ইন দ্য হ্যান্ড অফ তালিবান :- পশ্চিমা বিলাসিতায় বেড়ে উঠা এক সাংবাদিক নারীর ইসলাম গ্রহণ
ইন দ্য হ্যান্ড অফ তালিবান গ্রন্থটির রচিয়তা ইভন রিডলি। এই বইটি ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়। ইন দা হ্যান্ড অফ তালিবান গ্রন্থটি ইভন রিডলির আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। যেখানে তিনি টুইন টাওয়ার হামলা থেকে শুরু করে সংবাদ সংগ্রহের জন্য তার আফগান যাত্রা, ওয়ার অন টেরর, তালেবানদের হাতে বন্দী হওয়া, মুক্তি ,স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, এবং ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার চমকপ্রদ কাহানি বর্ণনা করেছেন নিঃশস্কোচে।
ইউরোপ ও আমেরিকায় ইসলাম নিয়ে যে ভীতি ও শঙ্কা দিনদিন ঘৃনার জন্ম দিচ্ছে, কিভাবে পশ্চিমারা ইসলাম ও মুসলিমদের দোষী সাব্যস্ত করে পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করছে, নির্দোষ মানুষকে কিভাবে সন্ত্রী, জঙ্গি,মানবতার শত্রু বলে চিহ্নিত করছে - তার এক নির্মোহ বয়ান এ গ্রন্থ।
লেখিকা সম্পর্কে কিছু কথা:- ইভন রিডলি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৮ সালের ২৩ এপ্রিল। তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট ইভন রিডলি। ইভান রিডলি ইংল্যান্ডের ডারহামের স্ট্রানলিতে বেড়ে উঠেন। ছোটবেলা থেকেই সংবাদ ও সাংবাদিকতা ছিলো তার ধ্যান- জ্ঞান । তাই নিজের চাকরি জীবন শুরু করেন স্টানলি নিউজ নামের একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে। পরবর্তীতে তিনি লন্ডন কলেজ অফ প্রিন্টিংয়ে এ পড়াশোনা করেন, এটা ছিল তার উপরের ওঠার একটি শক্তি সিড়ি। এ সিঁড়িতে পা দিয়েই পরবর্তীতে তিনি বিখ্যাত সব সংবাদমাধ্যমে কাজ করার সুযোগ পান। যেমন দ্য সানডে টাইম, দা ইন্ডিপেন্ডেন্ট অফ সানডে, দ্য অবজারভার, ডেইলি মিরর ,এবং নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড।
বইটির সারসংক্ষেপ:- বইয়ের পটভূমিটা শুরু ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ৯/১১ আমেরিকার সন্ত্রাসবাদের যুদ্ধ শুরু, আলকায়দার সফল হামলায় লন্ডভন্ড আমেরিকার বিখ্যাত টুইন টাওয়ার। টুইন টাওয়ার হামলায় যুক্তরাষ্ট্র সন্দেহের দৃষ্টি ওসামা বিন লাদেন এর উপর তথা তালাবানের দিকে।বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি তখন আফগানিস্তানে। ইভনি রিডলি তখন লন্ডন ভিত্তিক নিউজ সান্ডে এক্সপ্রেস পত্রিকার রিপোর্টার। এমন সময় সানডে এক্সপ্রেস থেকে (৯/১১) নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য প্রতিবেদক হিসাবে আমেরিকায় যেতে বলা হয়। আমেরিকার সংবাদ সংগ্রহ করতে থাকে স্বশরীরে সেখানে উপস্থিত হতে বলা হয়। ইভন রিডলিও আগ্রহর সঙ্গে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে।কিন্তু আমেরিকার সাথে তখন সব দেশের বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় ইভনে রিডলি যেতে সাময়িকভাবে থেমে যান। তাকে তিনদিন অপেক্ষা করতে হয়। বিপুল নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে অপেক্ষার পালা শেষে যখন তিনি আমেরিকাগ্রামী বিমানে উঠতে যাবেন, তখনই সানডে এক্সপ্রেস থেকে বলা হয়- আমেরিকা নয়, তোমাকে এখনই পাকিস্তানে যেতে হবে। কারণ আমেরিকার হামলার সাথে পাকিস্তানের যোগসূত্র রয়েছে। সানডে এক্সপ্রেস থেকে জানানো হয় এভাবে, ইভনি রিডলি সাথে সাথে আমেরিকার ফ্লাইট বাতিল করে ইসলামবাদের ফ্লাইটে চড়ে বসেন। এটাই ছিল ইভন রিডলির আফগান সফরের মূল প্রেক্ষাপট।
এরপর ইভনি পাকিস্থানে আসেন। ইসলামবাদে এসে লেখিকা খবর সংগ্রহে লেগে পড়েন এবং লেখিকা খবর সংগ্রহ করতে করতে পাকিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলে,পেশুয়ার, খাইবার এজেন্সি ও জামিয়া হক্কানিয়ার অন্যনতা আর বিচিত্রতা দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন। আপাদমস্তক পশ্চিমা এই নারী পাকিস্তানে এসে কিছুটা অবাক হন। পোষাক, সংস্কৃতি চলাফেরা সবকিছু তার কাছে মনে হয় প্রাচীন, জঙ্গলীয়। মদপানে তুমুলভাবে অভ্যস্ত নারী দেখেন পাকিস্তানে মদ রাষ্ট্রীয় আইনানুযায়ী নিষিদ্ধ।
পশ্চিমা বিলাসিতায় বেড়ে উঠা ইভন রিডলি আরো ভালোভাবে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য আফগান যাত্রা শুরু করেন, বিপদসংকুল পাহাড়ি দুর্গম এলাকা দিয়ে। ভ্রমণ করতে গিয়ে নানা ঝড়ঝাপোটার নির্মোহ বিবরণ দিতে যান বিখ্যাত এই সাংবাদিক নারী। কামাগ্রামে তিনি প্রথম স্পর্শ করেন আফগানের মাটি সেখানে অধিবাসীদের রূপববৈচিত্রের বিবরণ তুলে ধরেন অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায়।
মোটামুটি সফল একটি সফর করেই তিনি ফের পাকিস্থানে ফিরছিলেন। কিন্তু ফিরতি পথে রীতিমত অলৌকিকভাবে তালেবাদ গোয়েন্দাদের হাতে বন্দি হয়ে যান তিনি। যে বন্দীত্বের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে “ইন দ্য হ্যান্ড অফ তালেবান” বা তালেবানের বন্দীশালায়।
তিনি তালেবান এর হাতের ১০ দিন আটক ছিলেন। এই ১০ দিনে তালেবান তার সাথে কেমন বা কী আচরণ করেছে? তার-ই বা তালেবান সম্বন্ধে কেমন মনোভাব বা ধারণা ছিল? কিংবা তিনিও এই দশদিনে তালেবানের সাথে কেমন আচরণ করেছেন? সে সব কাহিনীর রুদ্ধশ্বাস বিবরণ পেশ করেছেন বইয়ের মূল আলোচনায়। যেগুলোর ধাপে ধাপে থমথমে উত্তেজনা, সংকট, ধোঁয়াশা -হলিউডের একজন মুভি কেও হার মানায়। আফগানের দুর্গম পাহাড়ি ভূমি, সাদামাটা জীবন যাপন তালেবান এর বৈচিত্র্যময় শরীর কাঠামো ইত্যাদির বিবরণও দিয়ে যান তার নিখুত কলমের তুলিতে........
এরপর নানা নাটকীয়তার পর লেখিকা তালেবানদের হাত থেকে দশ দিন পর ছাড়া পান। কিন্তু মুক্তি পেয়ে দেখেন পুরো বিশ্ব তাকে নিয়ে মত্ত। তার পরিবার ও যুক্তরাজ্যের পূর্ণ ধারণা ছিলো, তালেবানরা রিডলির ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করবে। কিন্তু ঘটনা ঘটতে থাকে উল্টো। তালেবানরা তার তো কোনো ক্ষতি করেনি বরং সসম্মানে তাকে নিজের দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
রিডলি আটক থাকা অবস্থায় মুসলমানদের নানা আচার-আচরণ দেখে মুগ্ধ হন। একজন তালেবান আলিম তাকে ইসলাম কবুল করার দাওয়াত দেন। ইভনি রিডলি তখন বলেছিলেন “আমি এখান থেকে ছাড়া পেয়ে ইসলাম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। এবং মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করেন। ত্রুর্মেই তিনি সত্যের আলোতে উদ্ভাসিত হতে থাকেন । আলহামদুলিল্লাহ তিনি ২০০৩ সালে ঘোষণা দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি মুসলিম হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে সোচ্চার কণ্ঠ তোলেন।
বইটির বৈশিষ্ট্য :- বিশ্বব্যাপী জঈী সংগঠন হিসেবে পরিচিত তালেবান (৯/১১) হামলার পর আমেরিকানদের চোখে আরো বেশি ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। মূলত: তালেবান আমেরিকার সামাজ্যবাদের ঘোর বিরোধী। পরবর্তীতে স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়েছে নিজেদের মধ্যে। তবে সকল আলোচনা সমালোচনাকে এক পাশে রেখে তালেবান একসময় হয়ে উঠেছিল অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী সংগঠন। ৯/১১ হামলার পর তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ব্রুস এরকম ক্রুসেড ঘোষণা করে বসেন গোটা মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে মূলত: সেই প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করেই লন্ডনভিত্তিক একজন সাংবাদিক ইভন রিডিলর আত্মগল্প রচিত হয়েছে “ ইন দা হ্যান্ড অফ তালেবান” গ্রন্থটিতে।
উক্ত বইটির আকর্ষণীয় দিক হলো :- এক সময় ঘোর নারীবাদী, মদ্যপ আর একাধিক সম্পর্ক স্থাপনকারী প্রায় নাস্তিক একজন মহিলা কি করে ইসলামের সুমহান ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন, এবং তিনি তালেবান এর হাতে কিভাবে বন্দী হয়েছেন, এছাড়াও তালেবানদের সাথে তার কিরকম যোগাযোগ ঘটেছিল, তারই শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা নিয়ে আত্মজীবনী ধাঁচের কলেবরে রচিত হয়েছে “ইন দ্য হ্যান্ড অফ তালেবান”।
এছাড়াও ইসলামবাদ ও জালাল বাদের আতিথেয়তা, সেখানকার মহিলাদের জীবনযাপন, তালেবানদের কয়েদিখানায় বন্দী জীবন কাটানো, সেখান থেকে ফিরে আসা, তারপর ইসলাম গ্রহণ এবং কিছু ভয়াবহ ঘটনা চাক্ষুষ বিবরণ দিয়ে বইটি পরিপূর্ণ করা হয়েছে।
এসব ঘটনার সাথে লেখিকা তুলে ধরেছেন তার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু স্মরণীয় ঘটনা প্রবাহ তিনি তিনবার বিয়ে করেও লেখিকার সন্তানের বাবা তার স্বামীদের মধ্যে কেউ ছিলনা। এবং সাংবাদিক তা নিয়ে তার জীবনচক্র, এসবই লেখিকা তুলে ধরেছেন তার আত্মজীবনী এক অসম্মান দলিল “ইন দা হ্যান্ড অফ তালিবান” বইয়ে।
শেষ কথা:- ““ইন দা হ্যান্ড অফ তালেবান” বইটি, এমন একটা বই যেখানে একজন বিধর্মী পশ্চিমা সাংবাদিক যিনি আমেরিকায় ৯ /১১ হামলার পিছে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সত্যিকারের শান্তির খোঁজ পান আর তাও আবার ইসলাম থেকে। পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, এবং পশ্চিমা বিশ্বে আলোড়ন তুলেন, এবং ইসলামের আসল বাণী, ইসলামের শ্রেষ্ঠতা, ইতিহাস, এবং শান্তির কথা তুলে ধরেন। এছাড়াও মুসলমানদের উপর অপবাদ এবং ষড়যন্ত্রের যে জাল পশ্চিমারা বানিয়ে ছিল, তা তিনি মুসলিম হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানদের উপর নির্যাতনের বিষয়ে আওয়াজ উঠিয়েছেন। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে তিনি সত্যের কণ্ঠে ইসলামের পক্ষে কথা বলে এসেছেন। এবং ২০১৪ সালের তিনি ব্রিটিশ মুসলিমস অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। যে কোন শ্রেণীর পাঠকদের কাছে এটি একটি সুখপাঠ্য বই হিসাবে বিবেচিত হবে বলে আমি মনে করি। বর্তমান সময়ে বেশ সাড়া জাগানো বই এটি। আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করব নিশ্চয়ই আপনারা সময় বের করে বইটি একবার পাঠ করবেন।