আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রসঙ্গে ইসলামের ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা

ভূমিকা

মানব সভ্যতার ইতিহাস মূলত এক অন্তহীন অনুসন্ধানের ইতিহাস—আলো, জ্ঞান ও সত্যের অনুসন্ধান। প্রাচীন মানুষ অন্ধকার গুহায় আগুন জ্বালাতে শিখেছিল, কৌতূহল তার প্রথম শিক্ষক ছিল। সেই কৌতূহলই একদিন তাকে নক্ষত্রের দিকে তাকাতে, সাগর পাড়ি দিতে, পৃথিবী মাপতে শিখিয়েছে। সময়ের ধারায় সেই অনুসন্ধানই আজ রূপ নিয়েছে পরমাণুর ভেতর, জিনের বিন্যাসে, আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে। মানুষ এখন এমন প্রযুক্তির মালিক, যা একদিকে তাকে স্বর্গীয় শক্তির মতো সক্ষম করেছে, আবার অন্যদিকে তার মানবিক সীমাবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর, কিন্তু এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক গভীর দ্বন্দ্ব—আমরা কি সত্যিই আলোর পথে অগ্রসর হচ্ছি, নাকি প্রযুক্তির ঝলকে মানবতার মুখ আড়াল হয়ে যাচ্ছে? এক সময় জ্ঞানের লক্ষ্য ছিল জীবনের মান উন্নত করা, কিন্তু আজ তা ক্ষমতা, মুনাফা ও প্রতিযোগিতার উপকরণে পরিণত হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাফল্যের আড়ালেই লুকিয়ে আছে জীবাণু অস্ত্রের ভয়; তথ্য প্রযুক্তির বিস্ময়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে গোপনীয়তার মৃত্যু; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের পরিশ্রম কমাচ্ছে, কিন্তু একই সঙ্গে তার চিন্তা ও মূল্যবোধকেও যান্ত্রিক করে তুলছে।এই সংকটের মুহূর্তে ইসলাম এক চিরন্তন বার্তা দেয়—জ্ঞান ও প্রযুক্তি আল্লাহর দান, কিন্তু তার ব্যবহার হতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত নৈতিকতার সীমায়। কুরআনে বলা হয়েছে, “তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীর সব কিছু কাজে লাগিয়েছেন।” (সুরা আল-বাকারা: ২৯) অর্থাৎ মানুষকে প্রযুক্তির অধিকার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু দায়িত্ববোধ ছাড়াই তা ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। রাসূলুল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন, “প্রকৃত জ্ঞানী সেই, যে আল্লাহর ভয় ও দায়িত্ববোধ নিয়ে জ্ঞান ব্যবহার করে।” (তিরমিজি)  অতএব, প্রযুক্তি তখনই বরকতময় হয়, যখন তা মানবতার সেবা করে; কিন্তু যখন তা মানবতার ক্ষতি ডেকে আনে, তখন তা বরং ধ্বংসের কারণ হয়ে ওঠে। ইসলাম এই ভারসাম্যের দিকেই আহ্বান জানায়—যেখানে জ্ঞান ঈমানের আলোয় পরিচালিত হয়, আর প্রযুক্তি হয়ে ওঠে মানবকল্যাণের হাতিয়ার। আজকের যুগে এই বার্তাটিই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। কারণ মানুষ যতই উন্নত হোক, যদি সে তার নৈতিক চেতনা হারায়, তবে প্রযুক্তি তাকে মুক্তি নয়, দাসত্বই দেবে। তাই ইসলাম বলে, প্রকৃত অগ্রগতি কেবল মস্তিষ্কের নয়—হৃদয়েরও।

ইসলামে জ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চার ভিত্তি

ইসলাম জ্ঞানচর্চাকে কেবল মানবিক প্রয়োজন বা সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে নয়, বরং ইবাদতের এক মহৎ রূপে উন্নীত করেছে। কুরআনের প্রথম ওহি-ই এই সত্যের ঘোষণা— “পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা আল-আলাক: ১) এই আয়াত মানব ইতিহাসে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। কারণ এটি কোনো জাতিকে কেবল পড়তে বলেনি, বরং পড়ার পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য শিখিয়েছে—“রব্বের নামে পড়ো”। অর্থাৎ, জ্ঞান তখনই পূর্ণতা পায় যখন তা মানুষকে তার স্রষ্টার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। 

এই আয়াতই পরবর্তী এক হাজার বছরে মুসলিম বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের ভিত্তি স্থাপন করে। আল-বিরুনি তাঁর গবেষণায় পৃথিবীর ব্যাস মাপার চেষ্টা করেছিলেন; ইবনু হাইথাম আলোকবিজ্ঞানে পরীক্ষণ পদ্ধতির সূচনা করেছিলেন; ইবনু সিনা চিকিৎসা বিজ্ঞানে আধুনিক মেডিসিনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন; আর আল-খাওয়ারিজমি গণিতে অ্যালগরিদমের ধারণা দেন, যা আজকের কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভিত্তি। ১১শ থেকে ১৩শ শতাব্দীর সেই স্বর্ণযুগে মুসলিম পণ্ডিতেরা চিকিৎসা, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, এমনকি সমাজবিজ্ঞানেও বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইউনেস্কোর এক ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সে সময়কার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও গবেষণার প্রায় তিন-চতুর্থাংশই ইসলামী সভ্যতার অবদান। বাগদাদ, কর্ডোভা, দামেস্ক ও বুখারা ছিল সেই সময়ের অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ড। তাদের কাছে বিজ্ঞান মানে ছিল আল্লাহর সৃষ্টিকে বোঝা—ঈমানের সম্প্রসারণ। জ্ঞান তাদের কাছে কেবল যুক্তির বিষয় ছিল না, বরং এক আত্মিক যাত্রা। তাঁদের গবেষণাগার ছিল ইবাদতের স্থান, তাঁদের কলম ছিল দোয়ার প্রতীক। কিন্তু আজকের যুগে দৃশ্যপট বদলে গেছে। বিজ্ঞান ক্রমে নৈতিকতার হাতছাড়া হয়ে পড়েছে। আজকের প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণের পাশাপাশি তার নিয়ন্ত্রণও ছিনিয়ে নিচ্ছে। গবেষণাগারে এখন মানবতার চেয়ে মুনাফার হিসাব বড় হয়ে উঠছে। জ্ঞান হয়ে উঠেছে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, আর মানুষ ভুলে যাচ্ছে যে জ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য হলো উপকার, অহংকার নয়।  

এই পরিস্থিতিতেই ইসলাম আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কারণ ইসলাম শেখায়—জ্ঞান ও প্রযুক্তি আল্লাহর দান, আর দানের মর্যাদা রক্ষা হয় দায়িত্ববোধে। ইসলাম জ্ঞানকে শুধু অর্জনের নয়, প্রয়োগের নৈতিকতাও শিখিয়েছে। তাই সত্যিকারের জ্ঞানী সেই, যিনি তাঁর প্রভুর ভয় ও দায়িত্ববোধ নিয়ে গবেষণা করেন, যেমন রাসূলুল্লাহ বলেছেন, “প্রকৃত জ্ঞানী সেই, যে আল্লাহর ভয় ও দায়িত্ববোধ নিয়ে জ্ঞান ব্যবহার করে।” (তিরমিজি) আজ যখন জ্ঞান মানুষের হাতে শক্তি হয়ে উঠেছে, তখন ইসলামের এই নৈতিক দিকনির্দেশনা-ই আমাদের সভ্যতার প্রকৃত দিক খুঁজে নিতে সাহায্য করতে পারে।

প্রযুক্তির অগ্রগতি ও নৈতিক সংকট

২১শ শতাব্দীর মানুষ এমন এক যুগে বাস করছে, যেখানে এক ক্লিকেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তথ্য পৌঁছে যায়। প্রযুক্তির গতি এত দ্রুত যে সময় যেন তার পিছু নিতে হিমশিম খায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা, এমনকি ধর্মীয় গবেষণাতেও স্থান করে নিয়েছে। রোবট অস্ত্রোপচার করছে, অ্যালগরিদম মানুষের পছন্দ-অপছন্দ বিশ্লেষণ করছে, আর তথ্যপ্রযুক্তি বদলে দিচ্ছে জীবনের প্রতিটি ছন্দ। কিন্তু এই অগ্রগতির ঝলকের নিচে যে এক অস্থিরতা জন্ম নিচ্ছে, তা উপেক্ষা করা আর সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির প্রভাবে এক নতুন মানসিক ও নৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। Pew Research (2024)-এর একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা জানায়, বিশ্বের ৬১% মানুষ মনে করে প্রযুক্তি মানুষের নৈতিকতা, পারিবারিক বন্ধন ও ব্যক্তিগত জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রযুক্তি মানুষকে যতটা যুক্ত করছে, ততটাই বিচ্ছিন্নও করছে। পরিবারে কথোপকথনের জায়গায় এসেছে পর্দার আলো, বন্ধুত্বের জায়গায় ফলোয়ারের সংখ্যা, আর আত্ম-চিন্তার জায়গায় এসেছে ভার্চুয়াল পরিচয়ের প্রতিযোগিতা। সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি, ভুয়া তথ্যের বন্যা, গোপনীয়তার লঙ্ঘন, যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রযুক্তির অমানবিক ব্যবহার—সব মিলিয়ে এক জটিল প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে: প্রযুক্তি কি এখনও মানুষের নিয়ন্ত্রণে, নাকি মানুষই প্রযুক্তির দাসে পরিণত হচ্ছে? মানুষ তার সৃষ্টির উপর প্রভুত্ব করতে গিয়ে নিজেই এক যান্ত্রিক ব্যবস্থার শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে পড়ছে। এ প্রসঙ্গে The Islamic Standard for the Assessment of Modern Technology নামের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় সংকট হলো এর “নৈতিক নিরপেক্ষতা” (moral neutrality)। প্রযুক্তি নিজে ভালো বা খারাপ নয়; বরং এর ব্যবহারই নির্ধারণ করে এর নৈতিক অবস্থান। একটি অস্ত্র যেমন নিরপরাধকে হত্যা করতে পারে, তেমনি একই প্রযুক্তি দিয়ে জীবনও রক্ষা করা যায়। ইসলামও এই নীতিতেই দাঁড়ায়—“যা উপকারে আসে, তা গ্রহণ করো; আর যা ক্ষতি আনে, তা পরিত্যাগ করো।” কুরআন বারবার মানুষকে দায়িত্বশীলতার আহ্বান জানিয়েছে— “তোমরা অপচয় করো না, নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সুরা ইসরা: ২৭) এই আয়াত শুধু বস্তুগত অপচয়ের নয়, প্রযুক্তিগত দায়িত্বহীনতার বিরুদ্ধেও সতর্ক করে। কারণ প্রযুক্তি যখন সীমা হারায়, তখন তা কল্যাণের বদলে ধ্বংস বয়ে আনে। অতএব, ইসলামী দৃষ্টিতে প্রযুক্তির ব্যবহার কোনো যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়; এটি এক নৈতিক যাত্রা—যেখানে উদ্দেশ্য (niyyah) ও ফলাফল (natijah) উভয়কেই মূল্যায়ন করতে হয়। প্রযুক্তিকে মানবতার সেবায় আনাই ইসলামের নির্দেশ, এবং এই নির্দেশই আধুনিক সভ্যতার অস্থির নৈতিকতাকে পুনর্গঠনের চাবিকাঠি হতে পারে।

কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনায় প্রযুক্তির ব্যবহার

কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন— “তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীর সব কিছুকে কাজে লাগিয়েছেন।” (সুরা আল-বাকারা: ২৯) এই আয়াত শুধু মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে না, বরং এক গভীর দায়িত্ববোধের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহ মানুষকে জ্ঞানের শক্তি ও প্রযুক্তির সম্ভাবনা দিয়েছেন, কিন্তু তা ব্যবহারের শর্তও নির্ধারণ করেছেন—অত্যাচার নয়, কল্যাণের জন্য ব্যবহার। প্রযুক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সৃষ্টিশীল ব্যবহার তাই ইসলামী দৃষ্টিতে বৈধ, যদি তা সমাজ, পরিবেশ ও মানবতার কল্যাণে আসে। রাসূলুল্লাহ বলেছেন— “প্রকৃত জ্ঞানী সেই, যে আল্লাহর ভয় ও দায়িত্ববোধ নিয়ে জ্ঞান ব্যবহার করে।” (তিরমিজি)  এই হাদীস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জ্ঞান ও প্রযুক্তির আসল মর্যাদা কেবল তখনই যখন তা নৈতিক সীমার মধ্যে থাকে। প্রযুক্তি নিজে ভালো বা মন্দ নয়—এর মূল্য নির্ভর করে ব্যবহারকারীর উদ্দেশ্য ও আচরণের ওপর। চিকিৎসা বিজ্ঞানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ব্যবহার যেমন মানুষের জীবন রক্ষা করছে, রোগ নির্ণয়ে দ্রুততা আনছে, তেমনি এটি আল্লাহপ্রদত্ত জ্ঞানের সদ্ব্যবহার। কিন্তু একই প্রযুক্তি যখন নজরদারি, গোপনীয়তা লঙ্ঘন, কিংবা ধ্বংসাত্মক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, তখন তা মানবতার পরিপন্থী হয়ে ওঠে। এ কারণেই ইসলাম প্রতিটি জ্ঞানের ব্যবহারকে নৈতিক কাঠামোর ভেতর দেখতে চায়। ইসলামী নীতিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের তিনটি মৌলিক শর্ত রয়েছে—
উদ্দেশ্যের পবিত্রতা (নিয়্যাহ): ব্যবহার কি সৃষ্টির কল্যাণে?
ফলাফলের ন্যায়বিচার: এর প্রভাব সমাজ ও প্রকৃতির ওপর কেমন?
দায়িত্ববোধ: এটি কি আল্লাহর সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা করছে? 

প্রযুক্তি তাই ইসলামী চিন্তায় শুধু আধুনিকতার প্রতীক নয়, বরং এক নৈতিক দায়িত্ব। কুরআন মানুষকে জ্ঞান অর্জনের আহ্বান জানায়, কিন্তু সেই জ্ঞান যেন অহংকারে নয়, বিনয়ে ব্যবহৃত হয়—এই বার্তাই ইসলামের হৃদয়। অতএব, প্রযুক্তি যদি ন্যায়, করুণা ও মানবকল্যাণের সেবায় ব্যবহৃত হয়, তবে তা ইবাদতেরই একটি রূপ। কিন্তু যদি তা অন্যায়, ধ্বংস বা স্বার্থের অস্ত্রে পরিণত হয়, তবে সেটি মানবতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ইসলামের শিক্ষা হলো—জ্ঞান অর্জন করো, কিন্তু তা দিয়ে আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দিও না। 

আধুনিক গবেষণায় ইসলামী নৈতিকতার পুনরুজ্জীবন

সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া (IIUM)-এর একটি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে—“প্রযুক্তিকে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে হলে তিনটি মানদণ্ড অপরিহার্য: উদ্দেশ্য (niyyah), ফলাফল (natijah), এবং মানবতার কল্যাণ (maslahah).” অর্থাৎ, কোনো প্রযুক্তি তখনই গ্রহণযোগ্য যখন তা মানুষের উপকারে আসে, সমাজে অন্যায়, বৈষম্য বা ধ্বংসাত্মক প্রবণতা বাড়ায় না। ইসলামের মূল নীতি হলো—যা উপকারে আসে তা গ্রহণ করো, যা ক্ষতি আনে তা বর্জন করো। প্রযুক্তির নৈতিক মূল্যায়ন এই তিনটি মানদণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।
১. উদ্দেশ্য (Niyyah): প্রযুক্তি ব্যবহারের অন্তরস্থ উদ্দেশ্য কী—ব্যক্তিগত লাভ, নাকি জনকল্যাণ?
২️. ফলাফল (Natijah): এর বাস্তব প্রভাব সমাজ ও নৈতিকতার ওপর কেমন?
৩️.মানবতার কল্যাণ (Maslahah): এটি কি মানবজীবনের মান উন্নত করছে, নাকি তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছে? 

এই কাঠামো ইসলামী দৃষ্টিতে প্রযুক্তিকে একটি “নৈতিক সম্পদ”-এ পরিণত করে, যেখানে প্রতিটি উদ্ভাবন মূল্যায়িত হয় আল্লাহর সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। বিখ্যাত চিন্তাবিদ ইয়াকুব চৌধুরী তাঁর “The Future and the Artificial: An Islamic Perspective” প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন— “AI-এর সবচেয়ে বড় বিপদ এর মানবিকতা হারানো।” তিনি বলেন, ভবিষ্যতের প্রযুক্তি যুগে মানুষের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে “নৈতিক বুদ্ধিমত্তা” (ethical intelligence) গড়ে তোলা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যতই শক্তিশালী হোক, যদি তা নৈতিকতার শূন্যতায় পড়ে যায়, তবে তা মানবতার জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং অভিশাপ। ইসলামী দৃষ্টিকোণে এই নৈতিক বুদ্ধিমত্তা মানে হলো—মানুষের প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে আল্লাহভীতি, দায়িত্ববোধ ও ন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত করা। কারণ, প্রযুক্তি যত উন্নতই হোক, যদি তা আল্লাহর সীমারেখা অতিক্রম করে, তবে সেই জ্ঞান বরকতময় হয় না।

মুসলিম সমাজের করণীয়

বর্তমান যুগে প্রযুক্তি শুধু মানুষের জীবনধারা বদলে দিচ্ছে না, বরং নৈতিকতা ও মানসিকতার দিকেও গভীর প্রভাব ফেলছে। ইসলাম প্রযুক্তিকে নিষিদ্ধ করে না; বরং তার ন্যায়সঙ্গত, ভারসাম্যপূর্ণ ও মানবকল্যাণমুখী ব্যবহারের নির্দেশ দেয়। সেই লক্ষ্যেই দরকার এক নতুন নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে ইসলামী চিন্তাকে একত্রে যুক্ত করবে। প্রথমত, নৈতিক বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তন জরুরি—যেখানে বিজ্ঞান ও ধর্মকে দুটি পৃথক জগৎ নয়, বরং পরস্পর-পরিপূরক হিসেবে দেখা হবে। এতে বিজ্ঞান হবে কেবল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং আল্লাহর সৃষ্টির রহস্য অনুধাবনের এক ইবাদত। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল নৈতিকতা (Digital Akhlaq) গড়ে তোলা প্রয়োজন—যাতে অনলাইন জীবনে সততা, সংযম, গোপনীয়তা রক্ষা ও দায়িত্ববোধ চর্চা করা হয়। তৃতীয়ত, হালাল ইনোভেশন ধারণা—যেখানে গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়ন ইসলামী নীতি ও সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। চতুর্থত, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে “ইসলামী নৈতিকতা ও প্রযুক্তি” নামে সমন্বিত গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত, যেখানে বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও আলেমরা একসঙ্গে কাজ করবেন। যদি মুসলিম বিশ্ব এই দিকগুলোতে মনোযোগ দেয়, তবে প্রযুক্তি কেবল যান্ত্রিক উন্নতির প্রতীক হবে না—বরং নৈতিক পুনর্জাগরণ, জ্ঞান, এবং মানবতার আলোকবর্তিকায় পরিণত হবে।

উপসংহার

প্রযুক্তি মানব সভ্যতার এক অবিশ্বাস্য অর্জন। এটি জীবনকে সহজ, দ্রুত এবং বহুমাত্রিক করেছে। কিন্তু যদি এর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো হয়, তবে প্রযুক্তি আশীর্বাদ নয়, বরং অভিশাপের মতো কাজ করতে পারে। ইসলাম মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, জ্ঞানের উৎস আল্লাহ, আর জ্ঞান অর্জন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সঠিক সীমারেখা আল্লাহর নির্দেশিত নৈতিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। যখন বিজ্ঞান ঈমানের আলোয় পরিচালিত হয়, তখনই তা প্রকৃত প্রগতির প্রতীক হয়ে ওঠে। আজকের প্রজন্মের দায়িত্ব হলো প্রযুক্তিকে কেবল মস্তিষ্কের উদ্ভাবনা হিসেবে নয়, হৃদয়ের শিক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার। প্রযুক্তির লক্ষ্য হবে মানুষের সেবা, নিজের অহংকার বা ক্ষমতার প্রদর্শন নয়।

ইসলাম এই ভারসাম্যেরই নাম—যেখানে জ্ঞান, নৈতিকতা এবং মানবকল্যাণ একসাথে মিলেমিশে সভ্যতার পূর্ণাঙ্গ ভিত্তি গড়ে তোলে। এই দৃষ্টিকোণ অনুসরণ করলে, প্রযুক্তি কেবল উন্নতির হাতিয়ার নয়, বরং মানবতার কল্যাণে পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবে।



Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter