ঈশ্বরের অস্তিত্ব: থমাস আকুইনাস ও ইমাম আল-গাযালির যুক্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি
ভূমিকা:
মানবজাতি চিরকালই এক মহান, অদৃশ্য, সর্বশক্তিমান ও চিরন্তন সত্তার সন্ধান করে এসেছে। সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় পাতায় দেখা যায়, মানুষ বারবার এই প্রশ্ন করেছে—এই বিশ্বজগৎ কোথা থেকে এলো? আমরা কেন এখানে আছি? এই জগতে সব কিছু এত পরিপাটি, নিয়মতান্ত্রিক এবং অর্থবহ কেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই মানব সমাজে ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের আবির্ভাব ঘটেছে। ঈশ্বর বা স্রষ্টার ধারণাটি তাই কেবল ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বরং তা গভীর দার্শনিক চিন্তা, যুক্তি, অভিজ্ঞতা ও আত্মজিজ্ঞাসার ফল।
বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতায় ঈশ্বরের ধারণা বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায়। তবে তাঁকে সাধারণভাবে এমন এক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা এবং নিয়ন্তা। অনেক দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক এই সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণে বিভিন্ন যুক্তি প্রদান করেছেন। তাঁদের মধ্যে খ্রিস্টান দার্শনিক থমাস আকুইনাস এবং ইসলামি দার্শনিক ইমাম আল-গাযালির অবদান অনস্বীকার্য। দুজনেই যুক্তিভিত্তিকভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করেছেন, যদিও তাঁদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট ছিল আলাদা। আকুইনাস পাশ্চাত্য দর্শনে ‘পাঁচটি পথ’ (Five Ways) দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, যা যুক্তি, কারণ এবং দর্শনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। অপরদিকে, আল-গাযালি তাঁর কালাম দর্শন, নৈতিকতা, অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্ববাদের আলোকে ঈশ্বরের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।
এই প্রবন্ধে আমরা এই দুই মনীষীর যুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করব, তুলনামূলকভাবে পর্যালোচনা করব এবং বুঝতে চেষ্টা করব কীভাবে তাঁরা মানুষের যুক্তিবোধের মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
থমাস আকুইনাসের যুক্তিসমূহ
১. গতি থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের যুক্তি (Argument from Motion)
থমাস আকুইনাস তাঁর ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের ‘পাঁচটি পথ’-এর মধ্যে প্রথমটিতে “গতি” বা “পরিবর্তন”কে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, এই বিশ্বজগতে আমরা যা কিছু দেখি, সবকিছুর মধ্যেই কোনো না কোনো রূপে গতি বা পরিবর্তন ঘটছে। গতি মানে কেবল স্থান পরিবর্তন নয়, বরং রূপান্তর, বিকাশ, সৃষ্টির প্রক্রিয়া ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, শীতল পানি গরম হয়, শিশু বড় হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়, গাছের বীজ বৃক্ষে রূপ নেয়—এসবই কোনো না কোনো গতি বা পরিবর্তনের প্রকাশ।
আকুইনাস যুক্তি দেন যে, কোনো বস্তুর মধ্যে গতি ঘটার অর্থ হলো, তা অন্য কোনো কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। অর্থাৎ, কিছু একটা তাকে সরিয়েছে বা রূপান্তরিত করেছে। কিন্তু এই প্রভাবশীল বস্তুও নিশ্চয়ই অন্য কোনো কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এইভাবে যদি আমরা প্রতিটি গতি বা পরিবর্তনের পেছনের কারণ খুঁজতে থাকি, তাহলে একটা দীর্ঘ কারণের শৃঙ্খলে গিয়ে পৌঁছাব, যা পিছনে পিছনে চলতেই থাকবে। কিন্তু আকুইনাস যুক্তি দেন, এই শৃঙ্খল যদি অনন্তকাল চলতে থাকে, তাহলে আসলে কোনো পরিবর্তনের সূচনা হতো না। অর্থাৎ, যদি প্রথম কোনো প্রভাবক বা “মুভার” না থাকে, তাহলে কিছুই শুরু হতো না।
তাই তিনি বলেন, অবশ্যই এমন একটি সত্তা আছে যিনি নিজে কোনো কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হননি, কিন্তু তিনিই সকল গতি ও পরিবর্তনের সূচনা করেছেন। এই প্রথম অচঞ্চল সত্তা, যিনি অন্য সব কিছুকে গতি দিয়েছেন কিন্তু নিজে কখনও পরিবর্তিত হন না—তিনি হচ্ছেন ঈশ্বর (Uncaused Cause)। আকুইনাসের এই যুক্তি একটি ক্লাসিক্যাল যুক্তি হিসেবে পাশ্চাত্য দর্শনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে।
উদাহরণ:
ভাবুন, একটি সারিতে অনেকগুলো ডমিনো দাঁড়িয়ে আছে। তারা নিজেরা পড়ে না যতক্ষণ না প্রথমটি কাউকে ধাক্কা দেয়। কিন্তু যদি কোনো প্রথম ডমিনো না থাকে, তাহলে বাকিগুলোরও কখনো পতন ঘটত না। তাই একটি প্রথম প্রভাবকের অস্তিত্ব অবশ্যই প্রয়োজন, যাকে থমাস আকুইনাস ‘ঈশ্বর’ বলে চিহ্নিত করেন।
২. কার্যকারণ থেকে যুক্তি (Argument from Efficient Cause):
থমাস আকুইনাস তাঁর দ্বিতীয় যুক্তিতে বিশ্বজগতের প্রতিটি ঘটনার পেছনে একটি কারণ রয়েছে—এই নীতিকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন, আমরা যে বিশ্বকে দেখি, সেখানে প্রত্যেকটি ঘটনা বা অস্তিত্বের পেছনে একটি কার্যকর কারণ (Efficient Cause) থাকে। উদাহরণস্বরূপ, একটি গাছের অস্তিত্বের কারণ তার বীজ, একটি শিশুর জন্মের কারণ তার বাবা-মা, কিংবা একটি বাড়ির কারণ সেই নির্মাণকারী ব্যক্তি। এইভাবে সব কিছুর পেছনে আমরা একটি কারণ খুঁজে পাই।
আকুইনাস বলেন, কোনো কিছুই নিজে থেকেই অস্তিত্ব লাভ করে না। প্রতিটি কিছুর উৎপত্তি অন্য কিছু থেকে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই কার্যকারণের শৃঙ্খল কি অনন্তকাল ধরে চলতে পারে? যদি আমরা বলি যে, সব কিছুর পেছনে আরও কিছু কারণ আছে এবং এভাবে শেষ নেই—তাহলে আসলে কিছুই শুরু হতো না। কারণ, যদি প্রথম কোনো কারণ না থাকে, তবে দ্বিতীয় কারণও থাকবে না, আর তৃতীয় বা চতুর্থ কারণও হতে পারত না। তাই এই শৃঙ্খলকে শুরু করতে হলে একটি “প্রথম কার্যকর কারণ” থাকা আবশ্যক, যে নিজে কোনো কিছুর দ্বারা সৃষ্ট নয়। আকুইনাস যুক্তি দেন, এই প্রথম কারণই হচ্ছেন ঈশ্বর।
উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক:
একটি টেবিলের উপর অনেকগুলো বিলিয়ার্ড বল আছে। আপনি একটি বল ঠেলা দিলে তা অন্য বলগুলোকে ঠেলতে থাকে। কিন্তু যদি প্রথম কেউ বল ঠেলাই না, তাহলে পরবর্তী কোনো বলও নড়বে না। যদি কেউ প্রশ্ন করে, এই বলগুলোর চলার পেছনে কে রয়েছে? তাহলে আমাদের বলতে হবে, একজন খেলোয়াড় প্রথম বলটি ঠেলেছেন। যদি আমরা বলি, এমন খেলোয়াড়ই নেই—তাহলে বলগুলো নড়বেই না।
তেমনি, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কার্যকারণের যে চেইন আমরা দেখি, তার পেছনে এক চূড়ান্ত প্রথম কারণ রয়েছে, যিনি নিজে অব্যাখ্যাত এবং অনন্ত। আকুইনাস বলেন, সেই প্রথম কারণই হলেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর।
৩. প্রয়োজনীয় অস্তিত্ব (Argument from Contingency):
থমাস আকুইনাসের তৃতীয় যুক্তি একটি গভীর অস্তিত্ববাদী চিন্তার উপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে তিনি বিশ্বের সকল বস্তু ও জীবের অস্তিত্বকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে তারা প্রত্যেকেই “সম্ভাবনামূলক সত্তা” (Contingent Being)। অর্থাৎ তারা নিজেরা চিরস্থায়ী নয়, একদিন জন্ম নেয়, একদিন বিলীন হয়ে যায়। তারা অস্তিত্ব লাভ করেছে অন্য কোনো কিছুর মাধ্যমে এবং তাদের অস্তিত্ব ধ্বংসও হতে পারে। তাই তারা নিজে থেকে চিরকাল টিকে থাকতে পারে না, বরং তাদের টিকে থাকা নির্ভর করে বাইরের উপাদানের উপর।
এই যুক্তির মূল কথা হলো, যদি পৃথিবীর সব কিছুই এমনই সম্ভাবনামূলক হয়—তাহলে এক সময় তো কিছুই থাকত না। কারণ, সম্ভাবনামূলক সব কিছুর অস্তিত্ব না থাকার সম্ভাবনাও থাকে। কিন্তু আজ আমরা যেহেতু কিছু না কিছু দেখতে পাচ্ছি—বিশ্ব, জীবজগৎ, প্রকৃতি, মানুষ—তাহলে অবশ্যই এমন এক সত্তার অস্তিত্ব থাকতে হবে, যিনি নিজে সম্ভাবনামূলক নন, বরং চিরন্তন এবং আবশ্যক (Necessary Being)। এই সত্তা এমন, যাঁর অস্তিত্ব অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। তিনি নিজেই নিজের অস্তিত্বের কারণ।
উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক:
আপনি কারো কাছে জানতে চাইলেন, “আপনাকে কে সৃষ্টি করেছেন?” তিনি বললেন, “আমার বাবা-মা।” আপনি জিজ্ঞেস করলেন, “তাদের কে সৃষ্টি করেছে?” তিনি বললেন, “তাদের বাবা-মা।” এভাবে পিছনে পিছনে গেলে এক সময় মানুষের প্রথম সৃষ্টি প্রশ্নে এসে পৌঁছাবো। তখন কেউ বলবে, “ঈশ্বর।” যদি কেউ বলে, “ঈশ্বরকেও তো কেউ সৃষ্টি করেছে”—তাহলে সেই স্রষ্টারও স্রষ্টা থাকতে হবে, আবার তারও স্রষ্টা—এভাবে এটি চলে যাবে অনন্ততায়। কিন্তু এটা যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ এই চেইন যদি কখনো না থামে, তাহলে অস্তিত্বের সূচনা কখনোই ঘটত না।
তাই আকুইনাস যুক্তি দেন, অবশ্যই এমন একজন সত্তা আছেন যিনি চিরন্তন, স্বাধীন, এবং যাঁর অস্তিত্বের কোনো শুরু নেই। তিনি কারো দ্বারা সৃষ্ট নন, বরং সমস্ত কিছু তাঁর উপর নির্ভরশীল। এই আবশ্যক সত্তাই হলেন ঈশ্বর।
৪. গুণগত স্তরভেদ (Argument from Gradation):
থমাস আকুইনাসের চতুর্থ যুক্তি মূলত গুণ, সৌন্দর্য, জ্ঞান, নৈতিকতা, শক্তি প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যে মানুষের পার্থক্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তিনি পর্যবেক্ষণ করেন যে, এই জগতে মানুষ ও বস্তুগুলোর মধ্যে বিভিন্ন গুণের স্তরভেদ বা ডিগ্রির পার্থক্য রয়েছে। কেউ কারো চেয়ে অধিক জ্ঞানী, কেউ অধিক সুন্দর, কেউ অধিক সদাচারী। অর্থাৎ, আমরা ভালো, ভালোতর এবং সর্বোত্তম—এমন স্তরে বিষয়গুলোকে বিচার করি।
এই তুলনার ভিত্তি থেকেই আকুইনাস যুক্তি দেন—যেহেতু আমরা কোনো কিছুকে “উত্তম” বলি, সেহেতু অবশ্যই আমাদের মধ্যে একটি মানদণ্ড বা সর্বোচ্চ মান রয়েছে, যার সঙ্গে তুলনা করে আমরা কম বা বেশি গুণমান নির্ধারণ করি। যেমন, একজন গায়কের কণ্ঠকে আমরা বলি ভালো, অন্যজনেরটা আরও ভালো—তাহলে প্রশ্ন হলো, এই “ভালো” এবং “সর্বোত্তম”-এর মাপকাঠি কোথা থেকে আসছে?
তিনি বলেন, এই সর্বোচ্চ মান বা শ্রেষ্ঠতার কোনো না কোনো বাস্তব রূপ অবশ্যই আছে—একটি চূড়ান্ত আদর্শ সত্তা—যার ভেতর এই সকল গুণের পরিপূর্ণতা বিদ্যমান। এই আদর্শ ও পরিপূর্ণ সত্তাই হলেন ঈশ্বর। তিনি সর্বোচ্চ জ্ঞানী, সর্বোচ্চ ন্যায়পরায়ণ, সর্বোচ্চ সুন্দর, সর্বোচ্চ শক্তিশালী—এবং মানবজাতি এসব গুণ অর্জনের ক্ষেত্রে পরোক্ষে তাঁর কাছেই পৌঁছাতে চায়।
উদাহরণ:
একটি গান প্রতিযোগিতায় বিচারকরা প্রতিযোগীদের গায়কী, স্বর, তাল, লয়, ও আবেগ অনুযায়ী নম্বর দেন। কেউ ৮ পায়, কেউ ৯.৫, কেউ ১০। তাহলে প্রশ্ন আসে, এই নম্বর দেওয়ার মানদণ্ড বা আদর্শ কণ্ঠ কাকে ধরে নেওয়া হচ্ছে? নিশ্চয়ই একটি শ্রেষ্ঠ মানসিক চিত্র আছে, যার সঙ্গে তুলনা করে বিচারকরা এই রেটিং দেন।
আকুইনাস বলেন, ঠিক একইভাবে এই জগতে যে গুণগত স্তরভেদ ও শ্রেষ্ঠতার চর্চা আমরা করি, তা প্রমাণ করে যে একটি সর্বোচ্চ, পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুল আদর্শ অস্তিত্ব আছে, যিনি ঈশ্বর।
৫. বুদ্ধিমান স্রষ্টার যুক্তি (Argument from Design):
থমাস আকুইনাস তাঁর পঞ্চম যুক্তিতে বলেন, এই মহাবিশ্বে যে শৃঙ্খলা, নিয়ম, উদ্দেশ্য এবং সৌন্দর্য আমরা দেখতে পাই, তা কেবল দৈবভাবে বা কাকতালীয়ভাবে ঘটতে পারে না। তিনি যুক্তি দেন, এমনকি জড় পদার্থও কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে যায়, যদিও তাদের নিজের কোনো বুদ্ধি নেই। এর মানে, কোনো বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী সত্তা এই সমস্ত জড় বস্তু ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোর পেছনে নির্দেশনা দিচ্ছেন।
এই যুক্তিটি বোঝাতে আমরা কিছু সহজ উদাহরণ নিতে পারি। ধরুন, একটি ঘড়ি। ঘড়ির ভেতরে অসংখ্য যন্ত্রাংশ নিখুঁতভাবে সাজানো রয়েছে এবং প্রতিটি অংশ একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণ করছে—সময় দেখানোর জন্য। আপনি কখনোই বলবেন না, এই ঘড়িটি গাছ থেকে নিজে নিজে পড়ে এসে এমন নিখুঁতভাবে তৈরি হয়েছে। বরং আপনি বলবেন, একজন দক্ষ নির্মাতা ঘড়িটি তৈরি করেছেন।
তেমনি ধরুন, একটি বিল্ডিং, একটি গাড়ি, একটি কম্পিউটার—প্রতিটি জিনিসের গঠন, কাঠামো ও কাজ নির্দেশ করে যে এর পেছনে একজন ডিজাইনার রয়েছেন। তাহলে পুরো মহাবিশ্ব, যেখানে সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে, মৌলিক কণাগুলো নির্দিষ্ট নিয়মে আচরণ করছে, প্রাণীরা নির্দিষ্টভাবে বেঁচে থাকে—এই বিশাল সিস্টেম নিজে নিজে কীভাবে হতে পারে?
আকুইনাস বলেন, এই বিশাল ও জটিল সৃষ্টির প্রতিটি কণা, প্রত্যেক জৈব ও অজৈব উপাদান একটি লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে। আর এমন উদ্দেশ্যমূলক ব্যবস্থা কোনো অজ্ঞান বস্তু তৈরি করতে পারে না। এর পেছনে অবশ্যই একজন পরম বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও সৃষ্টিশীল সত্তা আছেন, যিনি এই পুরো মহাবিশ্বের পরিকল্পক ও নিয়ন্ত্রক। এই পরম পরিকল্পকই হলেন ঈশ্বর।
ইমাম আল-গাযালির যুক্তিসমূহ
১. কালাম বিশ্বতত্ত্বীয় যুক্তি (Kalam Cosmological Argument):
যা কিছু শুরু হয়েছে, তার একটি কারণ আছে।
বিশ্বজগতের শুরু হয়েছে।
অতএব, এর একটি কারণ আছে।
এই যুক্তি অনুসারে, এই কারণই হলো ঈশ্বর, যিনি অনাদি, অকারণ এবং চিরস্থায়ী।
২. উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা থেকে যুক্তি (Teleological Argument):
বিশ্বের জটিলতা, সৌন্দর্য, এবং আইন-কানুন প্রমাণ করে যে এর পেছনে একজন জ্ঞানী ও ক্ষমতাবান স্রষ্টা রয়েছেন। যেমন চোখের জটিল গঠন প্রমাণ করে যে এটি নিপুণভাবে পরিকল্পিত।
৩. নির্ভরতাজনিত যুক্তি (Argument from Contingency):
বিশ্বের সব কিছুই নির্ভরশীল এবং কন্টিনজেন্ট। তাই একজন এমন সত্তার প্রয়োজন, যিনি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং চিরন্তন—তিনি ঈশ্বর।
৪. নৈতিকতার ভিত্তিতে যুক্তি (Argument from Morality):
ন্যায়, দয়া, সততা ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলী সার্বজনীন। এগুলোর ভিত্তি যদি ঈশ্বর না হন, তাহলে এগুলো ব্যক্তিভেদে পরিবর্তনশীল ও অনির্ভরযোগ্য হয়ে পড়ে। তাই ঈশ্বরের অস্তিত্বই নৈতিকতার নির্ভরযোগ্য ভিত্তি।
৫. আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা (Spiritual Argument):
আল-গাযালি বলেন, দোয়া, ধ্যান ও আত্মিক সাধনার মাধ্যমে মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। এই অভিজ্ঞতা যুক্তি ও অনুভবের মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।
উপসংহার
থমাস আকুইনাস ও ইমাম আল-গাযালি—দুই ভিন্ন ধর্মের হলেও তাঁদের যুক্তিগুলো এক মহাসত্যের দিকে ইঙ্গিত করে: এই বিশ্বজগৎ এলোমেলো বা কাকতালীয়ভাবে সৃষ্টি হয়নি; বরং একজন মহান, জ্ঞানী, চিরন্তন এবং পরিপূর্ণ সত্তা—ঈশ্বর—এর সৃষ্টিকর্তা। যুক্তি, দর্শন, নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা সবই মিলেমিশে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে শক্ত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে। মানবতা ঈশ্বরের সন্ধানে যাত্রা করেছে যুক্তি ও বিশ্বাসের আলোকে—এবং এই দুই মনীষী আমাদের সেই পথে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকেন।