ফ্রম মাই সিস্টার্স লিপস: নারী মুক্তির সত্য ঘটনা
”ফর্ম মাই সিস্টার্স লিপস” গ্রন্থটির রচিয়তা নাইমা রবার্ট । এই গ্রন্থটি ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ে নাইমা রবার্ট সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন তার ইসলামে আসার গল্প, যেখানে আসাটাই ছিল তার কাছে সবচেয়ে যৌওিক। আর আছে বিগত বছরগুলোয় তার সাথে পরিচয় হওয়া কজন বিস্ময় নারীর গল্প- যারা তার মতোই ইসলামকে স্বেচ্ছাবরণ করে নিয়েছেন। সব মিলিয়ে এ এক হাত ধরাধরি করে পথচলার কাহিনী। বিয়ে থেকে শুরু করে মাতৃত্ব,জীবন,আত্মসমর্পণ, আত্মছবি -সবকিছুর মিশেলে এ হচ্ছে কিছু দৃঢ় আওয়াজ, গর্বিত কন্ঠস্বর যা- এই বইয়ে বর্ণিত করা হয়েছে।
একদল বিদেশি নওমুসলিমা বোনদের হাত ধরাধরি করে ইসলামের পথে আসা এবং এ পথে তাদের নানান বাধা-বিপত্তি, আশা, হতাশা, নিজেকে আল্লাহর কাছে সঁপে দেওয়া, প্রথম অভিজ্ঞতা ও ভালোলাগাগুলো নিয়ে শিক্ষানীয় এ বই। ইসলাম গ্রহণের বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত নেওয়া নারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে গতানুগতিক ভাবনা যে -এ ধর্ম নারীকে দমিয়ে রাখে, আড়াল করে চার দেওয়ালের অভ্যন্তরে। কিন্তু এটাই সম্পূর্ণ চিত্র নয়। একজন ব্রিটিশ নারী নেইমা বি রবার্ট তার নতুন বইয়ে অর্থাৎ ফ্রম মাই সিস্টার্স লিপস এ নতুন আলোচনা তুলে ধরেছেন। আমরা বিগত কয়েকদিনে দেখলাম কিভাবে সারাহ আল শায়েরি হিজাব পড়েই অলিম্পিক্স খেলেন এবং মেডেল্জয়ী হন।
বইটির সারসংক্ষেপ :-
“ফর্ম মাই সিস্টার লিপস” গ্রন্থটির রচিয়তা নাইমা রবার্ট, যিনি একজন শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান পিতা এবং একজন কিসাঙ্গ জুলুমের ঘরে জন্মগ্রহণকারী একজন মহিলা। যিনি ইংল্যান্ডের উত্তরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এবং তার পরিবারের সাথে এবং তারপরে জিম্বাওয়ে তে চলে এসেছিলেন। যেখানে তিনি উচ্চ বিদ্যালয় শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিলেন, এবং তারপরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের জন্য ইংল্যান্ডে ফিরে এসেছিলেন। তিনি অন্য অনেকের মতোই গতানুগতিক জীবনযাপন করছিলেন। কলেজের প্রথম বর্ষ শেষে গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি মিশরে আসেন । এবং সেখানে হিজাব পরা মহিলাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, এত বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, সেই হিজাবি মেয়ের সাথে কথা না বলে থাকতে পারেননি। তখনই নাইমা রবার্ট তাকে প্রশ্ন করেন “তুমি নিজেকে ঢেকে রাখো কেন ? তুমি তো খুব সুন্দরী। তখনই সেই হিজাবি মেয়ে “উত্তর দিল কারণ আমি চাই আমি যা বলি এবং যা করি তা দিয়ে মানুষ আমাকে বিচার করুক - আমি দেখতে কেমন তা দিয়ে নয়”। এবং এই কথাটি লেখিকাকে উত্তেজিত করেছিল এবং তাকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করেছিল এবং এ ঘটনার পর নাইমা রবার্ট নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন যে সৌন্দর্য ছাড়া শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধিমতা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস তার আছে কিনা। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ তাকে সাহস দিয়েছেন।
এছাড়াও তিনি ইসলাম সম্পর্কে আরো জানতে পেরেছিলেন যখন তিনি পাপুয়া জিনিয়ার একটি মুসলিম পরিবারের সাথে রমজান কাটিয়েছিলেন। এবং কুরআনের অনুবাদ পড়ার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু এবং সহকর্মীর সাথে আলোচনা করেছিলেন, এবং অবশেষে 1998 সালে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইসলামের ছায়ায় তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:-
ফর্ম মাই সিস্টার্স লিপস বইটি “নিপীড়িত মুসলিম নারীদের সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা গুলোকে নস্যাৎ করে দেয় এবং এর মাধ্যমে অনেক নারীকে তাদের জীবন, বিয়ে, পরিবার, ও ধর্ম সম্পর্কে অন্ত দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। এটি বিশ্ব মহিলাদের কাছ থেকে আসা শক্তিশালী বই যারা ইসলাম গ্রহণ করতে বেছে নিয়েছিল এবং তাদের গল্পগুলি সত্যি আলোকিত এবং চিন্তা- উদ্দীপক ছিল। সমাজ বা তাদের পরিবার কি ভাববে তা নির্বিশেষে বুদ্ধিমান মহিলারা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। তার চেয়েও বড় কথা আমার খুব ভালো লেগেছে যে এই বইটি পশ্চিমা এবং ইসলামী উভয় মূল্যবোধের সারসংক্ষেপ করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও উল্লেখ করেছে যে জনপ্রিয় বিশ্বাসের এর বিপরীতে, মুসলিম নারীরা প্রকৃতপক্ষে “স্বাধীন”।
এছাড়াও মাঝে মাঝে ধর্মের উচ্ছ্বসিত বর্ণনা আছে এমন উদাহরণও রয়েছে যেখানে আমি অনুভব করেছি যে নির্দিষ্ট সাম্প্রদায়িক বিশ্বাসকে মহামান্বিত করা হয়েছিল। তারপরও লেখিকা তার গল্প বলেছেন হৃদয় স্পর্শকারী এক দৃষ্টিকোণ থেকে। পাঠক হিসাবে আমি তার আবেগকে বিশ্বাস করেছি এবং বইয়ের সব নারীর জীবন উপভোগ করেছি।
বইটির অন্যতম শক্তি হলো:- ফ্রম মাই সিস্টার্স লিপস লেখিকা নাইমা বি রবার্ট এর আন্তরিকতা আমার অন্তরকে ছুঁয়ে গেছে। তিনি এমন কি ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় এ বইতে আলোচনা করেছেন। শুধু বোনদের জন্য নয়, দ্বিনকে মজবুত করতে মুসলিম ভাইদের জন্য এ বইটি জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা।
এই বইতে নাইমা রবার্ট নিজের পাশাপাশি আরো কিছু বোনের কথা উল্লেখ করেছেন যাদের সাথে তিনি হাত ধরাধরি করে পথ চলেছেন। মুসলিমরা যে পরস্পর বোন - এ বিষয়টা খুব ভালোভাবে উঠে এসেছে তার লেখায়। তিনি কিভাবে মুসলিম হলেন, এজন্য তাকে কত খোঁজ খবর নিতে হয়েছে, কত পড়াশোনা করতে হয়েছে, সেগুলো উঠে এসেছে। প্রাসঙ্গিক উঠে এসেছে স্বামী নির্বাচন,বিয়ে, ক্যারিয়ার, জীবন মানেই কর্তব্য আর আকাঙ্ক্ষা নিরন্তর লড়াই তেমনি- জীবন কর্তব্য এবং আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটি নিরন্তর যুদ্ধ। এভাবেই নাইমা রবার্ট আমাদের নিজেদের সম্পর্ককে আমাদের আচরণ এবং এমনকি ধার্মিক সর্বশক্তিমানের সাথে আমাদের সম্পর্ক সম্পর্কে বারবার চিন্তা করতে বাধ্য করে। এছাড়াও সবকিছু ছাপিয়ে আপনি “জীবন সম্পর্কে” একজন মুসলিমার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারবেন। জন্মগতভাবে মুসলিম হওয়া আর প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর আইন মেনে চলা এক নয়। আত্মসম্মানের ধাপে ধাপে রয়েছে “মানুষ কি ভাববে” - এসব চিন্তা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেওয়ার মানসিকতা। এই ধাপগুলো নওমুসলিম ওই বোনদের জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু তারা হাল ছেড়ে দেননি। তারা তাদের পরিবারকে ছেড়েছেন, ছেড়েছেন বন্ধুবান্ধব,খ্যাতি, তথাকথিত সামাজিকতা।
এই বই থেকে কি কি জানতে পারবেন ?:-
- নাস্তিকতা, পথভ্রষ্টতা থেকে দিনে ইসলামে ফিরে আসাটা আসলে কেমন ? তাদের প্রথম সালাত প্রথম মসজিদে যাওয়ার অভিজ্ঞতা গুলো কেমন হয়।
- নিকাহ ওয়ালিমা, বাচ্চা লালন পালনের বিষয় এবং স্বামী স্ত্রীর মধ্যেকার সমস্যা গুলোর ইসলামিক সমাধান কিভাবে করতে হবে ?
- ইসলামের দৃষ্টিতে “সিস্টারহুড” আসলে কেমন হওয়া উচিত ? এসব কিছু জানা যাবে এই বইয়ের মাধ্যমে। ইনশাআল্লাহ।
- আপনি আরো জানতে পারবেন, ইসলামে “সিস্টারহুড” আসলে কত আন্তরিক একটা সম্পর্ক। অন্যকে কটাক্ষ করা, ছোট করা আড়ালে সমালোচনা করা, অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া ,অপমানিত করা, অন্যের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা-এগুলোর কোন স্থান নেই দ্বীনে ইসলামে , সম্পর্কটা একদম আন্তরিক। এখানে, বোনেরা নিজের চেয়ে অপর বোনকে বেশি প্রাধান্য দেন। আমার প্রয়োজন সত্বেও অন্যকে দিয়ে দেওয়ার চেয়ে মানসিকতা - তা শুধুমাত্র “ইসলামী সিস্টারহুডেই ”পাওয়া সম্ভব। এটা একটা নিঃস্বার্থ সম্পর্ক। শুধুই আল্লাহর জন্য ভালোবাসা একসাথে হাত ধরাধরি করে আল্লাহর দিকে ছুটে চলা যারা দিনে ফিরতে চাচ্ছেন তাদের জন্য ধাপে ধাপে সাহায্য করবে এই বইটা। লেখিকার আন্তরিকতা আপনার অন্তরকে আঘাত করবে ইনশাআল্লাহ।
বইটির আকর্ষণীয় দিক হলো :-
ফ্রম মাই সিস্টার্স লিপস বইয়ের পৃষ্ঠাগুলির মাধ্যমে,লেখিকা বইয়ের মাধ্যমে আমাদেরকে তার অভিজ্ঞতা এবং তার বন্ধুর অভিজ্ঞতা - বোনদের ইসলামের সাথে, হিজাব,বিবাহ,সন্তান লালন-পালনের সাথে, তাদের সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গের সাথে বর্ণনা করেছেন।পশ্চিমা পাঠক পাঠকদের উদ্দেশ্য করে লেখা যাদের ইসলাম সম্পর্কে অন্যায্য র্ধারণা রয়েছে , যা নারীদের নিকরণ করে এবং ইসলামে নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য সম্পর্কে । এইসব বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে এই বইটিতে। কিছু মানুষের কাছে ইসলাম মানে আত্মঘাতী হামলা, সম্মান রক্ষার্থে নারী হত্যা ও নারীর উপর অত্যাচার। এ ধারণা বদলানোর উপায় কি? নাঈমা রবার্ট এর চমৎকার শুরু করেছেন। ফ্রম মাই সিস্টার্স লিপস - মুসলিম নারীদের ব্যাপারে যেসব কুসংস্কার লালন করে পশ্চিমা দুনিয়ায়, এই বইটার উত্তর দেয়,আর মোড় ঘুরায় পাঠকদের ভাবনায়। নাঈমা রবার্ট আবার দেখিয়েছেন ইসলাম কেমন করে নানান পরিবেশের নারীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে, যার ফলাফল আকর্ষণীয়। এছাড়াও জন্মের সূত্রে পাওয়া ইসলাম ধর্মটাকে আমরা কতই না অবজ্ঞা করি!- তা কিছু নওমুসলিম বোন তাদের ত্যাগ, আত্মসমর্পণ, উপলব্ধির মাধ্যমে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে ইনশাআল্লাহ। এছাড়াও কিভাবে আল্লাহকে ভালোবেসে দ্বীনকে সবার আগে রাখতে হয়, তা এই বোনদের পথ চলা গুলো আমাদের উপলব্ধি করতে শেখাবে।
মোদ্দাকথা :- এই বইটি আমার পড়া আত্মজীবনীমূলক রচনা গুলির মধ্যে সবচেয়ে অনুপ্রেরণামূলক লেখা। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নাঈমা রবার্ট আমাদেরকে নিয়ে যান তার প্রত্যাবর্তনের যাত্রায়। এবং কিভাবে তিনি একই ধরনের মুসলিম নারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যারা তার “সিস্টারহুড” এর নেটওয়ার্ক গঠন করেছিল। চারপাশের সামাজিক চাপ সত্ত্বেও তিনি 1998 সালে ইসলাম গ্রহণ করেন, এবং ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ ছাড়াও তিনি আজকের বিশ্বে মুসলিম মহিলারা যে সমস্ত সমস্যার মুখোমুখি হন তা নিয়েও কথা বলেছেন। মোটকথা, ফ্রম মাই সিস্টার্স লিপস ইসলামী মহিলাদের ওপর একটি তথ্যবহুল বই এবং মসৃন রূপান্তর সহ একটি মনোরম পাঠ। এছাড়াও ফ্রম মাই সিস্টার্স লিপস সত্যি একটি অসাধারণ পাঠ। যারা তথাকথিত “নিপীড়িত” মুসলিম নারীদের জীবন সম্পর্কে গভীর অন্তদৃষ্টি চান, তাদের জন্য এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।