কেরালার ইসলামী ঐতিহ্য: মামবুরাম থাঙ্গালের জীবন ও অবদান (পর্ব ১)
ভূমিকা
সম্প্রতি, কেরালা সারা ভারত জুড়ে একটি ইসলামী সাংস্কৃতিক ভিত্তিক রাজ্য হিসেবে বিবেচিত, এর সংস্কৃতি সারা বিশ্বেকে আকৃষ্ট করেছে। কেরালার প্রথম ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলিম, কিন্তু এখানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো নোংরা বা অগ্রহণযোগ্য কার্যকলাপ দেখতে পাওয়া দুর্লভ বিষয়। তাদের ভ্রাতৃত্ব ভারতীয় ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীক। কেরালার মুসলিম ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ই সম্মানিত মামবুরাম থাঙ্গালকে শ্রদ্ধা করেন, যিনি এই ভূমির একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। এই নিবন্ধে তাঁর জীবন ও কেরালাজুড়ে তাঁর অবদান নিয়ে আলোচনা করা হল।
কেরালায় ইসলাম:
আধুনিক মালাবারের সংস্কৃতি ও সভ্যতায় ইসলামী মূল্যবোধের বড় প্রভাব দেখা যায়। এর একমাত্র কারণ এটাই যে ইসলাম তার প্রথম পর্যায়েয় ভারতীয় দক্ষিণাঞ্চল রাজ্য কেরালায় পৌঁছেছিল। ইতিহাস অনুযায়ী, মালাবারে অঞ্চলগুলির প্রবাসীগন প্রিয় রাসূল মোহাম্মাদ (সঃ)-এর সময়েই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আরবদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে মালাবারের মানুষ ইসলামী মূল্যবোধ গ্রহণ করে। রাজা বনপেরুমল, যিনি নবী (সাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের পর "তাজউদ্দীন" নাম গ্রহন করেন, এবং চেরামন পেরুমল, চেরামন রাজবংশের অন্তিম রাজা, প্রমুখ, কেরালায় ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ।
৬৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে, রাজা বানপেরুমলের নির্দেশে হযরত মালিক বিন দিনার (রহ:) এর নেতৃত্বে 22 জন ধর্মীয় পণ্ডিত পান্থলায়নি এবং কোডুঙ্গাল্লুর নামক দুই শহরে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। তুহফাত আল-মুওয়াহিদিন গ্রন্থে হযরত শেখ জয়নুদ্দিন মাখদুম উল্লেখ করেন যে তারা প্রায় ১০টি মসজিদ তৈরি করেন এবং ১০ জন ধর্মপ্রচারককে নিয়োগ করেন।
পরে ইয়েমেনী সাধক ও পণ্ডিতগণ, বিশেষ করে বা-আলাভি পরিবার, মালাবারে ইসলামের প্রচার করেন। স্থানীয় রাজা ও সকল অধিপতিগন মুসলিম সম্প্রদায়কে সাদরে গ্রহণ করে এবং তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখে। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিমা সভ্যতা অনুসরণের কারণেই কিছু সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি পায়।
ইয়েমেন এবং মালাবার:
কেরালার বেশিরভাগ সাইয়্যিদ পরিবারের আদি ভূমি হল ইয়েমেন। ৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সাইয়্যিদ আহমদ বিন ই'সা আল মুহাজির বসরা থেকে হাধরেমাউথে যাত্রা করেন এবং সেখানে নবীর বংশধরদের স্থাপন করেন। 'বাআলাভী' পারিবারিক নামটি 'সাইয়্যিদ আলাভী' থেকে এসেছে, যিনি সাইয়্যিদ উবাইদুল্লাহর বংশধর ছিলেন। জিফরি এবং মাওলাদ্দাভীলা বংশগুলি এই বৃহৎ পরিবারের শাখা। সাইয়্যিদ ফাদল পুকোয়া (রহ.) তাঁর বই 'ফুয়ূদাতুল ইলাহিয়্যাহ'-তে বাআলাভী সাদাত পরিবারের একটি বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, যা ১৩০৭ হিজরীতে লেখা হয়েছিল। আজকের দিনে প্রায় ৮৩০০ জীবিত বংশধর (বাআলাওয়ি সাদাত) আছেন।
