জ্ঞানবাপি মসজিদ চত্বরের সমীক্ষার উপর ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (এএসআই) এর রিপোর্ট ও অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের বিতর্ক
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড (AIMPLB) বারাণসীর জ্ঞানভাপি মসজিদ প্রাঙ্গণ সম্পর্কিত আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (ASI) রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ করে জানিয়েছে যে, "এইটি কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যেতে পারেনা, এএসআই রিপোর্ট চূড়ান্ত নয়। প্রথম বাবরী ধংসের মত আমরা কোনদিনও দ্বিতীয় বাবরী ধ্বংস হতে দিব না।" AIMPLB হল একটি বিশিষ্ট মুসলিম সংগঠন যেটি ভারতে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন রক্ষার জন্য 1973 সালে গঠিত হয়েছিল।
এএসআই এর বৈজ্ঞানিক চার মাসের জরিপ ও পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এটি দাবী করা হচ্ছে যে এখানে একটি পূর্ব-বিদ্যমান হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল যার প্রমাণ কাঠামোর গায়ে বিদ্যমান।
কাসিম রসুল ইলিয়াস, এআইএমপিএলবি-এর একজন সদস্য, এই বিতর্কিত মামলায় "নিশ্চিত প্রমাণ" প্রদান না করাই এএসআই এর রিপোর্টকে খারিজ করেছেন। তিনি অভিযুক্ত করেন যে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি এএসআই রিপোর্ট মিডিয়াতে প্রকাশ করে আদালতের অবমাননা এবং জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করেছে।
তিনি বলেন, “বিরোধী দল সমাজে নৈরাজ্য ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। হিন্দু সংগঠনগুলি এর আগে এএসআইয়ের একটি ঝর্ণাকে শিবলিঙ্গ হিসাবে বর্ণনা নিয়ে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল।"
হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি বহু বছর ধরে জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হল এএসআইয়ের একটি রিপোর্ট যেইটি তারা আদালতে দাখিল করে মামলা দায়ের করে, যেইটি শুধুমাত্র আদালতের নির্দেশে বাদী ও বিবাদীর জন্য উপলব্ধ করা হয়েছিল যেন আদালতের যাচাই ছাড়া এইটি জনসমক্ষে প্রকাশ না করা হয়, যেইটি বর্তমানে আদালত নির্দেশ অনুযায়ী প্রকাশ করা হয়েছে। এই রিপোর্টটি তাদের অধ্যয়ন করার জন্য তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সংবাদপত্রে প্রকাশ করে বিরোধী দল শুধু আদালতের অবমাননাই করেনি, বরং দেশের সাধারণ মানুষকেও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে”।
তিনি আরও বলেন যে, “কয়েক মাস আগে, জরিপ দল যখন তাদের রিপোর্টটিতে জলাশয়ে উপস্থিত ঝর্ণাটিকে শিবলিঙ্গ বলে বর্ণনা করেছিল, তখন বিরোধী দল এটিকে প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার এবং সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল, যদিও বিশেষজ্ঞরা বা আদালত এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়নি”।
মুসলিম পক্ষ থেকে এই প্রতিক্রিয়াটি হিন্দুবাদীর আইনজীবী বিষ্ণু শঙ্কর জৈনের দাবির বিরুদ্ধে, যিনি এএসআই রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ দাবি করেন যে , 17 শতকে একটি হিন্দু মন্দির ভেঙ্গে জ্ঞানভাপি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল।
বারাণসী আদালতে সিল করা কভারে জমা দেওয়া এএসআই-এর 800-পৃষ্ঠার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যে, 17 শতকে একটি প্রাক-বিদ্যমান কাঠামো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং এর কিছু অংশ মসজিদ নির্মাণে পুনরায় ব্যবহার করা হয়। রিপোর্টটি মসজিদ নির্মাণের আগে একটি বড় হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্বের প্রস্তাবনা দেয়। এলাহাবাদ হাইকোর্ট, এএসআই-এর বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার জন্য বারাণসী আদালতের আদেশের উপর স্থগিতাদেশ চেয়ে মুসলিম মামলাকারীদের একটি আবেদন প্রত্যাখ্যান করার পরে জ্ঞানভাপি মসজিদ প্রাঙ্গণ নিয়ে বিরোধ আরও বেড়ে যায়। এএসআই জরিপের সময় গ্রাউন্ড-পেনিট্রেটিং রাডার (Ground-penetrating radar) এবং অন্যান্য যন্ত্র ব্যবহার করে, প্রাঙ্গনে পাওয়া বিভিন্ন বস্তু, শিলালিপি এবং ভাস্কর্য নথিভুক্ত করে।
এএসআই তার বার্তায় বলে যে , “একটি কক্ষের অভ্যন্তরে পাওয়া আরবি-ফারসি শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে মসজিদটি ঔরঙ্গজেবের 20তম রাজত্বের বছরে (1676-77 CE) নির্মিত হয়েছিল। তাই ঔরঙ্গজেবের শাসনামলে ১৭শ শতাব্দীতে পূর্ব-বিদ্যমান কাঠামোটি ধ্বংস হয়ে গেছে বলে মনে হয় এবং এর কিছু অংশ বর্তমান কাঠামোতে পরিবর্তিত ও পুনঃব্যবহার করা হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক জরিপ, স্থাপত্যের অবশেষ এবং প্রত্নবস্তু, শিলালিপি, শিল্প ও ভাস্কর্যের অধ্যয়নের উপর ভিত্তি করে এটা বলা যেতে পারে যে বর্তমান কাঠামো নির্মাণের আগে এইটি একটি হিন্দু মন্দির ছিল”।
“বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের ভিত্তির উপর, বিদ্যমান কাঠামোতে প্রাক-বিদ্যমান কাঠামোর কেন্দ্রীয় চেম্বার এবং মূল প্রবেশদ্বার, পশ্চিম প্রকোষ্ঠ এবং পশ্চিম দেয়াল, স্তম্ভ ও স্তম্ভের পুনঃব্যবহার, ঢিলেঢালা পাথরের উপর আরবি ও ফারসি শিলালিপি, ভাস্কর্যের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করার পর এটা বলা যেতে পারে যে বিদ্যমান কাঠামো নির্মাণের আগে একটি বড় হিন্দু মন্দির ছিল”।
“ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট বারাণসী, 21 জুলাই 2023 তারিখের আদেশের সম্মতিতে, 3 আগস্ট 2023 তারিখের আদেশ দ্বারা এলাহাবাদের হাইকোর্ট এবং 4 আগস্ট 2023 তারিখের আদেশ দ্বারা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে যে , এএসআই (ASI) একটি 2150.5-বর্গ-মিটার এলাকায় বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে একটি বৈজ্ঞানিক তদন্ত এবং সমীক্ষা চালিয়েছে এবং সুপ্রিম কোর্টের আদেশ দ্বারা সিল করা এলাকাগুলি ব্যতীত তার চারপাশে স্টিলের গ্রিল দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে। কমপ্লেক্সে বৈজ্ঞানিক তদন্ত বা জরিপের সময় যে সমস্ত বস্তু লক্ষ্য করা গেছে তা যথাযথভাবে নথিভুক্তও করা হয়েছে। এই বস্তুগুলির মধ্যে রয়েছে শিলালিপি, ভাস্কর্য, মুদ্রা, স্থাপত্যের খণ্ড, মৃৎশিল্প, এবং পোড়ামাটির পাথর, ধাতু এবং কাঁচের জিনিস”। এএসআই-এর সেই রিপোর্ট এ বলা হয়েছে যে, বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ এবং স্থাপত্যের অবশেষ, বৈশিষ্ট্য, নিদর্শন, শিলালিপি, শিল্প ও ভাস্কর্যের অধ্যয়নের উপর ভিত্তি করে এটা সহজেই বলা যায় বর্তমান কাঠামো নির্মাণের আগে সেখানে একটা হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল।
এটাও দাবি করা হয় যে, " ফেলে দেওয়া হিন্দু দেবদেবীদের ভাস্কর্য এবং খোদাই করা স্থাপত্য মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকতে দেখা গেছে"।