নাৎসি জার্মানি ও বিজেপি শাসিত ভারত: যেন একই বৃন্তে দুইটি কুসুম
জার্মানির নাৎসি পার্টির প্রভাবশালী নেতা ফ্যাসিবাদী শাসক আডল্ফ হিটলার যেভাবে রাজত্ব করেছিল ঠিক তারই প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে অদ্য ভারতবর্ষ। এমনকি মনে হচ্ছে যেন নাৎসি জার্মানি ও বিজেপি শাসিত ভারত এক বৃন্তে দুইটি কুসুম। কেননা অদ্য ভারতবর্ষে সকল কিছুই ঠাহর করা যায় যেমনটা ঠিক জার্মানি দেশে শত বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল। ইহুদি ও অন্যান্য সংখ্যালঘু ও কমিউনিস্টরা ফ্যাসিবাদী শাসক আডল্ফ হিটলারের নজরে অভ্যন্তরীণ শত্রু হয়ে উঠেছিল। ফলস্বরূপ,সে ১৯৪১-১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রায় ৬মিলিয়ন অর্থাৎ তৎকালীন ইউরোপের ইহুদি জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ইহুদিকে হত্যা করেছিল । যে মর্মান্তিক গনহত্যার ঘটনাটি হলোকাষ্ট নামে আজও ইতিহাসের পাতায় সন্তাপ ও ভয়াবহের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয় তবে অদ্য ভারতে ঠিক হিটলারের ন্যায়; ভারতের মুসলিম, দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি আরএসএস(রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ) দলের রিমোট কন্ট্রোলিং ভারতের ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নজরে অভ্যন্তরীণ শত্রু হয়ে উঠেছে তাই তিনিও আজ হিটলারকে অবলম্বন করে যা কিছু ঘটিয়ে চলেছে তা দেখে মনে হয় না তেমনই কিছু ভারতেও হতে চলেছে।
হিটলার দেশ থেকে ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য বিভিন্ন প্রকার কলাকৌশলের প্রয়োগ করেছিল। যেমন কি তারই রচিত আত্মজীবনি বই “মেইন কেম্ফ” অর্থাৎ ‘আমার লড়াই’ বইটিতে তার জারিজুরিগুলি উল্লেখ রয়েছে । সেই কৌশলগুলির মধ্যে একটি অন্যতম কৌশল “বিগ লাই” অর্থাৎ বড় মিথ্যা। সুতরাং তুমি এত বড় মিথ্যা বলো এবং সেটিকে বারংবার দ্বিরুক্তি কর এবং তার সাথে সাথে কথার মাঝে মাঝে এমন করে অর্ধ মিথ্যা ও অর্ধ সত্য বলো যে তোমার মিথ্যাটিকে জনগনরা সম্পূর্ণ না হলেও কিছুটা বিশ্বাস করতে বাধ্য় হয়। এই প্রসঙ্গে হিটলারের নাৎসি প্রচার মন্ত্রলয়ের প্রধান গোয়েবেলস বলতেন, যে কোন মিথ্যাকে বারবার প্রচার করলে সেই মিথ্যা সত্যের মত শোনায়। হিটলার এই বিগ লাই কৌশলটি সত্যিই মিডিয়ার দ্বারা বিশেষ করে চলচিত্রের দ্বারা বাস্তবায়িত করেছিলেন। যেমনকি তার শাসনকালে triumph of the will, the traitor, the eternal jew, robert and bertam এর মত প্রভৃতি ইহুদি বিরোধী চলচিত্র প্রকাশ পেয়েছিল। ইদৃশ,কৌশলটিকে ভারতবর্ষেও বর্তমানে বাস্তবায়িত করা হচ্ছে। দ্যা কাশ্মীর ফাইলস, দ্যা কেরালা ষ্টোরি, হুরাইন ৭২, আজমীর ৯২, লিপিস্টিক আন্ডার হিজাবের মত চলচিত্রগুলি প্রকাশিত করা হয়েছে এবং আরও করেও চলেছে। যেই গুলির মূল উদ্দেশ্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো এবং ইসলামোফোবিয়ার মত ভিত্তীহিন পরিভাষা সাধারন মানুষের অন্তরে রোপন করা ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে অন্তরের আক্রোশকে জাগিয়ে তোলা এবং হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ফাসাদ উথাপিত করা।
হিটলারের শাসনকালে জার্মানির বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, নাৎসি পার্টির সংগঠন এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ প্রায় ১৫০০টি ইহুদি-বিরোধী আইন প্রণয়ন করে । ১৯৩৩ সালে, ইহুদিদের বিভিন্ন পেশা এবং সিভিল সার্ভিস থেকে নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল । ১৯৩৪ সালের শেষের দিকে জার্মান ইহুদিদের জনজীবন থেকে বের করে দেওয়ার পর, শাসন ১৯৩৫ সালে নুরেমবার্গ আইন পাস করে । আইনগুলি "জার্মান বা সম্পর্কিত রক্তের" জন্য পূর্ণ নাগরিকত্বের অধিকার সংরক্ষিত করে, ইহুদিদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে সীমাবদ্ধ করে এবং ইহুদি এবং অ-ইহুদি জার্মানদের মধ্যে নতুন বিবাহ এবং যৌন সম্পর্ককে অপরাধী করে। ইহুদি ছাত্রদের মন্থরগতিতে স্কুল ব্যবস্থা থেকে বের করে দেওয়া হয়। হিটলার এইভাবেই ধীরে ধীরে জার্মানির মাটি থেকে ইহুদিদের মুছে ফেলেছিলেন। আর আজ ঠিক তাকেই অনুসরন করে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), বজরং দলের মত প্রভৃতি কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি একজোটে আবদ্ধ হয়ে বিজেপিকে রিমোট কন্ট্রোলিং-এর মাধ্যমে এই সব কুকর্মগুলি সম্পন্ন করছে।
১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দের যেই দিন থেকে এই আরএসএস দলের গাত্রোত্থান হয় সেই দিন থেকেই এই প্রোপোগন্ডাকে লক্ষ্য রেখেই সামনে অগ্রসর হওয়া হচ্ছে এমনকি তারা সত্যিই নানারকম কুকর্ম মুসলিমদের বিপক্ষে বাস্তবায়িত করেছে ও অদ্যাপি করেও চলেছে। যেমনকি,মুঘল সম্রাট বাবরের আমলে স্থাপিত বাবরি মসজিদকে ১৯৯৬ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর ধূলিসাৎ করেছে , ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গা পরিচালিতও করেছে। তবে বিশেষ করে বর্তমানের এই বিজেপি দলের নেতৃত্বধানে এই সকল কাজ পরিচালিত হয়েছে ও অদ্যাপি নেতৃত্ব দিয়েই চলেছে। এমনকি বিজেপি সরকার বিচারবিভাগ, সংবাদপত্র, মিডিয়া, সরকারী গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকেও হিতসাধন করে এই প্রপগেন্ডাকে পূরণ করার জন্য এক মূখ্য হাতিয়ার রূপে ব্য়বহৃত করছে। এনআরসি, সিএএ –এর মত মুসলিম বিরোধি আইন প্রনয়ণ করা হয়েছে। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ আর্টিকাল তুলে দেওয়া হয়েছে। ইসলামের শরীয়তের বিপক্ষে UCC(উনিফর্ম সিভিল কোড)-এর মত নানাধনের বিল প্রনয়ন করার আপ্রান প্রয়াস করে চলেছে। মুসলিমদের ঐতহ্যবাহী স্মৃতি সৌধ, স্থাপত্য,ইদগাহ,মসজিদ ইত্যাদি মুসলিমদের ধর্মীয় স্থানগুলি নিজেদের বলে দাবি করা হচ্ছে অথবা বুলডোজার দিয়ে ভেঙ্গে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হচ্ছে। সর্বদা মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ফাসাদ রটানো হচ্ছে।
কখনও গোহত্যার নামে তো কখনো জয় শ্রীরামের নামে সংখ্যালঘু মুসলিমদের মব লিঞ্চিং করা হচ্ছে। দাড়ি রাখার জন্য, টুপি-হিজাব পরার জন্য পথে ঘাটে যেখানে সেখানে মুসলিমদের অপদস্থ করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্কুল কলেজের মুসলিম জড়িত বিষয়গুলিকে সিলেবাস থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে। বিভিন্ন শহর, ষ্টেসন,ষ্টেডিয়াম,সড়ক,লাইব্রেরি,মিউসিয়াম,এয়ার্পোটের মত মুসলিম নামাঙ্কিত জায়গার নামের পরিবর্তন করে হিন্দুত্ববাদী নামে নামকরণ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে তারা প্রকাশ্য রাস্তায় নামাজ আদায় নিষিদ্ধ করেছে, মসজিদে লাউডস্পিকরে আজান নিষিদ্ধ করেছে, স্কুল-কলেজে নিষিদ্ধ করেছে হিজাব, এই ভাবে ইসলামের প্রতীক ও নিদর্শনগুলোকে একে একে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কর্ম নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামের নামে প্রপগন্ডা ছড়ানো হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে বসে প্রকাশ্যে আমাদের প্রাণপ্রিয় রসূল মুহাম্মাদ (সঃ) সম্পর্কে কটূক্তি করা হচ্ছে।
এছাড়া লাভ জিহাদের মত ধারনাও সেই হিটলারেরই । ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্য়তম প্রতিষ্ঠতা এম এন রায় তাঁর ‘ফ্যাসিজম’ বইয়ের চার নম্বর খন্ডে হিটলারের রচিত বই ‘মেইন ক্যাম্প’ থেকে ধারনাটি কোর্ট করেছেন।
সুতরাং, একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠিকে নির্মূল করার জন্য সেই সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে জনমানসে উপুর্যপরি মিথ্যাচারের মাধ্যমে বিদ্বেষ ও ঘৃণার পরিমন্ডল সৃষ্টি ফ্যাসিবাদীদের অন্যতম কৌশল।
তবে দৃষ্টিপাতের বিষয় , ভারতবর্ষে আসন্ন ২০২৪ লোকসভা ভোটে যদি পুনরায় বিজেপি দল মসনদে উপবেশন করে, তবে কী এই গনতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতবর্ষে মুসলিমদের অস্তিত্ব থাকবে? এছাড়াও ২০২৫সালে হিন্দুবাদী সংঘঠন আরএসএস-এর একশত বৎসর পূর্ণ হতে চলেছে। সুতরাং, অদ্যাপি যদি এই সংগঠন এতকিছু করে নিতে পারে তবে তারা গোল্ডেন জুবলিতে কী অ্যাকশন প্ল্যান বা পদক্ষেপ নিতে পারে?
এই পরিস্থিতিতে দেশের স্বার্থে দেশের জনগনের স্বার্থে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলিমসহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে, একদিন হিটলারের জার্মানির ন্যায় বড় অংশের সংখ্যাগুরু সমাজের সহমতে অথবা নির্লিপ্ততায় ভারতকেও বৃহৎ সংখ্যালঘু গহত্যার সম্মুখীন হতে হবে , ইতিহাসের আলোতে এমন আশঙ্কা মোট অমূলক নয়।