হজের আধ্যাত্মিক দিক এবং এর ফজিলত

হজ হচ্ছে ইসলামের একটি অন্যতম ফরজ বিধান। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মানুষের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। মহান আল্লাহর নৈকট্যলাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো হজ। হাদিসে হজের অসংখ্য সওয়াব ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। নিচে হজ কী, হজের কাজগুলো কী, কার ওপর ফরজ, হজের গুরুত্ব-ফজিলত ও না করলে পরিণাম কী—বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

হজ কী?
এর শাব্দিক অর্থ হলো সংকল্প করা, সফর করা। পরিভাষায়- নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট কার্যাবলীর মাধ্যমে বায়তুল্লাহ শরিফ জেয়ারত করাকে হজ বলা হয়। 

হজের নির্দিষ্ট সময় হলো- আশহুরে হুরুম তথা শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম ১০ দিন; বিশেষত জিলহজের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত পাঁচদিন। এ পাঁচ দিনই মূলত হজ পালন করা হয়। হজের নির্ধারিত স্থান হলো পবিত্র কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা ও মুজদালিফা। দূরবর্তী হাজিদের জন্য মদিনা মুনাওয়ারায় রাসুল (স.)-এর রওজা জেয়ারত করা ওয়াজিব। 

হজের কার্যাবলীর মধ্যে রয়েছে ইহরাম, তালবিয়া, তাওয়াফ ও সায়ি, অকুফে আরাফাহ, অকুফে মুজদালিফা, অকুফে মিনা, কংকর নিক্ষেপ, দম ও কোরবানি, হলক ও কছর এবং জিয়ারতে মদিনা-রওজাতুর রাসুল ইত্যাদি।

হজের বিধান
হজ আল্লাহর ফরজ বিধান। ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা ফরজ’। রাসুল (স.) বলেন, ‘লোকসকল! আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন।’ আকরা ইবনে হাবিস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এটা কি প্রত্যেক বছর ফরজ?’ উত্তরে রাসুল (স.) বললেন—

আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তবে ফরজ হয়ে যেত। আর প্রতি বছর হজ ফরজ হলে তা তোমরা সম্পাদন করতে সক্ষম হতে না? হজ জীবনে একবারই ফরজ। কেউ যদি একাধিকবার করে, তবে তা হবে নফল হজ।

যাদের ওপর হজ ফরজ, যত দ্রুত সম্ভব হজ আদায় করা উত্তম। যেখানে মানুষের জীবন-মরণের এক সেকেন্ডের নিশ্চয়তা নেই, সেখানে এক বছর অনেক দীর্ঘ সময়। তাই রাসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছে করেছে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা করে নেয়।’

কার ওপর হজ ফরজ
পাঁচটি শর্তসাপেক্ষে হজ ফরজ। ১) মুসলিম হওয়া ২) আকল থাকা বা বিবেকবান হওয়া অর্থাৎ পাগল না হওয়া ৩) বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া ৪) আজাদ বা স্বাধীন হওয়া অর্থাৎ কারো গোলাম না হওয়া এবং ৫) দৈহিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া। থাকা। 

স্মরণ রাখতে হবে, জাকাত ফরজ না হয়েও কারো ওপর হজ ফরজ হতে পারে। কেননা হজ ও জাকাতের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। যেমন, জাকাতের সম্পর্ক নির্ধারিত নিসাবের সঙ্গে। হজের সম্পর্ক মক্কায় আসা-যাওয়ার খরচের সঙ্গে।

সুতরাং স্থাবর সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে কেউ যদি হজ আদায় করতে সক্ষম হয় এবং হজ থেকে ফিরে এসে বাকি সম্পত্তি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, তাহলে তার ওপর হজ ফরজ। 

হজের গুরুত্ব ও ফজিলত
এক হাদিসে হজকে উত্তম আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একবার রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘সর্বোত্তম আমল কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনা।’ প্রশ্ন করা হলো, ‘তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।’ আবার প্রশ্ন করা হলো, ‘এরপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘হজে মাবরুর তথা মকবুল হজ।’ হাদিসে হজের মাধ্যমে গুনাহ মাফের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। রাসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে হজ করল এবং এসময় অশ্লীল ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল, সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে।’ হজের বিনিময় জান্নাত। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন—العمرة إلى العمرة كفارة لما بينهما، والحج المبرور ليس له جزاء إلا الجنة এক উমরা আরেক উমরা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহর ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। আর হজে মাবরুরের প্রতিদান তো জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। যেহেতু হজ আর্থিক ইবাদতের সাথে সম্পর্কিত। রাসুল (স.) বলেন, ‘তোমরা হজ-ওমরা সঙ্গে সঙ্গে করো। আর মকবুল হজের বিনিময় জান্নাত’ অন্য এক হাদিসে হজের জন্য খরচকৃত সম্পদকে সাতশো গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘হজের জন্য খরচ করা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার মতোই, যার সওয়াব সাত শগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।’ এছাড়াও হজ ও ওমরাহ পালনকারীকে আল্লাহর মেহমান বলা হয়েছে। আর এক্ষেত্রে মেহমানের সাথে তার আশানুরূপ আচরণ করা হবে। জাবির (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজ ও ওমরাকারীরা আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা দোয়া করলে তাদের দোয়া কবুল করা হয় এবং তারা কিছু চাইলে তাদের তা দেওয়া হয়।’ 

হজের আত্মিক দিক

হজ, ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভ, শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক সফর নয়; এটি একটি গভীর আত্মিক যাত্রা, যা আত্মাকে রূপান্তর করে, হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে এবং বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ককে নতুন করে জাগিয়ে তোলে। অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে হজ আলাদা, কারণ এটি একজন মুসলমানকে সব ধরনের পরিচয়, মর্যাদা এবং জাগতিক আসক্তি থেকে মুক্ত করে শুধুমাত্র দুই টুকরো সাদা কাপড়—ইহরামে—আবৃত করে। এই পোশাকের একরূপতা মানুষকে মনে করিয়ে দেয়—আল্লাহর দরবারে সকলেই সমান; ধন, বর্ণ কিংবা উপাধি কোনো কিছুই সেখানে মূল্যবান নয়।

হজের সবচেয়ে আত্মিক ও গভীর মুহূর্তগুলোর একটি হলো আরাফাতের ময়দানে অবস্থান। সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ একসঙ্গে হাত তুলে, চোখের পানি ফেলে, ক্ষমা চেয়ে নিজেদের দুনিয়াবি অহংকার ভেঙে আল্লাহর দরবারে ফিরে আসে। রাসূলুল্লাহ বলেছেন, “হজ হলো আরাফা।” এই কথার মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন—এই আত্মিক উত্থান ও খাঁটি তওবা-ই হজের মূল চেতনাকে ধারণ করে।

হজের প্রতিটি আমল এক একটি আত্মিক বার্তা বহন করে। কাবা ঘরের তাওয়াফ কসমিক এক চক্রের প্রতিচ্ছবি—যেখানে সকল সৃষ্টি আল্লাহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। সাফা-মারওয়ায় দৌড়ানোর মাধ্যমে হাজেরার পানির খোঁজের ভেতর আমরা দেখি মানবীয় প্রচেষ্টা, আশা ও আল্লাহর প্রতি আস্থার গল্প। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে মনে করিয়ে দেওয়া হয়—আমাদের জীবনে শয়তানী প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে অবিরত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

সারকথা, হজ হলো বাহ্যিকতা থেকে আন্তরিকতার দিকে এক যাত্রা—আচার থেকে আধ্যাত্মিক বাস্তবতার দিকে ফেরা। এটি আত্মিক পরিশুদ্ধির এক অনন্য সুযোগ, যেন এক নবজন্ম। অনেকের জন্য হজ জীবনের সবচেয়ে রূপান্তরক ঘটনা হয়ে ওঠে, যেখানে দুনিয়ার ভার হালকা হয়, আর আত্মা আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণের স্বাদ অনুভব করে।

লিবিয়ার আমিরের হজযাত্রা একটি হৃদয়ছোঁয়া আত্মিক কাহিনী, যা হজের রূহানিয়্যাত (spiritual dimension) ও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের প্রকৃত মর্মকথা আমাদের সামনে তুলে ধরে। হজ একমাত্র ইবাদত, যেখানে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে বান্দা তার অহংকার, পরিচয় ও আরামদায়ক জীবন সব কিছু ছেড়ে দিয়ে সাদা কাপড়ে নিজেকে ঢেকে ফেলে। এই অবস্থায় একজন হাজী যেন বলেন—“হে আল্লাহ, আমি এসেছি, আমি তোমার!” আমিরের যাত্রা ছিল এই আত্মসমর্পণেরই বাস্তব রূপ।

যখন একের পর এক বাধা এসে পড়ে—নামের জটিলতা, বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি, বৈরি আবহাওয়া—তখন একজন সাধারণ ব্যক্তি হয়তো ভেঙে পড়ত। কিন্তু আমির বলেন: "আমি এই বিমানবন্দর ছেড়ে যাব না, যতক্ষণ না আল্লাহ চান।" এই বাক্য ছিল তাঁর অন্তরের গভীর ঈমানের প্রকাশ। তিনি বোঝেন, হজ কেবল একটি টিকিট বা ভিসার সফর নয়, এটি হচ্ছে অন্তরের প্রস্তুতি ও আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ নির্ভরতার পরীক্ষা।

কুরআনে আল্লাহ বলেন:
"وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ"
“যে আল্লাহর উপর ভরসা করে, তাঁর জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।” (সূরা আত-তালাক, ৬৫:৩)

আমিরের ধৈর্য ও দোয়ার বরকতে আকাশও যেন বদলে গেল, বিমান আবার ফিরল, দরজা খুলল, আর সবাই বলল, “দোয়া করুন, শায়খ!”—এ এক নিঃসন্দেহে আধ্যাত্মিক বিজয়।

এই কাহিনী হজের মহত্বকে আরও গভীর করে তোলে। হজ এক দেহগত নয়, এক আত্মিক ভ্রমণ। আমিরের কাহিনী আমাদের শেখায়—হজে সফলতা মানে নিরবচ্ছিন্ন ভ্রমণ নয়, বরং ভাঙা পথে আল্লাহর উপর অনড় আস্থা এবং তাৎপর্যপূর্ণ দোয়া। হজ মানে আত্মাকে এমন এক অবস্থা এনে দেওয়া, যেখানে বান্দা বলেন—“তুমি চাইলেই হবে, হে প্রভু!”

ফরজ হজ না করার পরিণাম
সামর্থ্য থাকার পরও হজ না করার পরিণাম ভয়াবহ। ফরজ হজ ত্যাগ করলে ইহুদি-নাসারার মতো মৃত্যু হবে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন- من أطاق الحج فلم يحج فسواء عليه مات يهوديا أو نصرانيا ‘যে ব্যক্তি হজ করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ করে না, সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খ্রিস্টান হয়ে, তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই।’ আর কেউ যদি হজ অস্বীকার করে বা কোনো ধরনের অবহেলা প্রদর্শন করে তবে সে আল্লাহর জিম্মার বাইরে বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- ولله على الناس حج البيت من استطاع اليه سبيلا، ومن كفر فان الله غنى عن العلمين ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের ওপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করা ফরজ। আর কেউ যদি অস্বীকার করে, তাহলে জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ এছাড়াও হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ তাআলা হজ না করার পরিণতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে বান্দাকে আমি দৈহিক সুস্থতা দিয়েছি এবং আর্থিক প্রাচুর্য দান করেছি, অতঃপর  তার পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে যায় অথচ আমার দিকে আগমন করে না, সে অবশ্যই বঞ্চিত।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter