নবীদের মুজিযার পেছনে আল্লাহর উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য

যুগের পর যুগ আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছেন অসংখ্য নবী ও রাসূল (আঃ)। তাঁদের প্রত্যেককে নির্দিষ্ট কিছু মুজিযা—অর্থাৎ এমন অতিপ্রাকৃত নিদর্শনসমূহ যা সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মকে অতিক্রম করে এবং নবুয়তের সত্যতা প্রমাণ করে, দিয়ে প্রেরিত করা হয়েছিলো। তবে এই মুজিযাগুলো হঠাৎসিদ্ধ বা উদ্দেশ্যহীন ছিল না। মুমিনদের বিশ্বাস, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা প্রতিটি নবী ও জাতির প্রেক্ষাপট এবং চাহিদা অনুসারে সুন্দরভাবে নির্ধারণ করেছেন মুজিযার ধরন, যা ছিল সেই জাতির কাছে সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রভাববিস্তারকারী। এই প্রবন্ধে আমরা নবিদের মুজিযার পেছনে আল্লাহর অসীম হিকমতের প্রতি আলোকপাত করব, যা তাঁর সর্বশক্তিময়তা ও ইসলাম প্রচারে এই নিদর্শনসমূহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে উন্মোচিত করে।

মু’জিযার উদ্দেশ্য

মুজিযার তাৎপর্য অনুধাবনের পূর্বে আমাদের উচিত আল্লাহর সর্বসত্ত্বাধিকার স্বীকৃতি দেওয়া। আল্লাহ তাআলা হচ্ছেন সমগ্র সৃষ্টির স্রষ্টা ও পালনকর্তা। অতএব, মুজিযা হচ্ছে তাঁর কুদরতের প্রকাশ, যা জাগতিক নিয়মকানুনকে অতিক্রম করে। নবীগণ নিজেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী নন; বরং তাঁরা আল্লাহর মনোনীত প্রতিনিধি, যাঁদের মাধ্যমে তিনি স্বীয় বার্তা পৌঁছে দেন। নবুয়তের বিরোধীরা প্রাচীনকাল থেকেই এই ধারণায় সন্দেহ পোষণ করে আসছে যে একজন সাধারণ মানুষ, যিনি খাদ্য গ্রহণ করেন, বাজারে চলাফেরা করেন—কীভাবে তিনি ঐশী বার্তার বাহক হতে পারেন? কুরআনুল কারীমে এ বিষয়ে বলা হয়েছে:

وَقَالُوا۟ مَالِ هَـٰذَا ٱلرَّسُولِ يَأْكُلُ ٱلطَّعَامَ وَيَمْشِى فِى ٱلْأَسْوَاقِ ۙ لَوْلَآ أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌۭ فَيَكُونَ مَعَهُۥ نَذِيرًا * أَوْ يُلْقَىٰٓ إِلَيْهِ كَنزٌ أَوْ تَكُونُ لَهُۥ جَنَّةٌۭ يَأْكُلُ مِنْهَا ۚ وَقَالَ ٱلظَّـٰلِمُونَ إِن تَتَّبِعُونَ إِلَّا رَجُلًۭا مَّسْحُورًا

“তারা বলে- ‘এ কেমন রসূল যে খাবার খায়, আর হাট-বাজারে চলাফেরা করে? তার কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় না কেন যে তার সঙ্গে থাকত সতর্ককারী হয়ে? অথবা তাকে ধনভান্ডার ঢেলে দেয়া হয় না কেন অথবা তার জন্য একটি বাগান হয় না কেন যা থেকে সে খেতে পারে?’ যালিমরা বলে, ‘তোমরা শুধু এক যাদুগ্রস্ত লোকের অনুসরণ করছ’।”

— (সূরা আল-ফুরকান, ২৫:৭-৮)

এই ধরনের সংশয় থেকেই অনেক সময় নবুয়তকে তারা জাদু, ভ্রান্তি বা অদৃশ্য শক্তির প্রভাব বলে ব্যাখ্যা করেছে। তারা নবীগণের কাছ থেকে অলঙ্ঘনীয় প্রমাণ চেয়েছে, যেমন:

۞ قَالَتْ رُسُلُهُمْ أَفِى ٱللَّهِ شَكٌّۭ فَاطِرِ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ ۖ يَدْعُوكُمْ لِيَغْفِرَ لَكُم مِّن ذُنُوبِكُمْ وَيُؤَخِّرَكُمْ إِلَىٰٓ أَجَلٍۢ مُّسَمًّۭى ۚ قَالُوٓا۟ إِنْ أَنتُمْ إِلَّا بَشَرٌۭ مِّثْلُنَا تُرِيدُونَ أَن تَصُدُّونَا عَمَّا كَانَ يَعْبُدُ ءَابَآؤُنَا فَأْتُونَا بِسُلْطَـٰنٍۢ مُّبِينٍۢ 

“তাদের রাসূলগণ বলেছিল, ‘আল্লাহর ব্যাপারেও কি সন্দেহ, যিনি আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা? তিনি তোমাদেরকে আহবান করেন যাতে তিনি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করেন এবং তিনি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদেরকে অবকাশ দেন’। তারা বলল, ‘তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ, ‘তোমরা আমাদেরকে আমাদের পিতৃপুরুষরা যার ইবাদাত করত, তা থেকে ফিরাতে চাও। অতএব তোমরা আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে আস’।”

— (সূরা ইব্রাহীম, ১৪:১০)

মুজিযার প্রাসঙ্গিকতা ও প্রভাব

আল্লাহ তাআলা নবীদের মুজিযা দান করেছেন যাতে তা নবুয়তের সত্যতা প্রতিপাদন করে এবং সংশয়বাদীদের হৃদয়ে ঈমানের জ্যোতি প্রজ্বালিত করে। এগুলো শুধুই আশ্চর্যজনক ঘটনা নয়, বরং এমন নিদর্শন যা প্রকৃতির গণ্ডি ছাড়িয়ে যায় এবং সরাসরি আল্লাহর কুদরতের সাক্ষ্য বহন করে।

মুসা (আ.)-এর লাঠির সাপ হয়ে যাওয়া

প্রত্যেক নবীর মুজিযা তাঁর যুগ ও জাতির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন, মিসরের ফেরাউন ও তার রাজসভা ছিল যাদু ও জাদুকরের জন্য বিখ্যাত। সেই প্রেক্ষাপটে মুসা (আ.)-এর লাঠি সাপে রূপান্তরিত হওয়া এবং জাদুকরদের মিথ্যা কারসাজি গ্রাস করে ফেলা ছিল এক বিশাল অলৌকিক নিদর্শন।

۞ وَأَوْحَيْنَآ إِلَىٰ مُوسَىٰٓ أَنْ أَلْقِ عَصَاكَ ۖ فَإِذَا هِىَ تَلْقَفُ مَا يَأْفِكُونَ

“আর আমি মূসার প্রতি ওহী পাঠালাম যে, ‘তুমি তোমার লাঠি ছেড়ে দাও’ তৎক্ষণাৎ সে গিলতে লাগল সেগুলিকে যে অলীক বস্তু তারা বানিয়েছিল।”

— (সূরা আ'রাফ, ৭:১১৭)

এই ঘটনায় জাদুকররাও স্বীকার করে নেয় যে এটি কোনো জাদু নয়, বরং খাঁটি ঐশী নিদর্শন। ততক্ষনাত তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং ঈমান গ্রহণ করে।

ঈসা (আ.)-এর কুষ্ঠ রোগ সারানো

ঈসা (আ.)-এর যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। তখনকার চিকিৎসকরা অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা করতে সক্ষম ছিলেন। সে সময় ঈসা (আ.) আল্লাহর ইচ্ছায় এমন রোগ যেমন কুষ্ঠ, যা তখনকার চিকিৎসা দিয়ে সারানো যেত না, তা নিরাময় করতেন, এমনকি মৃতকে জীবিত করতেন।

إِذْ قَالَ ٱللَّهُ يَـٰعِيسَى ٱبْنَ مَرْيَمَ ٱذْكُرْ نِعْمَتِى عَلَيْكَ وَعَلَىٰ وَٰلِدَتِكَ إِذْ أَيَّدتُّكَ بِرُوحِ ٱلْقُدُسِ تُكَلِّمُ ٱلنَّاسَ فِى ٱلْمَهْدِ وَكَهْلًۭا ۖ وَإِذْ عَلَّمْتُكَ ٱلْكِتَـٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَٱلتَّوْرَىٰةَ وَٱلْإِنجِيلَ ۖ وَإِذْ تَخْلُقُ مِنَ ٱلطِّينِ كَهَيْـَٔةِ ٱلطَّيْرِ بِإِذْنِى فَتَنفُخُ فِيهَا فَتَكُونُ طَيْرًۢا بِإِذْنِى ۖ وَتُبْرِئُ ٱلْأَكْمَهَ وَٱلْأَبْرَصَ بِإِذْنِى ۖ وَإِذْ تُخْرِجُ ٱلْمَوْتَىٰ بِإِذْنِى ۖ وَإِذْ كَفَفْتُ بَنِىٓ إِسْرَٰٓءِيلَ عَنكَ إِذْ جِئْتَهُم بِٱلْبَيِّنَـٰتِ فَقَالَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِنْهُمْ إِنْ هَـٰذَآ إِلَّا سِحْرٌۭ مُّبِينٌۭ

যখন আল্লাহ বললেন, “হে ঈসা, মরিয়ম পুত্র, তোমার প্রতি এবং তোমার মাতার প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ করো, যখন আমি তোমাকে পবিত্র আত্মা দ্বারা শক্তিশালী করেছিলাম, যার ফলে তুমি কোলে থাকা অবস্থায় এবং পরিণত বয়সে মানুষের সাথে কথা বলতে, এবং যখন আমি তোমাকে কিতাব, জ্ঞান, তওরাত ও ইঞ্জিল শিক্ষা দিয়েছিলাম, এবং যখন তুমি আমার অনুমতিতে মাটি দিয়ে পাখির আকৃতির মতো সৃষ্টি করেছিলে।” তারপর তুমি তাতে ফুঁ দাও, তখন আমার অনুমতিতে এটি পাখি হয়ে যায়। আর তুমি আমার অনুমতিতে অন্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য করো। আর যখন তুমি আমার অনুমতিতে মৃতদের জীবিত করো। আর যখন আমি বনী ইসরাঈলদের তোমার কাছ থেকে বিরত রেখেছিলাম যখন তুমি তাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছিলে। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা কাফের ছিল তারা বলল, “এটা তো স্পষ্ট জাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।”— (সূরা আল-মায়েদা, ৫:১১০)

হযরত ওহব ইবনে মুনাব্বিহ বর্ণনা করেন, কখনো কখনো একসঙ্গে পঞ্চাশ হাজার মানুষ ঈসা (আ.)-এর কাছে রোগমুক্তির আশায় সমবেত হতেন।

মুহাম্মদ (সা.)-এরঅবতীর্ণ কুরআনের অলৌকিকতা

মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগে আরবরা ছিল ভাষার জাদুকর। কাব্য ও বক্তৃতা ছিল তাদের অহংকার। তাই আল্লাহ তাআলা তাঁকে এমন এক মুজিযা দান করেন যা ভাষার উচ্চতম শিখরে থেকেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী—এটি হলো পবিত্র কুরআন। কুরআনের ভাষা, ছন্দ, গঠন এবং বার্তা এমনভাবে আরবদের চমকিত করেছিল যে তারা এর সমকক্ষ কিছু তৈরি করতে ব্যর্থ হয়।

وَإِن كُنتُمْ فِى رَيْبٍۢ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا فَأْتُوا۟ بِسُورَةٍۢ مِّن مِّثْلِهِۦ وَٱدْعُوا۟ شُهَدَآءَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمْ صَـٰدِقِينَ

“যদি তোমরা আমাদের বান্দার প্রতি নাযিলকৃত কুরআনে সন্দেহ পোষণ করো, তাহলে এর মতো একটি সূরা রচনা করো।”

— (সূরা আল-বাকারা, ২:২৩)

এমনকি, আল্লাহর রাসূল (সা.) নিজেও বলেন:

“আমাকে এমন শব্দসমূহ দান করা হয়েছে, যা অল্প কথায় অধিক অর্থ বহন করে।”

— (সহীহ বুখারী)

উপসংহার

মুজিযাগুলো নিছক অলৌকিকতা নয়; বরং এগুলো ছিল আল্লাহর হিকমতসম্পন্ন নিদর্শন, যা নবুয়তের সত্যতা প্রমাণ করে এবং মানুষকে ঈমানের দিকে আহ্বান করে। প্রতিটি মুজিযা ছিল সংশ্লিষ্ট যুগের দৃষ্টিভঙ্গি, বৈজ্ঞানিক উন্নতি ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী অত্যন্ত যথাযথ ও ফলপ্রসূ। এভাবে আমরা দেখতে পাই, আল্লাহ তাআলার হিকমত কিভাবে প্রতিটি যুগে তাঁর বার্তাবাহকদের মাধ্যমে যথার্থ প্রমাণ ও নির্দেশনা প্রদান করেছেন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter