'ফারহা'র দৃষ্টি আড়ালে শুধু অত্যাচার!
এক অন্ধকারাচ্ছন্ন আবদ্ধ গুদাম ঘর… দেওয়াল ওপরে একটি ছিদ্র দিয়ে লম্বা সূর্য রশ্মি প্রবেশ করছে… সঙ্গে ভয়াবহ গুলিবারুদের আওয়াজ, তো কখনো ভয়ংকার নিঃশব্দতা একই পথ দিয়ে ঘরের মধ্যে… জীবন্ত হয়ে ফারহাকে মানে হচ্ছে সে যেন কবরস্থ… অপেক্ষা ছাড়া কোন বিকল্প সামনে নেয়। না, এই অপেক্ষার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করতে হবে!
ফিলিস্তিনের উপর অত্যাচারী ইসরাইলের নির্যাতনকে তুলে ধরে নির্মিত উন্নত মানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ছবি ফারহা ২০২২ সালে আলোড়ন তৈরি করে। ইসরাইলের অমানবিকতা নিয়ে সারা বিশ্ব অবগত, তবুও তার ইতিহাস স্পষ্টতেই প্রতিস্থাপনের এটি খুব সুন্দর এক উদ্যোগ।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং ফলতঃ ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত যথা নাকবার এক সুন্দর কিন্তু অশ্রুবিদারক দৃশ্য তুলে ধরেছে আরবি ভাষায় তৈরি জর্ডানের এই ছবিটি। উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষী ছোট্ট বালিকা ফারহা এবং তার পিতা-পরিবারের মাধ্যমে সার্বিক প্যালেস্টাইনের দুর্বোধ্য অসহায়তার চিত্র ফুটে উঠেছে।
নাকবার তাপ থেকে পরিতৃপ্ত সিরিয়ার উদ্বাস্তু রাদিয়েহের স্মৃতিকথা অবলম্বনে রচিত এক কাহিনীর উপর গঠিত ছবিটি পরিচালনা করেন জর্ডানিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালিকা এবং লেখিকা ডারিন জে. সাল্লাম। সর্বপ্রথম ২০২১ সালে টরন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি প্রকাশিত হয়। শীঘ্রই, ফারহা আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে ফেলে। এমনকি বিভিন্ন ইসরাইলী বাধা-বিপত্তির সত্ত্বেও ২০২২-এর শেষের দিকে নেটফ্লিক্সে প্রকাশিত হলে ফারহার সাফল্য যাত্রায় নতুন অধ্যায় উন্মুক্ত হয়। আশ্চর্যের বিষয় যে, পরিচালিকা নিজের পরিবারও প্যালেস্টাইন ছেড়ে জর্ডানে বসবাসরত এবং তিনি নিজেই এই ছবির লেখিকা।
ছবিটির পটভূমিকা কিছু এরকম - প্যালেস্টাইনের এক গ্রামে ১৪ বছর বয়সি ফারহা তার বান্ধবী ও পরিবারসহ খুব সুন্দর প্রশান্তির সঙ্গে বসবাস করে। তার বিভিন্ন বান্ধবীরা যখন এক বান্ধবীর বিয়ে উৎসব উদযাপনে ব্যস্ত, ফারহা স্বপ্ন দেখে উচ্চ শিক্ষার। তার বাবাকে সে বারবার আর্তনাদ করেছে যেন তার জন্য কোন পাত্র না দেখা হয় এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য তাকে শহরে পাঠানো হোক।
কিন্তু হঠাৎই পুরো চিত্রের পরিবর্তন হয়ে যায়। ফারহার শহরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বিভিন্ন ঘটনার উন্নতির মধ্যে ইসরাইলী সৈন্যের আক্রমণ থেকে গ্রামকে রক্ষার উদ্দেশ্যে আবু ফারহা (ফারহার বাবা) প্রতিরক্ষা দলে যুক্ত হন। তার আগে কন্যাকে সমস্ত কুষ্যত হিংসা থেকে রক্ষা করার জন্য এক গুদাম ঘরে আবদ্ধ করে যান। আশ্বাস দেন যে তিনি শীঘ্রই ফিরবেন, কিন্তু দিনের পর রাত কাটে এবং ফারহার অপেক্ষা-সহ্যে ভাটা জাগে। একই আবদ্ধ অন্ধকার ঘরে দৈহিক সমস্ত কার্যকর্ম খাওয়া থেকে শুরু করে প্রস্রাব পর্যন্ত। এখানেই ফারহার সর্বপ্রথম মাসিক আরম্ভ হয়।
ফারহা দরজার নিম্নে ছিদ্র দিয়ে বাইরের অল্প দৃশ্য দেখতে সক্ষম হয়। কিন্তু, এখান দিয়েও শুধু দৃশ্যমান অত্যাচারের চিত্র। সে দেখে তার ঘর আঙ্গিনায় এক মুসলিম পরিবার প্রবেশ করেছে। স্ত্রী লোকটি প্রসব অবস্থায়। তার আঙ্গিনাতেই প্রসব সম্পন্ন হয়। মহিলাটি হয় উম্ম্য মুহাম্মাদ। হঠাৎ ইসরাইলী সৈন্য অবস্থান করে। যেমন করেই হোক আবু মুহাম্মদ তার পরিবারদের লুকিয়ে নিজে সৈন্যের সামনে আসে। সৈন্যরা ঘর তল্লাশি শুরু করে এবং লুকিয়ে থাকা পরিবারকে বের করে আনে। নবজাত শিশু ছাড়া পরিবারের সকল সদস্যকে প্রত্যক্ষ গুলি করে মেরে ফেলে। নবজাত শিশুর ক্ষেত্রে বলা হয় ওকে মারার জন্য গুলি নষ্ট করো না। এসব দৃশ্য দেখে ফারহার চোখে অশ্রু জোয়ার সৃষ্টি হয়।
শত চেষ্টার পর দরজা খুলতে ব্যর্থ, অসহায় ফারহা গুদাম ঘরে একটি বন্দুক খুঁজে পাই। বন্দুক ব্যবহার করে সে দরজা ভেদ করে বাইরে এসে সর্বপ্রথম সদ্যজাত শিশুটিকে দেখে যে মৃত্যু। সম্পূর্ণ গ্রাম বিসর্জন, তার ঝুলন্ত দোলনাটি খালি এবং রাস্তায় একা। ফারহা একা হেঁটে চলে যায় ভবিষ্যৎ গন্তব্য স্থলে।