লাইলাতুর রাগাইব: রজব মাসের প্রথম শুক্রবার রাতের অপরূপ করুণা ও রহমতের রাত
ভূমিকা
লাইলাতুর রাগাইব, যা রজব মাসের প্রথম শুক্রবারের আগের বৃহস্পতিবার রাতকে বোঝায়, ইসলামী ক্যালেন্ডারের তিন পবিত্র মাসের (রজব, শাবান ও রমজান) সূচনা করে। এই রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ রহমত বর্ষণ করেন এবং সাধু আমলের ফলাফল অসংখ্যগুণ বৃদ্ধি পায় বলে বিশ্বাস করা হয়। রাগাইব শব্দের অর্থ ‘বহুত্ব’ বা ‘অনেকগুলো কামনা’, যা নির্দেশ করে যে এই রাতে দোয়া ও ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা তার হৃদয়ের খাঁটি চাহিদা আল্লাহর কাছে পেশ করতে পারে। এটি শুধু একটি রাত নয়, বরং আত্মিক জাগরণ, তওবা এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুবর্ণ সুযোগ। মুসলিম উম্মাহ এই রাতকে বিশেষ নামাজ, রোজা, দোয়া ও জিকিরের মাধ্যমে পালন করে, যা তাদের জীবনে শান্তি ও বরকত নিয়ে আসে। ঐতিহাসিকভাবে এই রাতের গুরুত্ব জেরুজালেম থেকে শুরু হয়েছে এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন ইসলামী সম্প্রদায়ে প্রচলিত হয়েছে, যদিও কিছু আলেম এটিকে বিদআত হিসেবে দেখলেও সাধারণত এর আমলগুলোকে উত্তম বলে মেনে নেয়া হয় । এই নিবন্ধে আমরা এই পবিত্র রাতের ইতিহাস, গুরুত্ব, আমল এবং তাৎপর্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে পাঠকরা এর আলোকে নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারেন।
ইতিহাস ও উৎপত্তি
লাইলাতুর রাগাইবের ঐতিহ্য প্রধানত ১১শ শতাব্দীতে জেরুজালেমে শুরু হয়, যেখানে আবু বকর আল-তুরতুশি (১০৫৯-১১২৬ খ্রি.) এর সময় থেকে এই নামাজের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। একটি দুর্বল সনদযুক্ত হাদিসের ভিত্তিতে এটি প্রচলিত হয়েছে, যা আবুল হাসান আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জাহদাম (মৃ. ১০২৩) এর নামে জালিয়াতি বলে বিবেচিত। এই হাদিসে বলা হয়েছে যে রজবের প্রথম শুক্রবারের আগের রাতে বিশেষ নামাজ পড়লে কামনা পূরণ হয়। ইজযাদ্দিন ইবনে জামাকর এটিকে অগ্রহণীয় বিদআত বললেও ইবনুস সালাহ এটিকে বিদআত হাসানাহ (ভালো বিদআত) বলে মেনে নেন, কারণ এটি নামাজের প্রতি উৎসাহিত করে। ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে আইয়ুবী সুলতান আল-মালিক আল-কামিল এটি মসজিদে নিষিদ্ধ করেন, কিন্তু জনপ্রিয়তার কারণে কয়েক বছর পর পুনরায় অনুমোদিত হয়। ১৮শ শতাব্দীতে ওসমানী আমলে রাগাইব রাতে নবী (সা.)-এর প্রশংসামূলক কবিতা রেগাইবিয়্যে রচিত হয়, যেমন সেলাহাদ্দিন উশশাকির মাসনাউই মাতলাউল ফেজর। বাংলা অঞ্চলে এটি সুফি ঐতিহ্যের সাথে মিশে প্রচলিত, যেখানে মসজিদ ও খানকাহগুলোতে বিশেষ সমাবেশ হয়। এই ইতিহাস দেখায় যে লাইলাতুর রাগাইব ধীরে ধীরে ইসলামী সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে, যদিও এর মূল ভিত্তি কুরআন-হাদিসের সাধারণ নির্দেশনা যেমন রজব মাসের ফযলত । এর মাধ্যমে মুসলিমরা আল্লাহর রহমতের সন্ধান করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
ধর্মীয় গুরুত্ব
রজব মাস ইসলামী চন্দ্রবর্ষের সাতটি সম্মানিত মাসের (আশহুরে হুরুম) অন্যতম, যা কুরআন মজীদে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত (সূরা তাওবা: ৩৬)—‘আল্লাহর কাছে মাসগুলোর সংখ্যা বারো, যার মধ্যে চারটি পবিত্র।’ এই মাস লাইলাতুর রাগাইবের মাধ্যমে শুরু হয়ে শাবান ও রমজানের পথ প্রশস্ত করে, যা আত্মশুদ্ধি ও তওবার সুবর্ণকাল। রাসূল (সা.) রজব জুড়ে অতিরিক্ত ইবাদত করতেন, রোজা রাখতেন এবং দোয়া পাঠ করতেন: ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবানা ওয়া বাল্লিগনা রামাদান’ (বুখারী-মুসলিম)।
লাইলাতুর রাগাইবের বিশেষ ফজিলত যেমন ‘৭০ হাজার গুণ সওয়াব’ দুর্বল বর্ণনাভিত্তিক এবং বেশিরভাগ আলেম এটিকে অগ্রহণীয় বলেন। তবে এই রাতে সাধারণ আমল—নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির, তওবা—অত্যন্ত ফলপ্রসূ, কারণ রজবের সামগ্রিক পবিত্রতা সহিহ। এটি তওবার দরজা খোলে, বান্দাকে গুনাহ থেকে মুক্ত করে এবং আল্লাহর রহমত আকর্ষণ করে। শিয়া ঐতিহ্যে এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কিছু দুর্বল বর্ণনায় নবী (সা.)-এর জন্মের সাথে যুক্ত। সুন্নিরা সাধারণ রাতের ইবাদতে উৎসাহিত। এই রাতে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের দোয়া কবুল করেন বলে বিশ্বাস, যা দুনিয়া-আখিরাতের খাঁটি কামনা—জান্নাত, গুনাহ মাফ, স্বাস্থ্য, সন্তান—পূরণ করে। বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙালি মুসলিমরা এটিকে পরিবারিক ঐক্যের সুযোগ হিসেবে পালন করে, যা সমাজে শান্তি ও দানশীলতা বাড়ায়। সার্বিকভাবে, লাইলাতুর রাগাইব ইসলামের রহমতময়তা ও তওবার প্রকাশ, যা সকলে সহিহ আমলের মাধ্যমে লাভ করতে পারেন।
লাইলাতুর রাগাইবের আমলসমূহ
এই পবিত্র রাতে প্রচলিত আমলগুলো হৃদয়কে আল্লাহর নৈকট্যে নিয়ে যায়, যদিও বিশেষ নামাজের হাদিসগুলো দুর্বল বা জাল বলে মুহাদ্দিসগণ (ইবন রাজাব, ইবন হাজার, সুয়ূতী) সতর্ক করেছেন। সালাতুর রাগাইবের রাকাত সংখ্যা, সূরা কিরাত ও ফজিলত সবই ভিত্তিহীন, কিন্তু রজবের সাধারণ ইবাদত উত্তম। প্রধান আমল হিসেবে রজবের প্রথম বৃহস্পতিবার রোজা রাখা গ্রহণযোগ্য, যা মাসের পবিত্রতার আলোকে সওয়াবময়। প্রচলিত (দুর্বল ভিত্তিক) ১২ রাকাত নফল নামাজ (মাগরিব-ইশার মধ্যে, ৬ সেটে বিভক্ত): প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ৩ বার সূরা কাদর এবং ১২ বার সূরা ইখলাস পাঠ। নামাজ শেষে ১০০ বার আল্লাহুম্মা সালি আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলে মুহাম্মাদ পড়া এবং বিশেষ দোয়া (দোয়া কুমাইল শিয়াদের মধ্যে প্রচলিত)। এক দুর্বল বর্ণনায় বলা হয়েছে, এটি পড়লে কিয়ামতের রাতে ফেরেশতা সঙ্গী হবে—কিন্তু এটি সহিহ নয়।
সকলের জন্য উত্তম সহিহ আমল:
রাত জেগে কুরআন তিলাওয়াত ও তসবিহ: সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার প্রত্যেকটি ১০০ বার।
সদকা দেয়া, দরূদ শরীফ পাঠ, ইতিকাফ। গাফিলাত থেকে তওবা এবং পরিবারের সাথে দোয়া—সহজ ও ফলপ্রসূ। বাঙালি সম্প্রদায়ে মসজিদে জামাত নামাজ, ওয়াজ মাহফিল ও মিলাদের আয়োজন হয়, যদিও বাংলাদেশে এটি তুলনামূলকভাবে কম প্রসিদ্ধ। সকলে সাধারণ নফল নামাজ, রোজা ও জিকিরের উপর জোর দিন—এগুলো সহিহ পথে রজবের ফজিলত লাভ করে। এভাবে আমলগুলো সহজ হলেও আল্লাহর রহমত আকর্ষণ করে।
সুন্নি আলেমদের মধ্যে লাইলাতুর রাগাইবের বিশেষ নামাজকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদআত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ইমাম নববী (শাফেয়ী), ইবন হাজার আসকালানীসহ মুহাদ্দিসগণ এর হাদিসগুলোকে জালিয়াতি বলে প্রমাণ করেছেন, কারণ সালাতুর রাগাইবের রাকাত সংখ্যা, সূরা কিরাত ও ফজিলতের বর্ণনা সহিহ নয়। তবে কিছু আলেম যেমন ইবনুস সালাহ এটিকে ‘বিদআত হাসানাহ’ (ভালো বিদআত) বলে মেনে নেন, কারণ এটি নামাজের প্রতি উৎসাহ যোগায়। হানাফি ও শাফেয়ী মাজহাবে এর প্রচলন স্থানীয়ভাবে দেখা যায়, যদিও বাংলাদেশে তেমন প্রসিদ্ধ নয়।
বাঙালি সমাজে প্রভাব ও উদযাপন
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজে লাইলাতুর রাগাইব একটি জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক উৎসব, যা মাদ্রাসা, মসজিদ ও স্থানীয় সমাজকেন্দ্রগুলোকে কেন্দ্র করে পালিত হয়। গ্রামাঞ্চলে পরিবারগুলো রজবের প্রথম বৃহস্পতিবার রোজা রেখে সবুজ পতাকা ঝুলিয়ে ঘর সাজায় এবং মসজিদে জামাত নামাজ আদায় করে। শহরাঞ্চলে মিলাদমাহফিল, ওয়াজ মাহফিল এবং খাদিমের আয়োজন হয়, যেখানে নবী (সা.)-এর প্রশংসায় নাতশরীফ ও লোকগান গাওয়া হয়। সুফি সাধক ও তরিকা অনুসারীরা এর মাধ্যমে তাসাউফের শিক্ষা প্রচার করেন; নকশবন্দিয়া, চিশতিয়া খানকাহগুলোতে বিশেষ জিকির মজলিস হয়। আধুনিক যুগে সোশ্যাল মিডিয়ায় দোয়া, আমলের ভিডিও শেয়ার হয় এবং জুম ওয়াজের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সংযোগ স্থাপিত হয়। করোনা মহামারীর সময় ভার্চুয়াল লাইভ সম্প্রচার চালু ছিল, যা ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছে।
এর প্রভাব হলো আত্মিক উন্নয়ন, দানশীলতা বৃদ্ধি এবং সমাজে শান্তি-সম্প্রীতি। এটি পরিবারিক ঐক্য জোরদার করে এবং যুবকদের ইবাদতে আকৃষ্ট করে। যদিও কিছু আলেম এর বিশেষ আমলকে বিদআত বলেন, সাধারণ নামাজ-রোজা ও দোয়া সকলেই গ্রহণযোগ্য। এভাবে লাইলাতুর রাগাইব বাঙালি মুসলিমদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, রজব মাসের আধ্যাত্মিক পরিবেশ গড়ে তোলে।
উপসংহার
লাইলাতুর রাগাইব আমাদের জীবনে আল্লাহর সীমাহীন রহমতের স্মৃতি জাগায়। এই পবিত্র রাত রজব মাসের সূচনা করে, যা কুরআন মজীদে সাতটি সম্মানিত মাসের অন্যতম (সূরা তাওবা: ৩৬)। যদিও এর বিশেষ নামাজ ও ফজিলতের বর্ণনাসমূহ দুর্বল হাদিসভিত্তিক এবং কিছু আলেম এটিকে বিদআত বলে মনে করেন (যেমন ইমাম নববী, ইবন তাইমিয়া), তবুও রজবের সাধারণ ফজিলত, রোজা, নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও জিকিরের আমল সকলেই উত্তম এবং সওয়াবময়। এই রাতে খাঁটি ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা তার হৃদয়ের কামনা—জান্নাত লাভ, গুনাহ মাফ, স্বাস্থ্য ও উম্মাহের কল্যাণ—আল্লাহর কাছে পেশ করে।
এর মাধ্যমে আমরা দুনিয়ার ফিতনা থেকে মুক্তি পাই, আত্মিক জাগরণ লাভ করি এবং মুসলিম ঐক্য শক্তিশালী করি। বাঙালি সমাজে এটি পরিবারিক ঐক্য ও দানশীলতার প্রতীক, যা সুফি ঐতিহ্যের সাথে মিলে সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি যোগ করে। আসন্ন রজব মাসে এই সুযোগকে সদ্ব্যবহার করে জীবনকে আল্লাহকেন্দ্রিক করে তুলুন। সহিহ আমলের উপর জোর দিয়ে তওবা করুন, দরূদ পড়ুন এবং সকলের জন্য দোয়া করুন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে এই রাতের ফজিলত লাভ করতে সাহায্য করুন, আমল কবুল করুন এবং উম্মাহকে একত্রিত করুন। আমীন।