মহান হযরত আলাভী বিন উবাইদিল্লাহ, যিনি ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে হাধরেমাউথের সামাল গ্রামে বাস করতেন। তাঁদের পরিবার ইয়েমেন, হিজাজ, ভারত, সুমাত্রা, পশ্চিম আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকা ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে ইসলামের প্রচারের জন্য ছড়িয়ে পড়ে। সাইয়্যিদ আলি হামিদ বাআলাভী থাঙ্গাল, যিনি সামুদিরি যুগে কালীকট বন্দরে যাত্রা করেছিলেন, মালাবারের প্রথম দিকের প্রচারকদের একজন ছিলেন। মালাবারের পাশাপাশি, আলাভী সাইয়্যিদরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে, যেমন বিজাপুর, সুরাট, আহমেদাবাদ, হায়দ্রাবাদ, দিল্লি, বরোদা এবং বেঙ্গলে প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন।
মামবুরাম থাঙ্গাল:
জন্ম ও শৈশব
থাঙ্গাল সাহেবের পরিবার ইয়েমেন দেশের হাধরামউথে তারিম নামক একটি ছোট শহরে বসবাস করত। তাঁর পিতা, সাইয়্যিদ মুহাম্মদ বিন সাহল মাউলাদ-দাভিলা এক আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ বিন সাহল, জিফরি পরিবারের মুখ্যর কন্যা এবং শেখ হাসান জিফরি রহঃ-এর বোন সাইয়্যিদা ফাতিমা রহঃ কে বিয়ে করেছিলেন। তিনি একজন উদার ব্যক্তি, ধর্মীয় পণ্ডিত এবং ভক্ত ছিলেন। তাদের পুত্র হিসাবে থাঙ্গাল সাহেবের জন্ম ১১৬৬ হিজরি সনের, ২৩ যিলহিজ্জাহ, শনিবার রাতে হয়। তিনি নবী সাঃ-এর পরিবারের তেত্রিশতম বংশধর। তিনি নিজের শৈশব কালে নিজের মাতাপিতাকে হারিয়ে ফেলেন। তাঁর পিসি সাইয়্যিদা হামিদা বিবি তাঁর যত্ন নেন। শৈশব থেকেই থাঙ্গাল সাহেব আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করতে শুরু করেন। তিনি ধৈর্য, ভালো স্বভাব, সততা, বুদ্ধিমত্তা, সাহস এবং সমাজ সেবার মতো অনেক গুণাবলী দ্বারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। খুব অল্প বয়সেই তিনি পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠ করতে আরম্ভ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা তার জন্মস্থান তারিম শহরেই অর্জন করেন।
ইতিমধ্যে তার চাচা ও কয়েকজন আত্মীয় ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে কেরালার দিকে ভ্রমণ করেন। তিনি তার দত্তক মায়ের কাছ থেকে কেরালায় ইসলামের প্রচারের কাজ সম্পর্কে শুনেছিলেন। পরিপক্ক হওয়ার পর তিনি ইসলামিক দাওয়াতে চাচাদের পথ অনুসরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সতেরো বছর বয়সে থাঙ্গাল সাহেব একটি পণ্যবাহী জাহাজে শাহরমুকাল্লা বন্দর থেকে মালাবারের দিকে ভ্রমণ করেন, এবং ১১৮৩ হিজরি সনের ১৯ রমজানে কেরালার কোঝিকোড জেলায় অবতরণ করেন।
মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তিনি আপন প্রিয় চাচা সাইয়্যেদ হাসান জিফরি থাঙ্গাল সাহেবকে হারিয়ে ফেলেন। সাইয়্যেদ হাসান জিফরি যখন তারিম শহর ছেড়ে কেরালায় চলে যান, তখন থাঙ্গাল সাহেবের বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। কযিকোডে পৌঁছানোর পর, কিছু আরব বণিক, যারা তার জাহাজের সঙ্গী ছিল, তাঁরা শেখ জিফরি সাহেবকে বাড়িতে নিয়ে যান। পরের দিন সকালে, প্রার্থনা এবং খাবারের পরে, তারা মামপুরমে ফিরে আসেন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল মামপুরমের মানুষদের সম্পর্কে জানা, মামবুরাম সেইসময় একটি ঋষিদের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল, বিশেষত তাঁর চাচার সমাধির মাজার পরিদর্শন করতে দূর দূরান্ত থেকে দল বেঁধে মানুষ আসতো।
পারিবারিক জীবন
থাঙ্গাল সাহেবের পারিবারিক জীবন ছিল অনুকরণীয়। তিনি ১১৮৩ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে সায়্যেদ হাসান জিফরি সাহেবে, যাকে মামপুরম স্থানীয়দের নেতা হিসাবে বিবেচনা করা হত, তার কন্যা ফাতিমা বিবিকে বিয়ে করেন। তার একই বছর তারা কেরালায় আসেন। বিয়ের সময় ফাতিমা বিবির বয়স পনেরো ছিল এবং থাঙ্গাল সাহেবের বয়স ছিল সতেরো। এটি তুলনামূলকভাবে খুব সাধারণ একটি বিবাহ ছিল। বিয়ের খুৎবা দেন শেখ জিফরি। তারপর থাঙ্গাল সাহেব তাঁর আত্মীয় ও বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি ছোট ভোজের (ওয়ালিমা) আয়োজন করেন। তাঁর বাবার পরিবার এবং বন্ধুদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানান।
অনুষ্ঠানের পর থাঙ্গাল সাহেব আবদুর রহমানকে তাঁর ও তার পরিবারের খরচ বহন করার জন্য অনুরোধ করেন এবং তিনি সেটা বিনা দ্বিধায় স্বীকার করেন। বিয়ের প্রথম দিকে থাঙ্গাল সাহেব তাঁর স্ত্রীর বাড়িতে থাকতেন। পরে তারা মামবুরাম মসজিদের সামনে মালিকের বাড়িতে চলে যান। শেষ পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। বর্তমানে সেখানে একটি পাথর দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে তাঁর পায়ের ছাপ রয়েছে।
ফাতিমা বিবির কোলে দুই কন্যার জন্ম হয়। প্রথম কন্যার নাম ছিল শরীফা আলাভিয়া, তিনি শৈশবে মারা যান। বিয়ের চতুর্থ বছরে দ্বিতীয় সন্তান জন্ম নেয়। মৃত শিশুর স্মরণে থাঙ্গাল সাহেব শিশুটিরও নাম রাখেন শরিফা। পরে তিনি 'কুঞ্জি বিবি' নামে পরিচিত হন। থাঙ্গাল ইবনে আহমাদ জিফরি পরে কুঞ্জি বিবিকে বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর, থাঙ্গাল কভিলকান্দি আম্বাকান্তকাতের বিখ্যাত পন্ডিত সায়্যেদ আবু বকর মাদানী সাহেবের কন্যা ফাতিমাকে বিয়ে করেন। বিবি ফাতিমার থেকে থাঙ্গাল ইবনে আহামাদ সাইয়্যেদ ফাদল পুকোয়া থাঙ্গালকে জন্ম দেন, তিনি একজন বিশ্ববিখ্যাত আলেম, লেখক, দখলদারিত্ব বিরোধী বীর এবং মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
৫০ বছর বয়সে, তনুর পোনমুন্ডাম এলাকা থেকে থাঙ্গাল সাহেব আরেকটি বিয়ে করেন। এটি একটি আর্থিকভাবে সজ্জিত পরিবার ছিল। স্ত্রীর নাম ছিল আয়েশা। তিনি ছিলেন মুহিউদ্দীন নামের এক ব্যক্তির বোন, যিনি চেরুর শহীদদের মধ্যে ছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী জীবিত থাকাকালীন এই বিয়ে হয়েছিল। এই স্ত্রীর মাধ্যমে থাঙ্গল সাহেবের দুই কন্যা জন্ম হয়। তারা হলেন ফাতিমা ও সালিহা।
থাঙ্গাল সাহেব জীবিতকালীন তাঁর প্রথম স্ত্রীকে হারান। থাঙ্গাল সাহেবের শেষ স্ত্রী ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ তিমুরের 'দিলি'-র বাসিন্দা সালিহা। মৃত্যুর সময় থাঙ্গাল সাহেবের একমাত্র জীবিত স্ত্রী ছিলেন সলিহা বিবি।