মুসলিম এবং পার্থিব মুসিবত: এক বর্তমান পর্যালোচনা
ইন্দোনেশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য দিয়ে মরক্কো পর্যন্ত এক কৌণিক সরলরেখা টানলে বেশিরভাগ দেখা যায় ইসলাম ধর্ম অনুসারী মুসলিম অধ্যষিত দেশ। ওপর দিয়ে চীন থেকে সংযুক্ত আমেরিকা পর্যন্ত দেশগুলোতেও অনেক মুসলিম জনসংখ্যার বাস। আনুমানিক তথ্য অনুসারে পৃথিবীর দুই বিলিয়ন অধিক জনসংখ্যা মুসলমান। মক্কার হীরা গুহা থেকে উদ্ভাসিত হয়ে আরব পেরিয়ে বিশ্বের সমগ্র কোণে ইসলাম বাণী আজ প্রতিধ্বনিত। বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহ তাআ’লা ইচ্ছায় তাঁর দূত বিশ্ব নবী (ﷺ) প্রচারিত ধর্ম সময়ের পর সময় আরও দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। যেহেতু - “সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল।” (সূরা বনী ইসরাইল, ১৭:৮১)
কিন্তু সত্যের সঙ্গে সংকট ব্যাপারটা বাস্তব, যদিও তা দীর্ঘস্থয়ী নয়। সত্য ধর্ম ইসলাম অবলম্বনকারী মুসলমানদের সঙ্গেও তাই। এখানেই তো আসল সততার পরিচয় পাওয়া যায়। পৃথিবী গোলকের মধ্যে উল্লেখিত ওই বিরাট মুসলিম জনরেখার প্রায় স্থানে মুসলমানরা বিভিন্ন মুসিবত বা সংকটের সম্মুখীন। কোথাও দরিদ্রতা তো কোথাও প্রশাসনিক অত্যাচার। এখানে রাজনৈতিক যুদ্ধ তো ওখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যদিও মুসলমানদের দেখে ইসলামকে বিচার করা যায়না তবুও উদাহরণ স্পষ্ট - চিন, ভারত, ফ্রান্স ও সুইডেনের মত সংখ্যালঘু মুসলমানরা রাজনৈতিক বৈষম্য থেকে অস্তিত্বের অনিশ্চয়তার মত বিষয় নিয়ে চিন্তিত। সাম্প্রতিক ইন্দোনেশিয়া তুর্কি মরক্কো লিবিয়া ইত্যাদি মুসলিম অধ্যষিত দেশে প্লাবন, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রহার। ইথাপিয়া ও সুদানে বহু মুসলমান অনাহারের মত অবস্থায়। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এসব দেশে জঘন্য রাজনৈতিক খেল। সৌদি আরব, ইরান ইরাক এবং সিরিয়া কোনো না কোনো রূপে একে অন্যের সঙ্গে লেগে আছে।
ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
এই সংকটমালা মুসলমানদের সঙ্গে নতুন নয়, বরং সুদূর ইতিহাস থেকে জড়িত। ইসলামের প্রথম দাওয়াতের পর মক্কা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মুসলমানের সঙ্গে সংকট ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে। সংকটের মধ্যেই সত্যের সুস্বাদ পাওয়া যায়। আর মুসলমানরা সেই স্বাদে অভ্যস্ত। ক্ষণস্থায়ী মসিবতের পর আসবে চিরস্থায়ী বিশ্রাম - ইসলাম মুসলমানদের এই শিক্ষা দিয়েছে।
দশম শতাব্দীর পর যখন একদিকে মঙ্গল এবং অন্যদিকে খ্রিষ্টান বিদ্বেষ মুসলিম সাম্রাজ্যের বিনাশে লেগে পরে তখন চিন্তুক মুসলমানরা ভেবে উঠেছিলেন - এর কারণ কি হতে পারে? মুসলমানরা কোথায় ভুল করছে? ঐশ্বরিক করুণা সত্য সমাজের বিপরীতে কেন? আবার অনেকেই স্মরণ করেছিলেন প্রাথমিক মুসলমানদের মক্কার যুগ। তারা আশাবাদী ছিলেন - মুসিবতের পর আবার আগমন হবে নতুনের। তারা জানতেন - পৃথিবী মুসলমানদের জন্য কারাগার সমতুল্য। মক্কার পরে মদিনা হয়েছিল মুসলমানদের নিজস্ব রাজত্ব। দুনিয়ার পরে আখিরাত আসবে। “এবং নিশ্চয়ই পরবর্তী জীবন আপনার জন্য পূর্ববর্তী জীবন অপেক্ষা উত্তম!” (সূরা আল দুহা, ৯৩:৪)
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে সংকট
একমাত্র আল্লাহ তাআ’লার অস্তিত্বই চিরস্থায়ী। সকল সৃষ্টি ক্ষণস্থায়ী এবং ধ্বংস প্রবণ। মানুষের জাগতিক জীবনে সুখ-দুঃখ এক জীবন সঙ্গিনী স্বরূপ। অনুকূল অবস্থায় মানুষ আনন্দিত হয়, অন্যথায় বিচলিত হয়ে পড়ে। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে অবস্থা যাই হোক না কেন সবই আল্লাহর কর্তৃক। অবশ্যই যে কোনো ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় মনুষ্যত্বের নিদর্শন ব্যক্তিগত সবারই স্বাধীন ইচ্ছা বা ইখতিয়ার আছে।
দেখা যাক অসুবিধা, সংকট বা মুসিবত নিয়ে কিছু কুরআনী নির্দেশ: “সুতরাং নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি রয়েছে। নিশ্চয়ই কষ্টের সামনে সুস্থ রয়েছে।” (সূরা ইনশিরাহ: ৪-৫)
“এবং অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা, এবং কিছু ধন-সম্পদ জীবন এবং ফল-ফুলের ঘাটতি দ্বারা, এবং সুসংবাদ শোনান ওইসব সবরকারীদেরকে।” (সূরা বাকারা: ১৫৫)
“এবং অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব, এই পর্যন্ত যে, দেখে নিব তোমাদের সংগ্রামীদেরকে এবং ধৈর্যশীলদেরকে এবং তোমাদের সংবাদগুলোরও উপর পরীক্ষা করে নেবো। (সূরা মুহাম্মাদ: ৩১)
“কোন বিপদ আপতিত হয় না কিন্তু আল্লাহর নির্দেশে। এবং যে কেউ আল্লাহর উপর ঈমান আনবে আল্লাহ তার অন্তরকে হেদায়েত করবেন এবং আল্লাহ সবকিছু জানেন। (সূরা আল-তাগাবুন, ৬১: ১১)
“প্রত্যেক প্রাণকেই মৃত্যুর স্বাগ গ্রহণ করতে হবে এবং আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করি ভাল ও মন্দ দ্বারা পরখ করার জন্য এবং আমারই প্রতি তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।” (সূরা আল-আম্বিয়া, ২১:৩৪)
“শাস্তি দেন যাকে চান এবং দয়া করেন যার প্রতি ইচ্ছা করে, এবং তোমাদেরকে তাঁরই প্রতি ফিরে যেতে হবে।” (সূরা অনকাবুত: ২১) “এবং কত বস্তি আমি ধ্বংস করে দিয়েছি যেহেতু তারা জালিম ছিল।” (সূরা আল-হজ্জ, ২২;৪৪)
“এবং যদি আল্লাহ মানবকুলকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করতেন, তবে পৃথিবীপৃষ্ঠে কোন বিচরণকারীকেই ছাড়তেন না, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দেন। অতঃপর যখন তাদের প্রতিশ্রুতি আসবে, তখন আল্লাহর সমস্ত বান্দা তাঁরই দৃষ্টিভুক্ত।” (সূরা ফাতির, ৩৫:৪৫)
সারাংশে এটা বোঝা যেতে পারে পার্থিব সংকট আল্লাহর ইচ্ছায় কখনও পরীক্ষা, কখনও শাস্তি, কখনও বিশেষ পরিণতি হয়ে পতিত হয়। এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সর্বোত্তম জানেন।
মুসলমানদের উপর সংকট
কিন্তু মুসলমানদের সঙ্গে যাই ঘটে যাক না কেন, সবই তার জন্য ভালো। সুহায়ব (রা) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ “মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর। সকল কাজই তার জন্য কল্যাণকর। মু’মিন ছাড়া অন্য কেউ এ বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে না। তারা সুখ-শান্তি লাভ করলে শুকর-গুজার করে আর অস্বচ্ছলতা বা দুঃখ-মুসীবাতে আক্রান্ত হলে সবর করে, প্রত্যেকটাই তার জন্য কল্যাণকর।” (সহীহ মুসলিম)
অন্য একটি হাদিসে এসেছে, “মুসলিম ব্যক্তির উপর যে সকল যাতনা: রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানী আপতিত হয়, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে বিদ্ধ হয়, এ সবের দ্বারা আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।”
যেকোনো আপদে বিপদে মুসলমানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিরস্ত না হয়ে, হতাশ না হয়ে আল্লাহর প্রতি দুয়া, তওবা ও ইস্তিগফারের সঙ্গে নিজেকে অর্পণ করা, বিশ্বাসে অটল থাকা, অপরকে সংকট থেকে উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহন করা এবং পরিত্রাণ পন্থা সন্ধান করা। যখন মুসলমানরা মক্কায় কাফেরদের অত্যাচারে আক্রান্ত ছিলেন, আল্লাহ তাআ'লা মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে নবীকে (ﷺ) ঘোষণা করতে আদেশ দেন - “আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না!” (সূরা যুমার, ৩৯:৫৩)
 
  
             
            
                     
            
                     
            
                                             
            
                                             
            
                                             
            
                                             
            
                                             
            
                                             
            
             
            
             
            
             
            
            