উত্তর-পূর্ব ভারতের সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণে সুফি সাধকদের প্রভাব
উত্তর-পূর্ব ভারতের ইতিহাস এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মিলনের উদাহরণ। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে পাহাড়ি এই অঞ্চলে বহুদিন ধরে মানুষ শান্তিপূর্ণ ও আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতির পরিবর্তনে এখানে আগের মিলনসাধন ও সম্প্রীতির পরিবেশে ফাটল দেখা যাচ্ছে। যদিও সত্যি বলতে গেলে, এই অঞ্চলের সংস্কৃতির ভিত বহু শতাব্দী ধরে সমানাধিকার ও মিলনের ধারায় গড়ে উঠেছে। এখানে ধর্মীয় মিলনের আলোচনা মানে এই নয় যে সব ধর্ম এক রকম, বরং মানুষের কাছে সহজভাবে ধর্মের বার্তা পৌঁছানো—পরিচিত সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। আগে উত্তর-পূর্ব ভারতকে কামরূপ ও প্রাগজ্যোতিষা বলা হতো, পরে নাম হয় আসাম। এখানে মূলত হিন্দু ও মুসলমানদের বসবাস। দুই সম্প্রদায় অনেককাল ধরে একসাথে নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, উৎসব ও জীবনধারা ভাগাভাগি করেছে।
আসামের মুসলিম সমাজকে চার ভাগে ভাগ করা যায়—
১) আসামি মুসলিম: যারা ইসলামের প্রাথমিক সময়ে এখানে বসতি গড়েছিল।
২) নতুন আসামি মুসলিম বা ‘ভাটিয়া মুসলিম’: যারা সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে এসেছিল।
৩) কাচাড় বা বরাক উপত্যকার মুসলিম: এরা মূলত বাংলাভাষী।
৪) বিহারি ও উত্তর ভারতের মুসলিম: যারা নতুনভাবে এখানে বসবাস শুরু করেছে।
এই অঞ্চলের ধর্মীয় মিলনের মূল শক্তি ছিল সুফি সাধক, ঘুরে বেড়ানো ফকির এবং হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজের জ্ঞানীরা। কামরূপে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির নানা উদাহরণ আছে। যেমন ইতিহাসবিদ শিহাবুদ্দিন তালিশ তাঁর ফতিয়ুহ-ই-ইব্রিয়া গ্রন্থে লিখেছেন যে, আসামে হিন্দুরা মুসলিমদের রান্না করা খাবার খেতেন—যা ভারতের অন্য কোথাও দেখা যায় না। আবার, কামরূপ, মঙ্গলদই ও নগাঁওয়ের অনেক মুসলিম মানুষ মানসা পূজাতেও অংশ নিতেন। এতে বোঝা যায় আসামের সমাজ কতটা মিলেমিশে গড়ে উঠেছিল, আর এর পেছনে সুফিদের অবদান সবচেয়ে বেশি।
আসাম ও অবিভক্ত বাংলার ইতিহাসে দেখা যায়, সুফি সাধকরা বিভিন্ন মুসলিম বিশ্বের অংশ থেকে এখানে এসেছিলেন। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বহুবার মুসলিম শাসকদের অভিযান হয়। এই সঙ্গে সুফিরাও এই অঞ্চলে আসেন এবং ধীরে ধীরে এখানেই থেকে যান। তাঁরা সেবা, ভালোবাসা, স্থানীয় রীতি-নীতি ও ভাষার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে মানুষের কাছে ইসলামের শিক্ষা পৌঁছে দেন। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, আসামের এই মিলনমুখী সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে সুফিদের মানবসেবা, ভক্তি এবং শান্তির শিক্ষার মাধ্যমে। তাঁদের শিক্ষা মানুষকে শান্তি, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে।
সুফিদের অন্য ধর্মবিশ্বাসের সাথে মিলন
বারোশো শতকের দিকে সুফিবাদ পুরো মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। তখন সুফি সাধকেরা শুধু নিজেদের ভক্তি আর জগতের প্রতি আসক্তি ছেড়ে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে ইসলাম প্রচার করেছেন। তারা স্থানীয় সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়ে এক ধরনের মিলনমুখী পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। আসামও তার ব্যতিক্রম নয়। ইতিহাসবিদ রিচার্ড এম. ইটন বলেন, আসামে তখন নানা রকম জাদু চিকিৎসা ও মন্ত্র-তন্ত্র প্রচলিত ছিল। সুফিরা যেহেতু ধর্মীয় সত্যকে সরাসরি অনুভব করতে চাইতেন, তাই তারা আসামের যোগী প্রথার প্রতি আকৃষ্ট হন। একটি বিখ্যাত পুঁথি বাহর আল-হায়াত দেখায় যে সুফিরা বাংলার ও আসামের রহস্যময় সংস্কৃতির প্রতি অনেক আগ্রহী ছিলেন। সুপরিচিত সুফি শেখ মুহাম্মদ গওস গ্বালিয়র থেকে কামরূপে গিয়েছিলেন এই জ্ঞান অর্জনের জন্য। এই গ্রন্থটি আগে রুকন আল-দিন সমরকন্দির সঙ্গে এবং পরে শেখ মুহাম্মদ গওসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এর মানে এটি বহুদিন ধরে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রচলিত ছিল।
ভারতের আরেকজন ইতিহাসবিদ আর. সিনহা বলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের ধর্মীয় সংস্কৃতি ভারতের অন্য আদিবাসী সমাজের থেকে আলাদা। এখানে ধর্মে সাধারণ কিছু জিনিস ছিল, যেমন প্রকৃতি-ভিত্তিক বিশ্বাস বা আত্মার শক্তিকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করা। সেই সময়ের নতুন মুসলিম আগন্তুকরা, বিশেষত সুফিরা, আসামের প্রাচীন সমাজে মিশে গিয়েছিলেন। তারা সব ধর্ম-বিশ্বাসকে সম্মান করে মিলেমিশে জীবন কাটাতেন, আর মানবতার সব রঙে একধরনের ধর্মীয় সম্প্রীতি তৈরি করেছিলেন।
সুফিদের প্রভাব এক যৌথ সমাজে
আসামের সংস্কৃতিতে সুফিদের গভীর প্রভাব আছে। তারা এখানে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সাহায্য করেছেন এবং হিন্দু-মুসলিম মিলনের দূত হিসেবে কাজ করেছেন। সুফিরা সর্বজনীন ভালোবাসা ও শান্তির মূল্যবোধ প্রচার করেছেন। আসামি সাহিত্যে সুফিদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তারা হিন্দু ধর্মীয় ভাবনা আর মুসলিম সাহিত্যরীতি মিলিয়ে আসামি ভাষায় এক ধরনের মিলনমুখী সাহিত্য গড়ে তুলেছিলেন।
গান ও সংগীতে সুফিদের বড় অবদান আছে। জিকির আর জারি (বা মারসিয়া) আসামের মুসলিম সুফিদের জনপ্রিয় সাহিত্যিক সৃষ্টি। জিকির হলো ধর্মীয় বা দর্শনমূলক গান। এসব গানে প্রায়ই আজান পীর (শাহ মিরান/মিলান)-এর জীবন ও কাহিনি গাওয়া হয়। জারি হলো শোকগীতি। এতে মূলত কারবালার করুণ কাহিনি বর্ণিত হয়। এই গানগুলোতে সুফিরা শুধু ইসলামের কথা বলেননি, হিন্দু সাধক ও মহান ব্যক্তিদেরও প্রশংসা করেছেন। তাই এগুলো হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
এখনও দেখা যায় মুসলমানরা হিন্দু বন্ধুদের নামঘরে গিয়ে মন প্রসাদ গ্রহণ করেন। আবার হিন্দুরাও সুফিদের দরগাহে যান। দরগাহে মানুষ মানত করে, গাছে সুতো বেঁধে প্রার্থনা করে। আহোম শাসনামলে পোশাক-পরিচ্ছদ বা উৎসবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বড় কোনো পার্থক্য ছিল না। বিহু উৎসব উভয় সম্প্রদায় একসাথে পালন করত। নাগাঁও জেলায় মুসলমানরাও গরু গোসলের অনুষ্ঠানে অংশ নিত, যা বিহুর সূচনার প্রতীক ছিল। সব মিলিয়ে, সুফিদের প্রভাবে আসামের সমাজ হিন্দু-মুসলিম মিলনের এক সুন্দর উদাহরণ হয়ে উঠেছিল।
বৈষ্ণবধর্ম ও সুফিদের সম্পর্ক
আসামের ইতিহাসে এক চমকপ্রদ দিক দেখা যায়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের সাধককে গুরু বা পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করেছে। আসামে বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছিল দুই মহান সংস্কারক—শ্রীশঙ্করদেব ও শ্রীমাধবদেবের মাধ্যমে। তারা জাতপাত ও অহমিকাভিত্তিক হিন্দুধর্মকে বাদ দিয়ে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের কথা বলেছিলেন। এই ভক্তি আন্দোলনের প্রভাবে অনেক সুফিও তাদের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ফলস্বরূপ, আসামের মুসলিম সাধকদের মধ্যেও অনেকে শ্রীশঙ্করদেবকে গুরু হিসেবে মানতেন—যেমন চাঁদ খান ও জয়হরি। আবার শ্রীমাধবদেবের শিষ্যদের মধ্যে ইয়বন হরিদাসও ছিলেন, যিনি মুসলিম ছিলেন। এতে বোঝা যায় বৈষ্ণব ধর্ম আসামের মুসলিম সমাজের উপর কতটা প্রভাব ফেলেছিল।
আসামের নববৈষ্ণব সাহিত্যের প্রভাব মুসলিম সুফিদের রচিত জিকির ও জারি/মারসিয়া গানেও পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতকে অনেক সুফি পীর এসব গান লিখেছিলেন। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক শ্রীশঙ্করদেব বলেছিলেন—মুক্তি লাভ হবে ভক্তি ও প্রার্থনার মাধ্যমে, বলি বা যজ্ঞের মাধ্যমে নয়। তিনি মূর্তিপূজা বাতিল করেছিলেন এবং একেশ্বরবাদ প্রচার করেছিলেন। এর ফলে ইসলাম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমনকি শ্রীশঙ্করদেবের মুসলিম শিষ্যও ছিল। তারা কখনো ধর্মের ভেদাভেদ করেননি, বরং ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির ডাক দিয়েছিলেন।
এই প্রেক্ষিতে সুফি কবি সৈয়দ আব্দুল মালিক একটি জিকির গান লিখেছিলেন—
হিন্দু মুসলমান, এক আল্লার ফরমান
… গোরস্থানে কবর সারি সারি
… হিন্দুক পুরিবা, মুমিনাক গড়িবা।
অর্থ: হিন্দু ও মুসলমান আল্লাহর একই বিধানের অধীন। হিন্দুদের দাহ আর মুসলমানদের দাফন—দুটোই মানুষের মৃত্যুর শেষ পরিণতি। এই গানটি স্পষ্ট করে যে আসামে হিন্দু-মুসলিমরা একসঙ্গে শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। এরকম আরও অনেক জিকির গান আছে, যেখানে সুফিরা হিন্দু ব্যক্তিত্বদের প্রশংসা করেছেন এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলনের সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন।
চিরসবুজ সুফি সাধক ও তাদের প্রভাব
আসামে এমন কিছু সুফি ছিলেন, যাদের প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল—ধর্মের পার্থক্য নির্বিশেষে। আজান ফকির সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং সম্মানিত সুফি। তিনি তাঁর জিকির ও জারি গানগুলোর জন্য বিখ্যাত। তাঁর দরগাহ সিবসাগর জেলার সরাগুড়ি এলাকায়, ব্রহ্মপুত্রের সাথে দিখাউ নদীর মিলনের পাশে অবস্থিত। এটি খুব শান্তিপূর্ণ ও ভক্তিপূর্ণ দর্শনীয় স্থান। বন্দর পীর (সওয়াল পীর) ছিলেন আজান পীরের সমকালীন। বলা হয়, তিনি আজান পীরের সময় আসামে এসেছিলেন।
সুফি চাঁদ খান আসামের মিলনমুখী সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক। তাকে সাধারণত ‘চন্দাসী’ বা ‘আসামের কবির’ বলা হয়। তিনি মুসলিম হলেও অনেক জিকির ও কীর্তন লিখেছেন, যা হিন্দু ব্যক্তিত্বদের জন্য উৎসর্গ করা। এছাড়াও তিনি গোপালদেব-এর জীবনবৃত্তান্ত লিখেছেন, যিনি বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের প্রচারক ছিলেন। পাঁচা পীরের দরগাহ ধুবড়ি জেলায় অবস্থিত। এটি পাঁচ সুফি সাধকের—শাহ আকবর, শাহ বাগমার, শাহ সুফি, শাহ সরান এবং শাহ কামাল—সমাধির ওপর নির্মিত। এটি হিন্দু ও মুসলিম উভয়ের জন্য তীর্থস্থান। এখানে মানুষ প্রার্থনা করে, এবং দরগাহকে অলৌকিক ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত মনে করে।
অন্যান্য মহান সুফি যেমন শাহ আদম খাকি, মীরুল আরেফিন, শাহ নাটাওয়ান মানবতাবাদী প্রতীক ছিলেন। তারা সমাজ সংস্কারক, মুসলিম নেতা এবং সবথেকে বড় ব্যাপার—সামাজিক সম্প্রীতির জন্য কাজ করেছেন। বারাক উপত্যকায় হিন্দু-মুসলিম একতার দূত হিসেবে তাঁদের দেখা যায়। সুফিরা শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। কিছু খানকা জ্ঞান ও বিদ্যার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ইসলামের সমতার ধারণা ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষায় নিম্নবিত্ত হিন্দুরাও আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
আসামে অনেক সুফি দরগাহ আছে, যা যৌথ সংস্কৃতি ও সব ধর্মকে একত্রিত করার এক অনন্য উদাহরণ। ইতিহাসবিদ টি. ডাব্লিউ. আর্লন্ড বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার মূলত সুফিদের প্রচেষ্টা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হয়েছিল। তারা মানুষদের সামাজিক ও ধর্মীয় ভেদাভেদ বোঝতেন এবং সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, শান্তি ও সংস্কৃতিক মিলনের বার্তা দিতেন। আসামও এর ব্যতিক্রম নয়। সুফিরা নতুন ধরনের গান সাহিত্য তৈরি করেছিলেন—যেমন জিকির ও জারি, এবং বৈষ্ণব সাধকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য, ভ্রাতৃত্ব ও মিলনের মূলনীতি প্রচার করতেন। তাদের বার্তা এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, তাদের মৃত্যুর পরও মানুষ ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ চালিয়ে গিয়েছিলেন।
উপসংহার
উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বিশেষত আসামে সংস্কৃতির মিশ্রণ ও ধর্মীয় মিলন একটি স্বাভাবিক ঐতিহাসিক ঘটনা, যা বিভিন্ন সংস্কৃতির আদান-প্রদান, পুনর্ব্যাখ্যা এবং গ্রহণের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে। এই অঞ্চলে, সুফিবাদের আধ্যাত্মিক ধারাটি বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের শিক্ষার সঙ্গে গভীর সংযোগ স্থাপন করেছে। অনেক অসমীয়া মুসলিম সাধক—যেমন চাঁদ খান ও জয়হরি—শ্রীশঙ্করদেবকে গুরু হিসেবে মানতেন। এটি ইসলামের সেই নীতির প্রতিফলন, যেখানে আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক বা শিক্ষককে (পীর বা মুর্শিদ) অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো হয়। এই সম্মান উপাসনার সমতুল্য নয়, বরং জ্ঞানের উৎসের প্রতি বিনয় ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। এই মিলন হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় দূরত্ব কমাতে সাহায্য করেছে।
আজান ফকির প্রবর্তিত জিকির ও জারি এবং বৈষ্ণব কীর্তনের পরে দেওয়া মন প্রসাদ—দুটোই সামাজিক সম্প্রীতির উৎসব। যদিও ইসলামে ইবাদত (উপাসনা) শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট, তবে এই ধরনের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান সামাজিক ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে শরিয়তের সীমার মধ্যে বৈধ বলে বিবেচিত হয়।
মধ্যযুগের এই সুফি সাধকরা সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বজনীন ভালোবাসা ও শান্তি প্রচার করেছিলেন। তাঁদের দরগাহগুলি (মাজার) এখনও এমন স্থান, যেখানে বহু মানুষ ভক্তি ও শ্রদ্ধা জানাতে আসে। এই যিয়ারত (দর্শন) মূলত মৃত্যু ও পরকালকে স্মরণ করা এবং আল্লাহর এই নেক বান্দার প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে করা হয়, সরাসরি তাঁদের কাছে কিছু চাওয়ার জন্য নয়। তবে, আঞ্চলিক সংস্কৃতিতে অনেক সময় এই শ্রদ্ধাবোধ গভীর ভক্তির রূপ নেয়, যা ইসলামের মূল একত্ববাদী (তাওহিদ) চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে বলে কঠোর ইসলামি চিন্তাধারার অনুসারীরা মনে করেন।