ওহাবিবাদের সীমাবদ্ধতা: ইসলামের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের ওপর একপাক্ষিকতার চাপ
ইসলামের ইতিহাসে বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল ধর্মের মৌলিক চেতনাকে ফিরিয়ে আনা এবং বিভিন্ন ‘বিদআত’ বা অনৈসলামিক প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। এ ধরনের এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের নাম "ওহাবি আন্দোলন"। এটি ১৮শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সৌদি আরবের نجد অঞ্চলে শুরু হয় এবং আজও বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে আলোচিত একটি মতাদর্শ। এ প্রবন্ধে আমরা ওহাবি আন্দোলনের ইতিহাস, নেতৃত্ব, বৈশিষ্ট্য, প্রভাব এবং সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করব।
ওহাবি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব (১৭০৩–১৭৯২)। তিনি জন্মগ্রহণ করেন আজকের সৌদি আরবের نجد অঞ্চলের 'উয়েনা' শহরে। তার সময়ে ইসলামী সমাজে বহু রকম ধর্মীয় কুসংস্কার, মাজার পূজা, দরগাহভিত্তিক আনুষ্ঠানিকতা ও সমাজে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ‘বিদআত’ ও ‘শিরক’-এর চর্চা দেখা যায়। তিনি এসবকে ইসলামের মূল আকীদা ও তাওহিদের বিরোধী হিসেবে দেখেন এবং কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক শুদ্ধ ইসলামের আহ্বান জানান। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব ইবনে তাইমিয়াহ (১৩শ শতাব্দীর প্রভাবশালী ইসলামি চিন্তাবিদ)-এর চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিলেন। তার দাওয়াহর মূল ভিত্তি ছিল তাওহিদ (ঈশ্বরের একত্ববাদ) এবং শিরকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
ওহাবি আন্দোলন শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার ছিল না, বরং এটি একটি রাজনৈতিক জোটের জন্ম দেয়। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব মিত্রতা গড়ে তোলেন সৌদ বংশের নেতা মুহাম্মদ ইবনে সউদের সঙ্গে। ১৭৪৪ সালে এই দুই নেতার মধ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি হয়: ইবনে ওহাব ধর্মীয় নেতৃত্ব দেবেন এবং ইবনে সউদ রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন। এভাবেই গড়ে ওঠে প্রথম সৌদি রাষ্ট্র।
পরবর্তীকালে এই জোটের মাধ্যমে ওহাবি মতবাদকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয় এবং নানা অঞ্চলে এটি ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে সৌদি আরবের সরকারিভাবে সমর্থিত মতবাদ হল ওহাবিবাদ (বা সালাফিয়্যাহ)। ওহাবি আন্দোলনের প্রভাব আজও সুদূরপ্রসারী। বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে আন্তর্জাতিকভাবে দাওয়াহ কার্যক্রম, মসজিদ প্রতিষ্ঠা, ইসলামি বই বিতরণ ও মাদ্রাসা পরিচালনার মাধ্যমে এই মতবাদ প্রচার পায়। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপ-আমেরিকার মুসলিম সমাজে এর প্রভাব পড়েছে।
সমালোচনা ও বিতর্ক
যদিও ওহাবি আন্দোলন ইসলামে বিশুদ্ধতা ফিরিয়ে আনার কথা বলেছে, তবে এটি ব্যাপক সমালোচিতও হয়েছে বিভিন্ন কারণে—
১. মাজার ও দরগাহ ধ্বংস: ইতিহাসে দেখা যায় যে, ওহাবি অনুসারীরা বিভিন্ন মাজার, কবরস্থান ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করে, যেগুলো মুসলিম ঐতিহ্যের অংশ ছিল।
২. উগ্রতা ও সহিংসতা: ওহাবি মতবাদ থেকে অনুপ্রাণিত কিছু উগ্র গোষ্ঠী (যেমন: আল-কায়েদা, আইএস) ইসলামি আইন বাস্তবায়নের নামে সহিংসতা চালিয়েছে, যদিও ওহাবি নেতারা তাদের কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন না।
৩. অন্যান্য মুসলিমদের প্রতি কঠোরতা: ওহাবি মতাদর্শের অনুসারীরা অন্যান্য মুসলিম ফিরকাকে ‘ভ্রান্ত’ বা ‘বেদআতকারী’ বলে অভিহিত করে, যা মুসলিম সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।
ওহাবি আন্দোলনের মূল আদর্শ
- তাওহিদের প্রচার: আল্লাহর একত্ব ও নিরঙ্কুশ প্রভুত্বের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা।
- শিরকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম: আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা, পীর পূজা, মাজার পূজা ইত্যাদির বিরোধিতা।
- বিদআতের বিরুদ্ধে অবস্থান: ইসলামে নব উদ্ভাবিত ধর্মীয় চর্চা ও রীতিনীতিকে প্রত্যাখ্যান।
- কুরআন ও সহীহ হাদীসের অনুসরণ: কেবলমাত্র নির্ভরযোগ্য ইসলামী উৎস থেকে নির্দেশনা গ্রহণ।
- শরীয়াহভিত্তিক সমাজ: ইসলামি আইন অনুযায়ী সমাজ গঠন ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
প্রতিরোধের নামে অসহিষ্ণুতা: ওহাবিবাদের সমস্যাপূর্ণ বাস্তবতা
ওহাবিবাদ (Wahhabism) ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আন্দোলন, যা ১৮শ শতকে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওহাবের মাধ্যমে শুরু হয়। এটি ইসলামকে তথাকথিত “শুদ্ধ” অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি করে এবং ধর্মীয় বেদআত, কবরপূজা ও মধ্যস্থতাকারী ধারার বিরোধিতা করে। যদিও ওহাবিবাদ বাহ্যিকভাবে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং মুসলিম পরিচয় রক্ষার একটি আন্দোলন বলে মনে হতে পারে, এর অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবহারিক প্রয়োগে রয়েছে বহু নেতিবাচকতা ও ক্ষতিকর দিক।
প্রথমত, ওহাবিবাদ ইসলামের ঐতিহ্যবাহী বহুমাত্রিকতাকে অস্বীকার করে এবং শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যাকে একমাত্র সঠিক বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এর ফলে ইসলামি জ্ঞানের দীর্ঘ ইতিহাস—বিশেষ করে তাসাওউফ, আশআরি-মাতুরিদি আকীদা, এবং চারটি মাযহাবভিত্তিক ফিকহ—বর্জিত বা বিভ্রান্তিকর বলে আখ্যায়িত হয়। এতে ইসলামের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং মুসলিম সমাজে বিভাজন, সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায়।
দ্বিতীয়ত, ওহাবিবাদ অনেক সময় ইসলামের করুণা, সহনশীলতা ও ন্যায়বিচারের সৌন্দর্যকে কঠোরতা ও শাস্তিমূলক ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ করে ফেলে। তারা আল্লাহর দয়াকে অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে তুলে না ধরে, বরং "তৌহিদ রক্ষা"র নামে এমন অনেক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে, যা ইসলামি সভ্যতার ইতিহাসে স্বীকৃত ও গ্রহনযোগ্য ছিল। এর ফলে মুসলিমদের ভেতরে সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা ও আত্মপরিচয়ের সংকট দেখা দেয়।
তৃতীয়ত, এই মতবাদ রাজতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে মিলে অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইসলামকে ব্যবহার করেছে। বহু ক্ষেত্রেই ওহাবি চিন্তাধারা সহিংস গোষ্ঠীর আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যারা ইসলামকে কেবল যুদ্ধ ও দমননীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এটি ইসলামের প্রকৃত শান্তিপূর্ণ আহ্বান ও সমাজ নির্মাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সবশেষে, ওহাবিবাদের একটি বড় সমস্যা হলো এটি অন্য মুসলমানদের ওপর “শিরক”, “বেদআত” ও “কাফের” তকমা দেওয়ার প্রবণতা, যা উম্মাহর মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট করে এবং ঘৃণার পরিবেশ সৃষ্টি করে।
অতএব, যদিও ওহাবিবাদ বাহ্যিকভাবে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তবে এর একপাক্ষিকতা, সহনশীলতার অভাব এবং ঐতিহ্যবিরোধী মনোভাব ইসলামের বহুমাত্রিক, মানবিক ও নান্দনিক সৌন্দর্যকে বিকৃত করেছে। ইসলাম একটি করুণাময় ও ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম—যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়, মনকে প্রশান্ত করে এবং সমাজে ন্যায়, সহনশীলতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। সুতরাং ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য অনুধাবনে ওহাবিবাদী সংকীর্ণতা পরিহার করা জরুরি।
শেষকথা
ওহাবি আন্দোলন ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। এর মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামে তাওহিদের সঠিক মর্ম বোঝানো এবং কুসংস্কার, বিদআত ও শিরকের বিরুদ্ধে জিহাদ। তবে এ আন্দোলনের কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বিতর্ক সৃষ্টি করেছে এবং মুসলিম সমাজে বিভক্তি এনেছে। এই আন্দোলনের ইতিহাস, আদর্শ ও প্রভাব বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে, এটি যেমন ইসলামি চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছে, তেমনি কিছু সীমালঙ্ঘনের কারণে সমালোচনারও মুখোমুখি হয়েছে। ইসলামের নাম করে কোন ধর্মীয় বা রাজনৈতিক আন্দোলনই যদি চরমপন্থা বা অসহিষ্ণুতার দিকে নিয়ে যায়, তবে সেটি ইসলামের মূল বার্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই প্রতিটি আন্দোলনকে বুঝতে হবে ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, যাতে সামগ্রিক ও ন্যায়সঙ্গত মূল্যায়ন সম্ভব হয়।
অতএব, ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, তবে সেটি তখনই মূল্যবান যখন তা সহনশীলতা, জ্ঞানের গভীরতা ও উম্মাহর ঐক্য রক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। ওহাবিবাদের মতবাদ যদিও ইসলামের শুদ্ধতা রক্ষার দাবি করে, বাস্তবে তা ইসলামের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানচর্চা, আধ্যাত্মিকতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সংকুচিত করে দেয়। ইসলামের প্রকৃত রূপ হলো একটি ভারসাম্যপূর্ণ, সহানুভূতিশীল ও আত্মিকভাবে পূর্ণ ধর্ম, যা শুধু বাহ্যিক রীতিনীতি নয়, বরং হৃদয় ও বিবেকের পরিশুদ্ধির মাধ্যম। তাই মুসলিম সমাজের উচিত, একরৈখিক ও বিভাজনসৃষ্টিকারী ব্যাখ্যার বাইরে এসে ইসলামের গভীরতা, মানবিকতা ও ঐক্যবোধকে কেন্দ্র করে চিন্তা করা এবং সে আলোকে জীবন পরিচালনা করা।