বাংলার মাটিতে ইসলামের সূর্য উদয়

বাংলা আক্রমণের বহু আগেই আরব, তুর্কি, আফগানসহ অন্যান্য মুসলিম শাসকরা ভারতবর্ষে রাজ্য বিড়ার শুরু করেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলায় সেন রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটে। হিন্দু বৌদ্ধ শাসনের অবসান ঘটলেও শুরু হয় বিদেশী মুসলিম শাসন। কারণ ইসলামের আবির্ভাব এ দেশের ঐতিহ্যবাহী সমাজ ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। 

কে ছিলেন বখতিয়ার খিলজি:

ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি  ছিলেন বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা।তিনি বর্তমান দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমান্দের গরমসিরে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখাইনেই বড়ো হন। তিনি খালাজ উপজাতির সদস্য ছিলেন, যেটি তুর্কি বংশোদ্ভূত এবং ২০০বছরেরও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তানে বসতি স্থাপনের পর অবশেষে খিলজি উপজাতি সৃষ্টির দিকে পরিচালিত করে।তবুও তাঁর প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না, তবে মনে হয় তিনি দারিদ্রের মধ্যে তার জন্মভূমি ছেড়েছিলেন এবং নিজের শ্রমের উপর নির্ভর করে ভাগ্য গড়ার চেষ্টা করেছিলেন।বখতিয়ার খলজি ছিলেন ঘুরিদ শাসক মুহাম্মদ ঘোরীর একজন তুর্কো-আফগান সামরিক জেনারেল, যিনি বাংলা ও বিহারের পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে মুসলিম বিজয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং নিজেকে তাদের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলার খলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, যেটি ১২০৩ থেকে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অল্প সময়ের জন্য বাংলা শাসন করেছিল।

১১৯৭ এবং ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে খলজির আক্রমণের ফলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ব্যাপক ভাবে গণহত্যা চালানো হয় এবং উত্তর ভারতে উচ্চ শিক্ষার ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মারাত্মক ক্ষতি হয়। বাংলায়, খলজির রাজত্ব ইসলামের দ্বারা বৌদ্ধ ধর্মের স্থানচ্যুতির জন্য দায়ী ছিল। তাঁর শাসন বাংলায় ইসলামী শাসনের সূচনা করেছিল বলে জানা যায়, বিশেষ করে বাংলা সালতানাত এবং মুঘল বাংলার।

 সুলতান মুহম্মদ ঘোরি ভারতীয় উপমহাদেশে অভিযানে নিয়োজিত ছিলেন। যাইহোক, বখতিয়ার খলজি ব্যর্থভাবে গজনীতে সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর অধীনে সামরিক বিভাগে চাকরির জন্য আবেদন করেন। তখনকার দিনে প্রত্যেক সৈন্যকে নিজস্ব অস্ত্র ও ঘোড়া সংগ্রহ করতে হতো। কিন্তু সামর্থ্যের অভাবে বখতিয়ার খলজিও সংগ্রহ করতে পারেননি। তদুপরি, বখতিয়ার, তার আঁকাবাঁকা বাহু এবং কুৎসিত মুখ দিয়ে, কমান্ডারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। গজনীতে ব্যর্থ হওয়ার পর, বখতিয়ার খলজি দিল্লীতে আসেন এবং দিল্লীর শাসক কুতুবউদ্দিন আইবেকের দরবারে হাজির হন। তবে সেখানেও তিনি সেনাপ্রধানের সহানুভূতি পেতে ব্যর্থ হন।

অতঃপর তিনি বাদাউনে যান এবং বদাউনের শাসক মালিক হিজবরুদ্দিন তাকে বেতনে নিযুক্ত করেন। কিন্তু বখতিয়ার এমন চাকরিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিছুকাল কাজ করার পর, তিনি অযোধ্যায় যান এবং অযোধ্যার শাসক মালিক হুসামুদ্দিন বখতিয়ার খলজির প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে ভিউলি ও ভাগবত নামে দুটি পরগনা প্রদান করেন এবং তাকে মুসলিম রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে সীমান্তরক্ষী হিসেবে নিযুক্ত করেন। ভিউলি এবং ভাগবত আধুনিক উত্তর প্রদেশের মির্জাপুর জেলায় অবস্থিত। এখানে বখতিয়ার খিলজি তার ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি খুঁজে পান।

১২০৬ সালে বখতিয়ার একটি দুর্ভাগ্যজনক তিব্বত অভিযান শুরু করেন এবং আলী মর্দান বাংলায় ফিরে আসার পর তাকে হত্যা করা হয়। মুহাম্মদ শিরান খলজি তার স্থলাভিষিক্ত হন।তাঁর সমাধি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত।  

বাংলা আক্রমণের পূর্বে:

বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয় এবং বাংলায় প্রাথমিক মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বখতিয়ার খলজির জায়গির সীমান্তে অবস্থিত ছিল এবং তাই তিনি পার্শ্ববর্তী ছোট ছোট হিন্দু রাজ্যগুলির সংস্পর্শে আসেন এবং তার রাজ্য সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে এই রাজ্যগুলিতে আক্রমণ ও লুণ্ঠন শুরু করেন। ফলস্বরূপ, চারপাশ থেকে অনেক ভাগ্যবান মুসলমান, বিশেষ করে খলজি সম্প্রদায়ের লোকেরা তার সাথে যোগ দেয় এবং এভাবে বখতিয়ার খলজির সেনাবাহিনী ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এভাবে বখতিয়ার খলজি তলোয়ার চালিয়ে ওদন্তপুরী বিহার জয় করেন। বিহার জয়ের পর বখতিয়ার বহু রত্ন নিয়ে কুতুবুদ্দিন আইবকের সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি যান।

বাংলা আক্রমন:

১২০৩-এ  দিল্লি থেকে আরো সৈন্য সংগ্রহ করে নদীয়ার নবদ্বীপে আক্রমণ করেন। তখন বাংলার রাজা লক্ষ্মণসেন নদীয়ায় অবস্থান করছিলেন। বখতিয়ার খলজি ঝাড়খণ্ডের বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে এসে নদীয়াকে এমন তাড়াহুড়ো করে আক্রমণ করেন যে তার সাথে মাত্র আঠারোজন অশ্বারোহী ছিল এবং তার প্রধান বাহিনী পেছনে ছিল। তিনি সোজা রাজা লক্ষণসেনের প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হন এবং প্রাসাদরক্ষীদের হত্যা করেন। ইতোমধ্যে শহরের অভ্যন্তরে শোরগোল শোনা যায়। রাজা লক্ষণসেন তখন মধ্যাহ্নভোজে লিপ্ত ছিলেন। খবর শুনেতিনি পশ্চাদ্বার দিয়ে পালিয়ে যান এবং পূর্ববঙ্গের রাজধানী বিক্রমপুরে গিয়ে আশ্রয় নেন। প্রায় বিনা যুদ্ধেই নদীয়া মুসলমানদের হস্তগত হয়। পরে সম্পূর্ণ বাহিনী বখতিয়ার খলজীর সাথে মিলিত হয়। তিনি তিন দিনব্যাপী নদীয়া লুণ্ঠন করেন এবং রাজা লক্ষণসেনের বিপুল ধনসম্পদ এবং অনেক হস্তি বখতিয়ার খলজীর হস্তগত হয়।

অতঃপর বখতিয়ার খলজী নদীয়া ত্যাগ করেন এবং লখনৌতি বা গৌড়ে অধিকার করেন এবং সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। লখনৌতি বা  গৌড়েই মুসলমান আমলে বাংলার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। অত:পর বখতিয়ার খলজী তাঁর নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যে সুশাসনের ব্যবস্থা করেন এবং মুসলমান সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মসজিদ, মাদ্রাসা এবং খানকাহ্ তৈরি করেন।

 

বখতিয়ারের সহজ সাফল্যের কারণ : 

 

খলজির জায়গির অন্যান্য হিন্দু রাজ্যের সীমান্তের কাছাকাছি ছিল, তাই তিনি তাদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। অন্যান্য রাজ্য তুর্কি আক্রমণের ভয়ে এবং তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকায় তিনি এটি করতে সক্ষম হন। এটি পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার জন্য খলজিকে একজন আদর্শ প্রার্থী করে তোলে এবং সে একে একে তাদের লুণ্ঠন করতে বখতিয়ার খলজি, যিনি একদিন বিহারের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তিনি একটি সুরক্ষিত প্রাচীর পেরিয়ে আসেন। তিনি মনে করেননি কোন প্রতিরোধ হবে, কিন্তু সে ভুল ছিল। বখতিয়ার খলজি কোনো ঝামেলা ছাড়াই সহজেই বিহারের নিয়ন্ত্রণ নেন। এটি বখতিয়ার খলজিকে আরও উচ্চাভিলাষী করে তোলে এবং তিনি তার রাজ্যকে আরও বিস্তৃত করতে চেয়েছিলেন।

 

 এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে তিনি নদীয়া আক্রমণ করেন এবং বিনা যুদ্ধেই নদীয়া জয় করে লখনৌতিতে রাজধানী স্থাপনের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে ইসলামের সূর্যের উদয় হয় বাংলার বুকে। তাছাড়া বখতিয়ার খলজীর কৌশলগত নীতি বাংলা জয়কে অনেক সহজ করে দেয়। 

ঝাড়খণ্ড থেকে বাংলার পথে:

পশ্চিম দিক হতে বাংলায় প্রবেশের স্বাভাবিক পথ ছিল রাজমহলের নিকটবর্তী তেলিয়াগড়ি গিরিপথ। তেলিয়াগড়ির দক্ষিণে বাংলার পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। এই জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চল 'ঝাড়খন্ড' নামে অভিহিত। তেলিয়াগড়ির উত্তর-পশ্চিমে ছিল খরস্রোতা নদী। সুতরাং তেলিয়াগড়ি জয় করতে না পারলে পশ্চিম দিক হতে কোন আক্রমণকারীর পক্ষে বাংলায় প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। খুব সম্ভব রাজা লক্ষণসেন তেলিয়াগড়ি গিরিপথ রক্ষা করার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু বখতিয়ার খলজী দুর্ধর্ষ বীর হওয়ার সাথে  একজন কৌশলী সমরবিদও ছিলেন। তিনি তেলিয়াগড়ির পাশ না গিয়ে গোপনে প্রস্তুতি নিয়ে 'ঝাড়খন্ড' বা দুর্গম জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আগের পথ বেছে নেন । যেহেতু দুর্গম অঞ্চলের ভিতর দিয়ে বিরাট সৈন্যবাহিনীসহ একসঙ্গে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু তিনি নিজ সৈন্যবাহিনীকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করেন এবং তিনি নিজে এরূপ একটি ক্ষুদ্র দলের প্রথমটির নেতৃত্ব দেন।

ফলে তিনি যখন নদীয়া পৌঁছেন, তখন কেউ ভাবতেও পারেননি যে, তুর্কি বীর বখতিয়ার খলজী নদীয়া জয় করতে এসেছেন। এবং সকলেই মনে করে যে, তাঁরা ঘোড়া ব্যবসায়ী এবং রাজা লক্ষণসেনের দরবারে ঘোড়া বিক্রি করতে এসেছেন। কিন্তু যখন রাজা লক্ষণসেন বুঝতে পারেন যে, বখতিয়ার খলজী আক্রমণকারী মুসলিম সৈন্যবাহিনীর নায়ক তখন লক্ষণসেন রাজধানী বিক্রমপুরে পালিয়ে যায়। প্রায় বিনা প্রতিরোধে খুব সহজেই বখতিয়ার খলজী নদীয়া জয় করে বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

 

তথ্যসূত্র:

  1. https://en.wikipedia.org/wiki/Muhammad_Bakhtiyar_Khalji
  2. Bangladesh Education Board. (2021). Bangladesh Studies textbook, Unit 2.
  3. Bangladesh Open University. (2021) SSHL.
  4. https://en.banglapedia.org/index.php/Khanqah
  5. M.Eaton, R. (1993). The Rise of Islam and The Bengal Frontiers. Berkeley,California and Los Angeles : The University of California Press.









Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter