এ কেমন মানবধিকার ও শান্তিকামী বিশ্ব সংস্থা ?
কিছুদিন পূর্বে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অন্যতম সংস্থা সাধারণ সভা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে মোট ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৫৮টি দেশ সম্মতি দিলেও আমেরিকা সহ ৮টি দেশ এর বিপক্ষে ভোটদান করে এবং ১২টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। আবার তারও কয়েকদিন আগে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী ১০ সদস্য রাষ্ট্রও গাজায় অবিলম্বে ও নিঃশর্তে ইসরাইলের হামলা বন্ধের আহ্বান জানাতে এক প্রস্তাব তুলেছিল। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি বর্তমানে গাজায় থাকা সব ইসরাইলি জিম্মির মুক্তির দাবিও করা হয়েছিল প্রস্তাবটিতে। সেই প্রস্তাবকে নিরাপত্তা পরিষদের মোট ১৫টি সদস্যদেশের মধ্যে ১৪টি দেশ পক্ষে ভোট দিলেও আমেরিকা বিপক্ষে ভোট দেয়। ফলে আবারও আটকে গিয়েছে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব। যেহুতু বাকি চারটি স্থায়ী সদস্যের মতো আমেরিকারও রয়েছে ভেটো ক্ষমতা। এছাড়াও আন্তর্জাতিক আদালত যুদ্ধাপরাধের জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু-এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এতেও কিন্তু পশ্চিমি বিশ্ব জোড়তোড়ভাবে স্বাগত জানায়নি।
তবে একেই কী বলে মানবধিকার, মানবতা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা? না, অন্তত আমি কখনোই একে মানবতা বলে মনে করি না। সাম্রাজ্যবাদী, ঔপনিবেশিকতাবাদী ও ধর্মীয় উগ্রবাদীদের চক্রান্তে বিশ্বজুড়ে ন্যায়বিচার, মানবতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা আজ বিপন্ন। এমনকি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জও এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠছে না বরং ভয়াবহ এক দাবানলে এক বাল্টি জল ঢালার ন্যায় ভূমিকা পালন করছে। অথচ এই সংস্থাটি নাকি বিশ্বব্যাপী শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাকে মূল লক্ষ্য বানিয়ে ১৯৪৫ সালে গড়ে ওঠে। যে বিশ্ব সংস্থাটি নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পৃথিবী থেকে যুদ্ধ, অনুন্নয়ন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঠেকার। কিন্তু অদ্য দেখা যাচ্ছে যারা প্রধানত এই সংস্থাটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তারাই আজ যুদ্ধে লেগে পড়ে রয়েছে। এমনকি এর সূত্রপাতের সময়ই শুরু হয়েছিল দুই মহাশক্তিধরের ঠান্ডা লড়াই। বিশ্বকে এক করার বদলে তাকে বিভক্ত করে নিজেদের প্রভাব বলয়ে আনাই তাদের আসল লক্ষ্য বলেই মনে হচ্ছে।
এমনকি, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের লক্ষ্য হিসেবে প্রস্তাবনায় আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠাকে চিহ্নিত করা হলেও বাস্তবে অতি শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশান্তি রক্ষার নামে বিশ্বব্যাপী একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দুর্বল রাষ্ট্রগুলির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালালেও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছে। এছাড়াও, ক্ষুদ্র-বৃহৎ জাতিসমূহের মধ্যে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাকে লক্ষ্য বলে প্রস্তবনাতে বলা হয়েছে। কিন্তু সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের হাতে ভেটো ক্ষমতা থাকায় এই লক্ষ্যটি কার্যক্ষেত্রে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। যার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত এই গত কয়েকদিন পূর্বের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ১৪টি দেশের সম্মতি থাকলেও আমেরিকার নিষেধাজ্ঞতা দেখলাম। এমনকি দেখা যায়, বহু অধিবেশনে সেই পাঁচ দেশের অনেকেই অনুপস্থিত থাকেন। গত বছর, ২০২৩ সালের কথাই ভাবুন। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পাঁচজনের একজন অনুপস্থিত ছিলেন। কারণ, তখন তিনি প্রতিবেশী এক দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় ব্যস্ত। আরও এক প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতির কারণ, এক রাজা তাঁর দেশে সফরে আসবেন, তাঁর দেখভাল করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। বিশ্বনেতাদের জন্য কোনটা অগ্রাধিকার, এ থেকেই বোঝা যায়।
এমতাস্থায় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুলে পরিনত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ সংস্থায় মার্কিন একাধিপত্য নিরঙ্কূশভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মোদ্দাকথায়, বর্তমানে একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে নিরাপত্তা পরিষদ সম্পূর্ণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রাধীনে চলে গেছে। তাই, যেসব বিবাদে নিরাপত্তা পরিষদের পঞ্চপ্রধান, অর্থাৎ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকে, সেই সব ক্ষেত্রে এর সাফল্য অপেক্ষা ব্যর্থতাই অধিক পরিমাণে চোখে পড়ে।
অধিকন্তু সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্যগুলির বাস্তব রূপায়ণের জন্য যে সাতটি নীতি অনুসরণের কথা সনদে ঘোষিত হয়েছিল সেই সমগ্র নীতিই আজ লঙ্ঘিত। কিন্তু লঙ্ঘিত হওয়ার কারণ কী তা সেই সাতটি নীতিকে একবার লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। প্রথমত, সনদে বলা হয়েছে, ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব সদস্য-রাষ্টই সমান। দ্বিতীয়ত, সকল সদস্য সামগ্রিক কল্যাণসাধনের জন্য দায়দায়িত্ব নিষ্ঠা সহকারে পালন করবে। তৃতীয়ত, শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজেদের মীমাংসা করবে। চতুর্থ, পারস্পারিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য কোনো রাষ্ট্রের ভৌগোলিক এলাকা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ করবে না। পঞ্চম, সব রাষ্ট্র সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করবে। ষষ্ঠ, কেউ অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার (domestic jurisdiction)-এ হস্তক্ষেপ করবে না এবং সপ্তম, যে সব রাষ্ট্র এর সদস্য নয় তারাও যাতে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য সনদের নীতিগুলি মেনে চলে সে বিষয়ে লক্ষ রাখা হবে। কিন্তু বড়ই আক্ষেপ যে আজ সমগ্র নীতিই লঙ্ঘিত। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি নিজ নিজ গোষ্ঠীস্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত থাকায় দায়দায়িত্বে নীতিগুলি লঙ্ঘিত হয়েছে। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক আইন কিংবা ন্যায়নীতি-ভঙ্গকারী কোনো বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বা তার কোনো মিত্ররাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করতে নিরাপত্তা পরিষদ বা সাধারণ সভা যেখানে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে নিজ সিদ্ধান্তকে কার্যকর করতে অক্ষম আন্তর্জাতিক বিচারলেয়ের কাছে বিশেষ কিছু আশা করা অর্থহীন। শান্তির প্রত্যাখ্যানকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনোরকম কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ওই দুটি সংস্থা-সহ মহাসচিবও ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ, সাধারণ সভা পরিষদকে বলা হয় নাকি বিশ্বের কন্ঠস্বর ও বিশ্বের আইন পরিষদ। যেমনকি মার্কিন রাষ্ট্রপতি অস্টিন বলেছিলেন, সাধারণ সভা মূলত বিশ্ব-বিবেকের কন্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অদ্যাপি ৭৯টি বছর কেটে গিয়েছে। অথচ অবস্থা বদলায়নি, বরং বহুগুণে অবনতি ঘটেছে।
এমনকি আরও একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, যে পাঁচটি দেশ জাতিপুঞ্জের আবির্ভাবের সময় থেকে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো অধিকার নিয়ে বসে আছে, তন্মধ্যে তিনটিই ইউরোপের। ফ্রান্স বা ব্রিটেন একসময় বিশ্বশক্তি ছিল, এখন তারা নিজেদের অতীতের ছায়ামাত্র। বাস্তবতা মেনে সরে দাঁড়াতে বললে তারা কখনই রাজি হবে না। অথচ আফ্রিকা মহাদেশ বা আরব দেশগুলি থেকে এই পরিষদে কোনও স্থায়ী সদস্য নেই। তৃতীয় বিশ্ব থেকে চীন আছে বটে, কিন্তু জনসংখ্যার দিক দিয়ে বৃহত্তম ভারত তেমন সুযোগ থেকে বঞ্চিত। লাতিন আমেরিকার কোনও দেশেরও সেখানে পা রাখার স্থায়ী কোনও জায়গা নেই। গত সাত দশকে বিশ্ব বদলেছে, কিন্তু বিশ্ব সংস্থা বদলায়নি। সবাই এ কথা মানেন, রাষ্ট্রসঙ্ঘকে ঢেলে সাজাতে হবে, কিন্তু ঢেলে সাজাতে হলে সবার আগে প্রয়োজন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের সম্মতি। সেই সম্মতিও আসবে না, অচলাবস্থার ও নিরসন হবে না।
পরিশেষে বলা যায়, যতদিন পর্যন্ত বিশ্ব-বিবেক জাগ্রত না হবে এবং মনুষ্যসমাজ জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠতে সক্ষম না হবে, ততদিন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে উদ্দেশ্য ও নীতিসমূহ বাস্তবে রূপায়িত হতে পারবে না। এমতাবস্থায় বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতার বন্ধন সুদৃঢ় করার একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ হিসেবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ যাতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে, সেজন্য জোটনিরপেক্ষ দেশগুলিকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ, সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, বর্ণবিদ্বেষ, রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল। কিন্তু উদারীকরণ (Liberalization) , বেসরকারিকরণ (privatization) এবং বিশ্বায়ন (globalization) এর স্লোগান তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো নয়া সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি কেবল বিশ্বব্যাপী নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের কাজেই আত্মনিয়োগ করেনি, সেই সঙ্গে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। তাদের সেই চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জেকে একটি প্রকৃত আন্তর্জাতিক মঞ্চে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হবে কি না, তা কেবল ভাবীকালের ইতিহাসই বলতে পারবে।
সর্বশেষে এক লেখকের মূল্যবান ভাবনাকেই তুলে ধরি, বিশ্বের কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা যুদ্ধ চান না, ধ্বংস চান না, মৃত্যুর মিছিল চান না। তাঁরা চান শান্ত, মৈত্রী, সৃষ্টি ও প্রগতি। তবে, শান্তি তো কারের করুণার দান নয়, হুমকির ফসল নয়। শান্তির জন্য যুঝতে হয়। মৃত্যুর মৃত্যু ঘটাতে হয়।