নারী সুরক্ষার প্রতিজ্ঞায় সরকার মিথ্যাবাদী (পর্ব ২)

২০১৪ এ বিজেপি আসার পর নারী নির্যাতনের ঘটনা আরও বৃদ্ধি পায় যেমন ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-এর বিবৃতি অনুযায়ী ভারতীয় নারীর বিরুদ্ধে চতুর্থ সবচেয়ে প্রচলিত অপরাধ হচ্ছে ধর্ষন। ২০১৯ সালে ৩১৬৬৭ টি কেস নিবদ্ধ করা হয়, অর্থাৎ স্বাধীন ভারতে  দৈনিক ৮৬-৮৯ টি মেয়ে হয়রানীর সম্মুক্ষিন হয়। বিজেপি শাসিত রাজ্য যেমন রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি অবস্থানে যথাক্রমে ধর্ষনের মামলা সব থেকে বেশি।  ২০২০ থেকে এখন পর্যন্ত দৈনিক ১০৪ এর অধিক রেপ কেসের মামলা দায়ের করা ইচ্ছে।     

 NFHS (ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে) এর রেপর্ট অনুযায়ী ৮.৫% ভারতীয় মহিলা জীবনে একবারও হয়রানিন সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু এদের মধ্যে মাত্র এক শতাংশ নারীরায় পুলিশের কাছে আপন নির্জাতনের কেস করে থাকে, আর বাকিরা কোন চাপের কারনে শান্ত থাকে।

প্রজ্বল রেভান্ন ধর্ষণ মামলা

কিছুদিন পূর্বে কিছু অচেনা মানুষ এসে বিভিন্ন বাড়িতে, বাসে, ট্রেনে, বাজারে, এবং নানান পাবলিক জায়গায় কিছু পেনড্রাইভ ফেলে চলে যায়। প্রথমত তো সকলেই এটিকে অবহেলা করে, কিন্তু যখন সেই পেনড্রাইভটি চালিয়ে দেখে তখন জানতে পারে যে এই পেনড্রাইভে ২৯৬৭ টি মেয়ের সঙ্গে জোর করে নির্যাতনের ভিডিও। এই নির্যাতনকারী অন্য কেউ না বরং ভারতীয় জনতা পার্টির কর্নাটকের হাসান লোকসভা কনস্টিটিউন্সির ক্যান্ডিডেট  এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচ দি দেবগৌড়ার সন্তান প্রজ্বল রেভান্ন।

পেনড্রাইবের ভিডিওতে মানুষ দেখতে পায় যে সমস্ত বয়সের নারীদের সঙ্গে নির্যাতন করা হয়েছে, যার মধ্যে ৬০-৬৫ বছরের নারীরা সেই অপকৃষ্ট মানুষের কাছে রক্ষা চাইছে যে সে যেন তাকে ধর্ষণ না করে, কিন্তু ভিডিওতে একজন পাগলের মতো ব্যবহারকারী এই প্রজ্বল হাসতে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে ২০০০ এর বেশি ভিডিও তো প্রজ্জ্বল নিজেই শুট করেছিল এবং বাকিগুলি অন্যদের দ্বারা শুট করিয়েছিল। তার পার্টির মহিলা কর্মী, গ্রাম পঞ্চায়েত কর্মী, মহিলা গভর্মেন্ট অফিসার, মহিলা পুলিশ এবং তার বাড়ির চাকর বাকরদেরও ধর্ষণ করে এই ক্ষুদ্র ব্যক্তি।

এইসব ভিডিও দেখে বিজেপি কর্মকর্তারা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সর্বপ্রথম অন্যান্য পার্টির ওপরে এই অভিযোগ দায়ের করে যে তাদের প্রার্থীর মানহানির জন্য AI দ্বারা যৌন হেনস্থার ভিডিও তৈরি  করে লৌকিক করা হচ্ছে। কিন্তু সেই সব ভিডিও গুলিকে পরীক্ষা করার পর যখন দেখে যে প্রজ্জ্বল রেভান্য এবং তার বাড়িতে যেসব জিনিস রাখা রয়েছে সেই সব জিনিস সমস্ত ভিডিওতে ম্যাচ করছে তখন সেই ভিডিও গুলোকে পুলিশও সত্য ভাবে মেনে নেয়। এইসব ভিডিও ভাইরাল হওয়ার চারদিন পরেই (অর্থাৎ ২৬ এপ্রিল) হাসান কনস্টিটুয়েন্সিতে ভোট হয় এবং তারপরে তিনি প্রজ্বল আপন দেশ ছেড়ে জার্মানির চলে যায়।

প্রজ্বল নিজের ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট ব্যবহার করে জার্মানি পৌছার পরেই তার ঘরে কর্মরত ৪৭ বছরের এক নারী পুলিশ স্টেশনে গিয়ে এই মামলা নথিভুক্ত করে যে প্রজ্বল তার সঙ্গে শারীরিক সম্মেলন করেছে এবং শুধু তার সঙ্গেই নয় সেই বাড়িতে কর্মরত সকল সেবিকার সঙ্গে সে যৌন হেনস্থা করেছে। সে আরও বলে যে আমার যোগদান দিনে তার বাড়িতে ছয়জন মহিলা সেবিকা প্রথম থেকেই কর্মরত ছিল, তারা আমাকে প্রথম দিনেই বলে যে যখন প্রজ্বল বাড়িতে আসবে,  তখন যেন আমি তার থেকে দূরে থাকি। কিছুদিন পরে যখন সে বাড়ি আসে তখন আমার সঙ্গে জোরপূর্বক সহবাস করে এবং দুইদিন পরেই আমার মেয়ে এলেই তার নম্বর নিয়ে তাকেও জ্বালাতন করতে শুরু করে।  এইসব খবর যখন আমি  তার পিতা H.D রেভান্নকে বলতে যায় তখন সেও আমার সঙ্গে সেক্স করে।  পুলিশ অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে যে সে এতদিন কেন এই ঘটনার কোনো মামলা দায়ের করে নি, তখন তার প্রতুত্তরে সে বলে যে আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে শান্ত রাখতে চেয়েছিল এই মানুষটি কিন্তু এখন এইসব ভিডিও ভাইরাল হওয়ার কারণে আমরা সাহস পেয়েছি এবং আমরা তার প্রতি এফ আই আর করতে পারব।

এই এফ আই আর-এর সাহায্যে হোলেনারাসিপুর পুলিশ H.D রেভান্ন এবং তার ছেলে প্রজ্বল রেভান্ন এর বিপক্ষে সেক্স্যুয়াল হারাসমেন্ট এবং ক্রিমিনাল এক্ট এর আওতায় মামলা দায়ের করে।

এর পরের দিনই কর্ণাটক ওমেন পুলিশ চিফ নাগা লক্ষ্মী কাছের এই সকল ভিডিও পৌঁছে যায় সে আরও কিছু মাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন ধর্ষিতা নারীর সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করে এবং বিষয়টি ক্লিয়ার করে, শেষে সে বলে যে বিশ্বের সব থেকে বড় যৌন কেলেঙ্কারি প্রজ্বলকে সাজা দেওয়া অনিবার্য।

এর মধ্যেই আরেকটি বিষয় সামনে আসে, তাদের পরিবারের একজন বিশ্বস্ত ড্রাইভার কার্তিক গৌড়া পুলিশের কাছে এই সব ভিডিও নিয়ে গিয়ে বলছে যে আমার ১৬ একর জমি  নিজের নামে করতে চাইছে তার মালিক। ওই সব দেখে শুক্রবার কর্ণাটক হাইকোর্ট ঘোষণা করে যে হাসান লোকসভা আসন থেকে প্রজ্বল রেভান্ন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী H.D দেবাগৌরের পুত্রপোত্র এবং জনতা দল (সেকুলার) এমপি এই পদের নির্বাচনটি বাতিল এবং ব্যর্থ ঘোষণা করে।

কিন্তু ভোটের ৭ দিন আগে কর্ণাটকে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই বিশ্রী মানুষের জন্য ভোট চেয়ে নিজের ভাষনে বলেছিলেন যে প্রজ্জ্বল রেভান্ন কে দেওয়া সকল ভোট ভারতীয় জনতা পার্টিকে সাহায্য করবে, অর্থাৎ একজন ধর্ষণকারী মানুষের জন্য ভোট চাইছে নারী সুরক্ষার স্লোগান নিয়ে আসা এই সরকার।

 ব্রিজ ভূষণ শরণ সিং ধর্ষণ মামলা

এই ধরনেরই আরেকটি ঘটনা গত বছর সামনে এসেছিল যখন WFI (ইন্ডিয়ান উওমান রেসলিং ফেডারেশন) চিফ এবং ভারতীয় জনতা পার্টির লোক সভার সদস্য বৃজ ভূষণ শরণ সিং এর বিপক্ষে ছয় জন মহিলা কুস্তিগীর যৌন হেনস্থার মামলা করে ।

জানুয়ারি ২০২৩ এ ভারতীয় মহিলা কুস্তিগীররা বৃজ ভূষণের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার মামলায় তদন্তের দাবিতে জন্তর মন্তরে (নতুন দিল্লি) প্রতিবাদ করতে শুরু করে। ভারতের জন্য কমনওয়েলথ এবং এশিয়ান গেমস এ সোনাজয়ী ভিনেশ ফাগোট, শাকশি মালিক, আনশু মালিক, বজরং পুনিয়া, প্রভৃতি বৃজ ভূষণকে গ্রেফতারের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু ভারতীয় সরকার ভারতের সন্মান রক্ষাকারী মহিলাদের সাহায্য না করে তাদের উপর লাঠি বর্ষণ করে এবং নিজের সংসদ সদস্যকে এটিকে তার প্রতি মিথ্যা অভিযোগ বলে ছেড়ে দেয়।

আসলে এরা দুজনই নই বরং বিজেপির ৫৪৩ জন পার্থির মধ্যে ১৩৪ জন সদস্য যৌন হেনস্থা মামলায় জড়িত। G ডেভারাজ গৌড়া, ২০১৮ এ উন্নাও শহরের বিজেপি সংসদ সদস্য কুলদীপ সিং সংঘর ১৭ বয়সের মেয়েকে ধর্ষণ করে, কিন্তু বিজেপি সরকার দ্বারা তৈরি কোনো সংগঠন তার প্রতি কোনো ক্রিয়াকলাপ নেয়নি ।  শেষে জনসমক্ষের চাপে এসে ২০১৮ সালের শেষের দিকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

২০১৮ সালেই একজন বিজেপি সদস্য কাশমিরের কাঠুয়া জেলার স্পেশাল পুলিশ অফিসার দীপাক খাজুরিয়াকে মুক্তিদানের আবেদন করে। দীপক খাজুরিয়া, সেই মানুষ যে ৮ বছরের একজন যাযাবর মেয়েকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলে।

২০১৯ এ উত্তর প্রদেশের হাথরাস নামক এক শহরে একজন দলিত মেয়েকে ৪ জন উচ্চ বর্ণের মানুষে গণধর্ষণ করে, মেয়েটি মারা যাওয়ার আগে তাদের নামও বলে, কিন্তু তবুও তাদের প্রতি কোনো ক্রিয়াকলাপ নেওয়া হয়নি ।

২০২২ এ অঙ্কিতা ভান্ডারী নামক এক ১৯ বছরের নারীকে ধর্ষণ করে বিজেপি সাবেক মেম্বর বিনোদ আরিয়ার ছেলে পুলকিত আরিয়া, কিন্তু সরকার ঘটনাটি চেপে দেয় এবং জনসমক্ষে প্রকাশ হয় না । এছাড়াও আরও অনেক মামলা রয়েছে।

উপসংহার

NCRB এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৬ থেকে ২০২২ এর মধ্যে শিশু ধর্ষণ মামলা ৯৬% পার্সেন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং এই ভাবেই ভারতে নারী নির্যাতন দৈনন্দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অফিসে কর্মরত নারীরাও এই ধরনের ঘটনা থেকে রক্ষা পায়না। এবং চরম আকারে লক্ষ্যে করা গেছে যে নির্যাতনকারীরা বেশির ভাগই ভারতীয় জনতা পার্টি এবং এর বিভিন্ন শাখার সঙ্গে যুক্ত । 

 

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter