সিরিয়ায় আরব বসন্তের সফল পুনর্জন্ম, কিন্তু ভবিষ্যৎ শোঁয়াশাছন্ন

মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রীয় সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল সিরিয়ায় এবার প্রায় অর্ধশতাব্দীর আসাদ রাজত্বের পতনের সাথে সাথে রাজধানী দামেস্ক জুড়ে বিজয় উল্লাস ও উদযাপন দেখা দিয়েছে। তবে নতুন সরকারের স্থিতিশীলতা এবং সার্বভৌমত্ব কতটা নিশ্চিত ব্যাপারটি এখনও সংশয়পূর্ণ ও বিবেচনার বিষয়। প্রধান বিদ্রোহী নেতা আবু মুহাম্মদ আল-জোলানির নেতৃত্বে হাইয়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) ও অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্ট অভিযানের ঝড়ে মাত্র ১২ দিনের মধ্যে বিতর্কিত বাশার আল-আাসাদের অত্যাচারী, স্বৈরাচারী সরকার ধসে পরে। আত্ম-পরাজিত আসাদ তার পরিবার সহ লুকিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে কোথাও অজানা নির্বাসনে চলে যায়। 

শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের সঙ্গে সিরিয়া নতুন সরকার গঠনের পথে। মনে হচ্ছে ২০১১ সালে দমিত আরব বসন্ত এবার একটি সফল পুনর্জন্ম পেয়েছে, তবে অভ্যন্তরীণ ভগ্নাংশের দ্বন্দ্ব, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আক্রমণ এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা সিরিয়ার জনগণের উপর আবারও অনিশ্চয়তার একটি ভবিষ্যৎ উঁকি দিচ্ছে। তবে প্রত্যাশা এই যে সকল দুর্ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়ে একটি শান্তিপূর্ণ, সবার যোগ্য ও স্বাধীন শাম গড়ে উঠুক। 

ক্ষমতার স্বার্থে

আসাদ সরকারের পতন অনিবার্য ছিল। মৌলবাদী শক্তির উপর ভিত্তি করে কোনো সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পশ্চিমা ষড়যন্ত্রে ছিন্নভিন্ন হয়ে পরে। ১৯৪৬ সালে, সিরিয়া ফরাসি উপনিবেশবাদের ম্যান্ডেট শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। তবে, পশ্চিমা শক্তি বিশেষ করে আমেরিকা তার নিজস্ব স্বার্থের জন্য সরকার তৈরি এবং ভাঙতে শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে। 

তারপর আসাদ পরিবার ১৯৭১ সাল থেকে সিরিয়া শাসন করে আসছে। ২০০০ সালে হাফেজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর তার পুত্র বাশার স্থলাভিষিক্ত হয়। আলাউই পরিবার প্রচালিত প্রশাসন সংখ্যাগরিষ্ঠ অ-শাসক সুন্নি সম্প্রদায়ের উপর অত্যধিক নিপীড়ন চালিয়েছে। বিরোধী মুক্ত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে আসাদ নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, বুদ্ধিজীবীদের দমন, কারাবরণ ও অসংখ্য জনসাধারণের গুম করার মতো পদ্ধতি অবলম্বন করে। সিরিয়া শরণার্থী সঙ্কটের একটি প্রধান শিরোনাম হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ, জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, হাজার হাজার পরিবার তাদের প্রিয়জন কোথায় আছে তা না জানার মানসিক যন্ত্রণা বহন করে। বিভিন্ন আঞ্চলিক সামরিক শক্তির সমর্থনে শুধুমাত্র ক্ষমতার স্বার্থে আসাদ সরকার নিজ নাগরিক যথা সিরিয়ার লোকদের আক্রমণ করে, তাদের বাসস্থানে বোমাবর্ষণ করে দেশকে সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতা এবং অনাহারের মতো পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। সিরিয়ার জনগণের উপর আসাদ সরকার কর্তৃক নির্যাতনের কসাইখানা, গণ-ফাঁসি এবং অন্যান্য অমানবিক নৃশংসতা চালানো হয়েছিল। 

বলা বাহুল্য, নিপীড়ন ও দমনের মাপকাঠিতে ক্ষমতা বজায় রাখা হয় না। ইতিহাস এই সব নমুনার সাক্ষী। মানুষ বিদ্রোহী হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং পুরো ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে ফেলে। সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার জন্য সুশাসন শক্তিশালী হতে হবে, তবে ন্যায়বিচার, কল্যাণ ও জনগণের স্বার্থের ভিত্তিতে। যেহেতু সিরিয়া একটি ইসলামিক দেশ, সেই সার্বজনীন ইসলামী বিধান মেনে চলা উচিত ছিল যা এমনকি শাসককেও কোনো লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ করে, না কি নিজ স্বার্থের ব্যাখ্যা হয়ে পরে। 

আসাদ-নেতৃত্বাধীন বাথ পার্টি ২০১১ সালের আরব বসন্তের অভ্যুত্থান চরম নিপীড়ণের সাথে দমন করে। পরবর্তীতে, সহিংসতা আরও বেড়ে যায় যা বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং সরকারী সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘাত গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। অবশেষে, আজ একটি ভিন্ন চিত্র যেখানে আসাদের পতন এবং আবু মুহাম্মদ আল-জোলানির নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের জোট একটি নব যুগ চিহ্নিত করে নতুন সরকার গঠন করছে।

বিপ্লবের পথে 

আহরার আল-শাম, জাইশ আল-ইজ্জা, ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট, নূর আল-দিন জেঙ্গি সহ প্রভৃতি বিরোধী গোষ্ঠী আহমেদ হুসেইন আল-শার'আ ওরফে আবু মুহাম্মদ আল-জুলানি পরিচালিত হাইয়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর নেতৃত্বে আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐকবদ্ধ হয়। এই অভিযানের সময়টাও ছিল বেশ সূক্ষ্ম, যেহেতু আসাদ সমর্থক শক্তি হিজবুল্লাহ, ইরান, রাশিয়া অন্যান্য যুদ্ধে জড়িত থাকায় সিরিয়ায় তাদের তুলনামূলক শূন্যতা দেখা যায়।  

রাশিয়া, ইরান এবং অন্যান্য মার্কিন শত্রুদের সাথে জোটবদ্ধ হওয়ায় আমেরিকা আসাদ সরকারের সাথে খুশি ছিল না। তাছাড়া, আসাদ হিজবুল্লাহর মতো প্রক্সি বাহিনীর সমর্থন পেতে থাকে যা সীমান্ত আক্রমণের মাধ্যমে ইসরায়েলকে বারবার ক্রোধান্বিত করে।  

গত ২৯ নভেম্বর ঐকবদ্ধ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি দামেস্কের উত্তরে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পোতে আক্রমণ শুরু করে এবং দখল করে ফেলে। ডিসেম্বর ২০১৬-এর পর এইরকম প্রথমবার ছিল। ঝড়ের গতিতে তারা পরস্পর ৫ ডিসেম্বরে হামা, ৬-এ দারা, ৭-এ হোমস এবং অবশেষে ৮ তারিখে সরকারী বাহিনীর কোন ভারী পাল্টা অপরাধ ছাড়াই রাজধানী দামেস্ক দখল করে। আসাদ রাজত্ব ছেড়ে কোনো অজ্ঞাত স্থানে, সম্ভবত মস্কোতে, নির্বাসনে চলে যায়। 

মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন যুগকে স্বাগত জানাতে দেশজুড়ে উদযাপন দেখা যাচ্ছে। আসাদের নৃশংস কারাগার ভেঙে হাজার হাজার নর-নারী বেরিয়ে আসছে, মসজিদগুলো আলোকিত হয়েছে, রাস্তাগুলো উল্লাসের মুগ্ধতায় ভরে গেছে - অনুরূপ অনেক দৃশ্য।  

আশা ও আশঙ্কার ভবিষ্যৎ 

কিন্তু অনেকগুলি আশার মধ্যে কিছু অনিশ্চয়তার আশঙ্কাও লুকিয়ে আছে। প্রথমত আবু মুহাম্মদ আল-জোলানির আবু বকর আল-আবগদাদি পরিচালিত আল-কায়েদা গোষ্ঠীর সদস্য ছিল যা মুসলমানদের বিশ্বব্যাপি প্রচণ্ড ক্ষতি করেছে। এই সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, পশ্চিমা শক্তির প্রতিনিধি  হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে । যাইহোক, ভালো খবর হল যে আল-জোলানি বহু বছর আগেই এই গোষ্ঠী থেকে প্রস্থান করে হাইয়াত তাহরির আল-শামের মাধ্যমে এক নিজস্ব পথ প্রতিষ্ঠা করে যার এই ঐতিহাসিক বিজয় এক বিরাট সাফল্য। 

দ্বিতীয়ত, বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অনেক অভিজ্ঞের মত এই রূপ যে আসাদের পতন বাহ্যিক কিছু পশ্চিমা শক্তি এবং ইসরাইলের চক্রান্তে হয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে বৃহত্তর ইসরায়েলের ঔপনিবেশিক আকাঙ্খা পূরণ হতে সময় লাগবে না। ইতিমধ্যেই, গোলান হাইটস সংলগ্ন নিষ্ক্রিয় অঞ্চল জুড়ে ইসরায়েলি সেনা মোতায়েনের কথা শোনা গেছে। অবশেষে, সিরিয়াকে লিবিয়ায় পরিণত হতে বেশি সময় লাগবেনা। 

এই দুটি প্রধান আশঙ্কা সিরিয়ার প্রত্যাশিত শান্তিপুর্ণ ও স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ অর্জনে বিপত্তি হয়ে দাড়াতে পারে। আসন্ন সরকারের প্রয়োজন দেশীয় জনসাধারণের কল্যাণের পরিকল্পনা করা যাতে অতীতের ক্ষতি পূরণ করা যায়, বাহ্যিক শক্তির প্রভাব থেকে নিজ স্বতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, বিভিন্ন স্থানীয় সংস্থা ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংহতি বজায় রাখা যাতে আবার কোনো সহিংসতা দেশকে ভেঙে না ফেলে। 

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter