকার স্থানীয় সরকারের অনির্বাচিত অস্ত্র ব্যবহার করে অতি-উন্নয়ন হিসাবে অভিহিত করেছে।

সংগঠনের অনুপস্থিতির এই মুহুর্তেই জঙ্গল মহলে হনুমান মূর্তি এবং মন্দিরের বিস্তার ঘটেছিল। একল বিদ্যালয় এবং বনবাসী কল্যাণ আশ্রমের সমন্বয়ে রাম নবমীর মিছিল শীঘ্রই তৃণমূলের দ্বারা নবনির্মিত রাস্তায় প্রবেশ করে।

হিন্দুত্ববাদের দৈনন্দিন চিত্র

জনপ্রিয় সমর্থনে মন্দিরের রাজনীতি বরং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জন্য নির্বাচনী লভ্যাংশ অর্জনে সফল হয়েছে। জঙ্গলমহলের চারটি প্রধান সংসদীয় আসনে বিজেপি আশ্চর্যজনকভাবে নির্বাচনী সমর্থনের ভিত্তি বৃদ্ধি করে জিতেছে।

বিজেপির ভোট ২০১৪ সালের তুলনায় বাঁকুড়ায় ১৪.৪ শতাংশ, পুরুলিয়াতে (৪২.১%), বিষ্ণুপুরে (৩২.১%) এবং ঝাড়গ্রামে (৩৪.৮ শতাংশ) বেড়েছে। কিন্তু বিজেপির জয়কে শুধু মন্দিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করা অপরিপক্ক হবে। তৃণমূলের ব্যর্থতার কারণও রয়েছে। যাইহোক, মন্দিরের রাজনীতি একটি সাধারণ শত্রু (মুসলমানদের) বিরুদ্ধে ভোটারদের একটি ভিন্ন গোষ্ঠীকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, একটি সাধারণ কারণের জন্য তা হল 'ভারতের সত্যিকারের আত্মার সন্ধান' এবং 'হিন্দুরা বিপদে রয়েছে' এই সাধারণ নিরাপত্তাহীনতার জন্য ।

আমার চলমান নৃতাত্ত্বিক কাজটি হিন্দুত্ববাদী আদর্শে মানুষের সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করার একটি প্রয়াস। স্বল্প-তীব্র দাঙ্গার মাধ্যমে প্রতিদিন মেরুকরণ যা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মৌলবাদী মনোভাবের ব্যাপক বিস্তার ঘটায় তা যদি একটি প্রক্রিয়া হয়, তবে উদ্ভাবিত ঐতিহ্য অন্য প্রক্রিয়া ।

এর সমান্তরালে জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রামগুলির গ্রামবাসীদের মধ্যে হিন্দুত্ববাদী ভাবমূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে। রাম নবমীর শোভা যাত্রা আবিষ্কারের আগে, যা প্রায়শই দাঙ্গার সৃষ্টি করে, এই মন্দিরগুলি পশ্চিমবঙ্গের বিশাল হিন্দুত্ববাদী মডেলের প্রাথমিক 'লোগো' এবং প্রবেশদ্বার হিসাবে কাজ করেছিল।

আজ জঙ্গল মহল অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামে একটি করে হনুমান মন্দির রয়েছে। উজ্জ্বল কমলা পতাকা এবং তুলনামূলকভাবে ছোট হনুমান মূর্তিগুলি শীতলা এবং মনশা কাল্টের প্রাক-বিদ্যমান মন্দিরগুলিতে রাখা হয় যা অনাদিকাল থেকে গ্রামবাসীদের দ্বারা পূজা করা হয়। স্থানিক এবং সীমানা নীতিগুলি ঐতিহ্যবাহী মন্দিরগুলির সাথে সংযুক্ত এবং তাদের প্রত্নতাত্ত্বিক ধারাবাহিকতা এবং তাৎপর্য অপরিসীম।

বলাই বাহুল্য, এগুলোর আরাধনায় মানুষের মনে এক বিশেষ জায়গা তৈরি হয়েছে। এটি ছিল দয়ালু স্থানীয় দেবীর দৈনন্দিন রূপ যাকে সাপের কামড় এবং সংক্রামক রোগ থেকে মানুষের রক্ষাকারী হিসেবে মনে করা হয়। তারা কখনোই হিন্দুত্ববাদী আদর্শের অংশ ছিল না। এই দেবীদের সাধারণত এই গ্রামের মহিলারা পূজা করেন এবং পুরুষরা তাদের পাশে একটি হনুমান মূর্তি স্থাপন করা কেবল নারীর মধ্যে পুরুষত্বের অনুপ্রবেশ নয়, গ্রাম দেবতাদের লোকজ ঐতিহ্যে পুরুষতান্ত্রিক হিন্দুত্ববাদী চিন্তার প্রবর্তনও করে ।

বেশ কয়েকটি গ্রামে হনুমান মূর্তি পবিত্র উপবনগুলিতে বর্তমানে বিদ্যমান। এটিকে মহিলারা সহ গ্রামবাসীরা অস্বাভাবিক মনে করেননি। হনুমানের গল্পগুলি মৌখিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে এবং স্কুল স্তরের পাঠ্যগুলিতে বর্ণিত হচ্ছে। গঙ্গাজলঘাটির এক মহিলা গত বছর আমার সফরের সময় গ্রামবাসীদের মধ্যে নৈমিত্তিক কথোপকথনের সময় বলে ছিলেন যে "গ্রামে পবনপুত্র থাকলে ক্ষতি নেই, সে একজন হিন্দু দেবতা এবং আমাদের তাঁর উপাসনা করা উচিত"।

সুতরাং, আখ্যানের দ্বারা হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের মধ্যে তার ভিত্তি প্রসারিত করছে যা বিজেপি এবং আরএসএস তৈরিতে এত সফল হয়েছে। আমরা জানি, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ এখানেই থেমে থাকবে না, হয়তো এটা তাদের পরিকল্পনার শুরু মাত্র। আর জঙ্গলমহলের মন্দিরের রাজনীতি বিজেপিকে বেশ কয়েকটি আসন দখলে সাহায্য করেছে , এটি সফলতার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। ২২ জানুয়ারি ক্রূদ্ধ হনুমান ও রাম চিত্রের উজ্জ্বল কমলা রঙের পতাকায় সজ্জিত বন ও মন্দিরগুলি এই মানুষগুলোর সাংস্কৃতিক-জ্ঞানীয় মাত্রায় আরও প্রভাব ফেলেছে।

লেখক পরিচিতি

সুমন নাথ, ডঃ এপিজে আবদুল কালাম গভার্মেন্ট কলেজে নৃতত্ত্বের (অ্যানথ্রোপোলজি) শিক্ষক এবং “ডেমোক্রেসি অ্যান্ড সোশ্যাল ক্লিভেজ ইন ইন্ডিয়া এথনোগ্রাফি অব রায়টস, এভরি ডে পলিটিক্স অ্যান্ড কমিউনালিজম ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল” সি.২০১২-২০২১ বইয়ের লেখক।

(Translated by : Shahadat Alam)

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter