প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তায়ালার মানব সম্প্রদায়ের সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী? 

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। যার নিজস্ব মান মর্যদাবোধ ও হুশ-জ্ঞান আছে তাকে মানষ বলে অভিহিত করা হয়। এই মানুষকে আল্লাহ তায়ালা সর্বোত্তম আকৃতি দিয়ে নিঁখুতভাবে তৈরি করেছেন। পৃথিবীতে অদ্য কোটি কোটি মানুষ বসবাস করে এবং কোটি কোটি মানুষ এই ধ্বংশলীল পৃথিবীতে থেকে বিদায় নিয়েছে। অর্থাৎ মানুষ জন্ম নিচ্ছে আবার মৃ্ত্যুর স্বাদও গ্রহন করছে। এই বিধি নিয়েই দুনিয়া সমীপে গমন হতেই থাকছে। তবে মহান আল্লাহ তায়ালা এই মানব সম্প্রদায়কে কেনই বা সৃষ্টি করলেন? কেবল সৃষ্টিই করেননি বরং সর্বোত্তম করে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এর উদ্দেশ্যটাই বা কী? নিশ্চয় এর পিছনে কোনো না কোনো একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। যেহেতু আমরা যদি কোনো কিছু তৈরি করে থাকি তবে তার পেছনে কোনো না কোনো কারন থাকেই থাকে। যেমন আমরা যদি একটি গাড়ি তৈরি করি তবে এর পেছনে একটি উদ্দেশ্য অবশ্যই থাকে আর সেটি হলো যে যানবাহনটি আমাকে কোনো এক জায়গা থেকে অনত্রে অতি অল্প সময়ে পৌছে দেবে। 

এছাড়া আল্লাহ তায়ালাও কুরআন মাজিদের সুরা মুমিনুনের ১১৫ নং আয়াতে ঘোষনা করছেন:

أفحسبتم أنما خلقناكم عبثا 

“তোমরা কী মনে কর আমি তোমাদের অনর্থক সৃষ্টি করেছি”। (সুরঃ মুমিনুন, আয়াত ১১৫)

তিনি সুরা আন্বিয়ার ১৬ নং আয়াতে আরও বলছেন: 

“আসমান যমিন এবং এ দুইটির মাঝে যা কিছু আছে সে সব আমি তামাশা বা ক্রিয়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি”।

অনত্র আবারও বলেছেন: “আমি ও দুটিকে যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না”। [সুরঃ দুখান ৩৮-৩৯]

সুতরাং, উপরুক্ত আয়াতগুলি থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে অকারনে বা অনর্থক সৃষ্টি করেননি। কিন্তু সেই উদ্দেশ্যটি বা কারনটি কী?

এর উত্তরে আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদের সুরা যারিয়াতের ৫৬ নং আয়াতে ঘোষনা করছেন:

وما خلقت الجن والإنسان إلا ليعبدون    

অর্থাৎ, আমি জিন ও মানুষকে তৈরি করেনি ব্যতিত ইবাদতের জন্য। অতএব আল্লাহ তায়ালার মানব সম্প্রদায়ের সৃষ্টির কারণ হল তিনার ইবাদত বন্দেগী করা। কিন্তু কী এই ইবাদত? নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত, কুরবানী, জিকির আজকার, তাসবীহ-তাহলীল, কুরআন তেলাওয়াত করার নামই কী ইবাদত? চলুন জানা যাক, প্রকৃত ইবাদত বলতে কী?

ইবাদাতের অর্থ ও সংজ্ঞা :

আরবী ইবাদাহ (عبادة) শব্দটি আব্দ (عبد) শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ হল দাস বা গোলাম। সুতরাং, 'ইয়াবুদু' তথা ইবাদতের মানে হলো আল্লাহর গোলামি, বন্দেগী বা দাসত্ব করা। সোজা কথায় একান্ত অনুগত ভৃত্য। যার কাজই হলো তার মালিকের পরিপূর্ণ অনুগত হওয়া। অর্থাৎ মালিকের কোনো কথার কোনো বিরোধিতা না করা এবং করলেই শাস্তির মুখোমুখি হওয়া।

তবে কেবলমাত্র জানাজা, দুই ঈদ কিংবা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ,রোজা, হজ, যাকাত, কুরবানী, জিকির আজকার, তাসবীহ-তাহলীল, কুরআন তেলাওয়াত করার নামই ইবাদত নয়। মিথ্যা কথা বলে, সুদ-ঘুষে জড়িত থেকে, লোক দেখানো আমল করে, বেহায়াপনা, চোগলখুরি, হিংসা-বিদ্বেষ ও মুনাফিকের সঙ্গে লিপ্ত থেকে নামাজ রোজার মতো আমল করার নাম ইবাদত নয়। ইবাদত বলতে শুধু কিছু সময়ের জন্য নয় বরং প্রকৃত ইবাদত বলতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) যা কিছু আদেশ দিয়েছেন তা সদা সর্বদা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে অহর্নিশি মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করার পূর্ব পর্যন্ত বিরত থাকার আপ্রান প্রচেষ্টা করার নামই হল ইবাদত। আর তাই হল প্রকৃত দাসত্ব, গোলামী, বন্দেগী।

মোট কথায়, আমরা পৃথিবীতে যা কিছু করিনা কেন চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া , লেখা-পড়া, ঘুমা-উঠা, অর্থ উপার্জন-বিসর্জন ইত্যাদি কর্মগুলি যদি সুন্নত অনুযায়ী ও সঠিক উদ্দেশ্যে করি তাহলে সেগুলিও একপ্রকার ইবাদত। মিথ্যা কথা, সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, হিংসা-বিদ্বেষ, লোক দেখানো আমল, বেহায়াপনা, চোগলখুরি, ও মুনাফিকের মত হারাম বা নিষিদ্ধ কাজগুলি হতে বিরত থাকাও একপ্রকার ইবাদত।

যেহেতু, আল্লাহ তায়ালা সুরা হাসরের ৭ নং আয়াতে ঘোষনা করছেন:

অর্থাৎ- “রাসূল (সাঃ) তোমাদেরকে যা দেন (নিয়ে এসেছেন) তা গ্রহন কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লহ তায়ালা কঠোর শাস্তিদাতা।”

তিনি অনত্রে আরও ঘোষনা করেছেন যে, 

 فَإِذَا قُضِيَتِ ٱلصَّلَوٰةُ فَٱنتَشِرُواْ فِى ٱلْأَرْضِ وَٱبْتَغُواْ مِن فَضْلِ ٱللَّهِ وَٱذْكُرُواْ ٱللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

 অর্থাৎ- “ নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে এ আল্লহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও।” (সুরঃ জুমআহ, আয়াত ১০)

এছাড়াও আল্লহর রসূল (সাঃ) বলেছেন: (বুখারী) 

“সকল কাজ নিয়ত বা উদ্দেশ্যের ওপরে নির্ভশীল।”

সুতরাং, উপরুক্ত আয়াত ও হাদিস থেকে হতে স্পষ্ট বোঝা গেল যে আল্লাহ তায়ালা কেন মানুষ্য জাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রকৃত ইবাদত বলতে কী বোঝায়? 

কিন্তু আল্লাহ তায়ালা কেবলমাত্র মানুষকেই কেন জ্ঞান বা বিবেক প্রদান করে সমগ্র বিশ্ব জগতের মধ্যে সর্বোত্তম আকৃতি দিয়ে নিঁখুতভাবে সৃষ্টি করলেন? 

মানুষের পরীক্ষা 

আমারা এই প্রসঙ্গে অবিদিত নয় যে মানুষও এক প্রকার প্রানী বা জীব। অর্থাৎ মানুষ হিসেবে জন্ম নিলেই সত্যিকারের মানুষ হওয়া যায়না। মানুষ হতে হলে তার নিজস্ব কিছু গুনাবলীর প্রয়োজন হয়ে থাকে যা তাকে অর্জন করতে হয়। আর এরই হেতু প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তায়ালা মানুষ্য জাতিকে চতুষ্পদ জন্তুর মত শুধু পানাহার ও বংশবৃদ্ধির জন্য সৃষ্টি করেননি বরং তিনি মানুষকে জ্ঞান বা বিবেক দিয়েছেন যা মানুষ ও পশুর মধ্যে একমাত্র পার্থক্য। কিন্তু সেই জ্ঞানকে সঠিক পথে প্রয়োগ করে মানব সম্প্রদায় কতটা পশুত্ব থেকে প্রকৃত মানুষত্বে রূপান্তরিত হতে পারে সেটাই ভ্রুক্ষেপ করছেন মহিমান্নিত আল্লাহ তায়ালা। 

কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কুফরি কে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং যে মহান উদ্দেশ্যে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেটাকে তারা একাবারেই  ভুলে গেছে, আল্লহর নির্দেশকে অস্বীকার করেছে। দুনিয়াতে উপভোগ করাই তাদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। তাই কুরআনে এদের জীবন চতুষ্পদ জন্তুর জীবনের মত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। শুধু তাই নয় বরং তারা চতুষ্পদ জন্তুর চেয়ে অধম। যেমন কি আল্লাহ তায়ালা বলছেন:

وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ يَتَمَتَّعُونَ وَيَأْكُلُونَ كَمَا تَأْكُلُ ٱلْأَنْعَٰمُ وَٱلنَّارُ مَثْوًى لَّهُمْ

“এবং যারা কুফরী করে, ভোগ-বিলাসে লিপ্ত থাকে যেমনভাবে জন্তু-জানোয়াররা খেয়ে থাকে এবং তাদের নিবাস জাহান্নাম।” (সুরঃ মুহাম্মদ, আয়াত ১২)

অনত্রে তিনি আরও বলছেন:

وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِّنَ ٱلْجِنِّ وَٱلْإِنسِ ۖ لَهُمْ قُلُوبٌ لَّا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَّا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ ءَاذَانٌ لَّا يَسْمَعُونَ بِهَآ ۚ أُوْلَٰٓئِكَ كَٱلْأَنْعَٰمِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ ۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلْغَٰفِلُونَ

অর্থাৎ, “আমি বহু জ্বিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্যে সৃষ্টি করেছি, তাদের হৃদয় রয়েছে কিন্তু তারা তদদ্বারা (সত্য) উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু রয়েছে কিন্তু তারা তদদ্বারা (শিক্ষা গ্রহনের দৃষ্টিতে আল্লাহর কুদরতের প্রমানসমূহ) দেখে না, তাদের কর্ণ রয়েছে কিন্তু তদদ্বারা তারা (চিন্তা-গবেষনা ও উপদেশ গ্রহন করার মতো নিদর্শনসমূহ ও উপদেশাবলী) শোনে না, তারাই হলো পশুর ন্যায়, বরং তা অপেক্ষাও অধিক বিভ্রান্ত, তারাই হলো গাফিল বা অমনোযোগী।” (সুরঃ আরাফ, আয়াত ১৭৯)

এক কথায়, তারা সুন্দর রুপে গঠিত পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা কোন ধর্মীয় উপকার লাভ করে না। শুধুমাত্র পার্থিব জীবনের উপকারে প্রয়োগ করে থাকে। তাই কাফিরদের দৃষ্টান্ত ঐ জন্তুর মত যে রাখালের ডাক ও শব্দ শুনে থাকে মাত্র, কিন্তু কিছুই বুঝে না। তদ্রুপ এই লোকগুলোকেও ঈমানের দিকে ডাকা হলে তারা এর উপকারিতা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে, শুধু শব্দই শুনে থাকে এবং হিদায়াতও লাভ করেনা। এরই হেতু আল্লাহ তায়ালা বলেন- তারা জন্তুর মত, শুধু তাই নয় বরং তার চাইতেও অধম ও অধিক পথভ্রষ্ট। কেননা, জন্তুরা রাখালের কথা না বুঝলেও কমপক্ষে তার দিকে মুখ তো করে। তাছাড়া ঐ জন্তুগুলো দ্বারা অনুধাবন করতে না পারার যে কাজ প্রকাশ পায় তা হচ্ছে তাদের প্রকৃতিগত ও সৃষ্টিগত ব্যাপার। পক্ষান্তরে তো কোন অংশী স্থাপন করা ছাড়াই আল্লহর ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্বেও তারা কুফরী ও শিরক করে বসেছে। আর এ জন্যেই তো যারা আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করেছে তারা কিয়ামতের দিন ফেরেশতাদের চাইতেও শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হবে। কিন্তু যারা কুফরী করেছে তারা পশুর মত বা তার চেয়েও নিকৃষ্ট বলে গন্য হবে।

সুতরাং, আমাদের এই হতে মুল্যায়ন নিতে হবে যে আমরা যেন আল্লহর উদ্দেশ্য অনুযায়ী এই অচিরন্তর জীবনকে অতিবাহিত করি ও সেই মহা প্রলয়ের দিনে সফলতা অর্জন করতে পারি এবং সুখময় ও চিরন্তর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারি। এবং যদি পার্থিব জীবনকে বেশি প্রাধান্য দিই এবং এই দুনিয়ার মোহ, লোভ-লালসায় প্রবৃত্ত থাকি তবে আমাদের ঠিকানা হবে সেই জলন্ত ফুটন্ত বীভৎস জাহান্নাম।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter