রাশিদ খালিদি কর্তৃক ফিলিস্তিন মুসলিমদের এক শতাব্দীর সংগ্রামের ইতিহাস
প্রারম্ভিক প্রতিফলন
ফিলিস্তিন—একটি ভূমি, একটি জাতি, একটি বেদনার নাম। শতবর্ষ ধরে সেখানে চলছে মানুষের ঘর হারানোর, জমি হারানোর, এবং স্বপ্ন হারানোর এক অবিরাম ট্র্যাজেডি। কিন্তু সেই জমিন আবার আমাদের ঈমান, ন্যায়বিচার এবং ইতিহাসচেতনার পরীক্ষা। এই প্রেক্ষাপটে ড. রাশিদ খালিদির বই The Hundred Years’ War on Palestine ফিলিস্তিনের ইতিহাস ও ইসরায়েলি ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের এক অমূল্য দলিল।
লেখক পরিচিতি ও বইয়ের গুরুত্ব
ড. রাশিদ খালিদি একজন প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি-আমেরিকান ইতিহাসবিদ ও মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি বিশেষজ্ঞ। তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের Edward Said অধ্যাপক এবং ‘Journal of Palestine Studies’-এর প্রাক্তন সম্পাদক। তাঁর নিজ পরিবার জেরুজালেম থেকে উৎখাত হওয়া পরিবারগুলোর একটি, যা বইটিকে ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক দুই দৃষ্টিকোণ থেকেই সমৃদ্ধ করেছে।
বইটি ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত, প্রতিটি অধ্যায় ফিলিস্তিনের একেকটি ঐতিহাসিক বাঁকে উপনীত।
বইয়ের মূল বিষয়বস্তু
১. বালফোর ঘোষণা ও এর পরিণতি (1917)
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আर्थার বালফোর ‘বালফোর ঘোষণা’ দিয়ে ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় গৃহ প্রতিষ্ঠার কথা জানায়। কিন্তু এই ঘোষণায় ঐ অঞ্চলের ৯০% মুসলিম ও খ্রিস্টান জনগণের মতামতের প্রতি কোন গুরুত্বই দেয়া হয়নি।
???? ১৯১৭ থেকে ১৯৪8 সালের মধ্যে ইহুদিবাসীর সংখ্যা ৬০,০০০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬,০০০০০।
???? ঐ সময়ে প্রতি বছর ২%-৪% করে মুসলিমদের জমি হারাতে হয়।
???? আল্লাহ বলেন:
“আপনি যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবেন, ন্যায়বিচার করবেন।”
(সূরা আন-নিসা ৪:৫৮)
২. ব্রিটিশ শাসন ও আরব বিদ্রোহ (1920–1939)
ব্রিটিশ শাসনামলে ইহুদি বসতিস্থাপন বৃদ্ধি পায় এবং মুসলিমদের জমি ন্যায্য দামে বিক্রয়ে বাধ্য করা হয়।
???? ১৯৩৬–৩৯ সালের ‘গ্রেট আরব রিভোল্ট’-এ প্রায় ৫,০০০ ফিলিস্তিনি শহীদ হন, এবং ১৫,০০০ জন গ্রেফতার হন।
???? প্রায় অর্ধেক ফিলিস্তিনি জমি ইহুদিদের হাতে চলে যায়।
???? কুরআন বলে:
“ধৈর্য্য এবং নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো; নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।”
(সূরা আল-বাকারা ২:১৫৩)
৩. নাকবা ও শরণার্থী সংকট (1948)
১৪ মে ১৯৪৮-এ ইসরায়েলের ঘোষণা হয়, যার ফলে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়।
???? প্রায় ৭,৫০,০০০ মুসলিম ও খ্রিস্টান ফিলিস্তিনি শরণার্থী হন।
???? ধ্বংস বা পরিত্যক্ত হয় ৪০০টিরও বেশি গ্রাম।
???? বহু পরিবার আজও নিজভূমিতে ফিরতে পারেনি।
???? নবীজি ﷺ বলেন:
“অত্যাচারিতের দোয়া কখনও ফেরত যায় না।”
(সহীহ বুখারি)
৪. ছয় দিনের যুদ্ধ (1967)
৫ জুন ১৯৬৭ সালে শুরু হওয়া যুদ্ধে ইসরায়েল মাত্র ছয় দিনে পূর্ব জেরুজালেম, গাজা ও পশ্চিম তীর দখল করে।
???? দ্বিতীয়বার প্রায় ৩,০০,০০০ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হন।
???? পবিত্র আল-আকসা মসজিদ ইসরায়েলের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
৫. অসলো চুক্তি ও বসতি বিস্তার (1993–2020)
১৯৯৩ সালে সই হওয়া অসলো চুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের আংশিক স্বশাসনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে?
???? বসতি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে—১৯৯৩ সালে বসতির সংখ্যা ছিল ২,৫০,০০০, যা ২০২০ সালের মধ্যে দাঁড়ায় ৬,০০,০০০।
???? ইসরায়েল ৬০% পশ্চিম তীর কার্যত দখলে রাখে।
৬. গাজা অবরোধ ও মানবিক বিপর্যয় (2007–2021)
২০০৭ সাল থেকে গাজা অবরোধ করে রেখেছে ইসরায়েল।
???? এই মুহূর্তে গাজায় ২০ লক্ষ মানুষ খাদ্য, ওষুধ, বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে।
???? ২০০৮–২০২১ সালে চালানো অভিযানে ৪,৫০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি শহীদ হন।
???? গাজার হাসপাতালগুলোর ৪৫% এখন কাজ করছে সীমিত ক্ষমতায়।
সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ ও ইসলামি মূল্যায়ন
রাশিদ খালিদির লেখা তথ্যভিত্তিক, বিশ্লেষণধর্মী এবং মানবিক দৃষ্টিকোণসম্পন্ন। তিনি কোনো গুজব বা অতিরঞ্জন করেন না; বরং দলিল, পরিসংখ্যান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ইতিহাস তুলে ধরেন। কুরআনের ন্যায়বিচার, ধৈর্য ও প্রতিরোধের আলোকে এই বইটি পড়া উচিত।
একজন মুসলিম পাঠকের জন্য এটি কেবল ইতিহাসের বই নয়, বরং আত্মজিজ্ঞাসার দরজা।
শেষকথা
The Hundred Years’ War on Palestine একটি দলিল, একটি প্রত্যয়, একটি আহ্বান। এই বই আমাদের বলে দেয়, দুঃখের এই ইতিহাস ভুলে যাওয়া নয়; বরং এর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়াই ঈমানদারির পরিচয়।
“কাঁটা আছে পথেতে—তবুও মর্যাদার পথ সেই কাঁটাময় পথেই।” (আল-মুত্তানাব্বি)
যারা ফিলিস্তিন ইস্যু বুঝতে চান, এবং উম্মাহর দায়িত্ব অনুভব করেন—তাদের জন্য বইটি অপরিহার্য। এখনই সময়, ইতিহাস জানার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার।