নবীজির জীবন থেকে শিক্ষা দানের পদ্ধতি
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য আদর্শ, তিনার বলা, করা, এবং স্বীকার করা, পুরো জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া আমাদের ওপর অপরিহার্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনার পুরো জীবনে সাহাবা কেরামদের যে পদ্ধতিতে শিক্ষা দিয়েছেন সেই পদ্ধতি আজকালের শিক্ষালয়ে বাস্তবায়ন করা একান্তই জরুরী।
আজকার সমাজে স্কুলে রীতিমতো নিখুঁত পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হয় না, যার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনা থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এই সমাজে শিক্ষার মানে কয়েকটি বই পড়ে শেষ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এবং শিক্ষাদানের অর্থ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক এসে বই থেকে দুই চার অনুচ্ছেদ পরিয়ে চলে যাওয়ার চাইতে আর কিছু না।
শিক্ষাদানের পদ্ধতি যদি শিখতে হয় তাহলে আমাদেরকে নবীজির জীবনের প্রতিটি একক দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। নবীজির জীবন থেকে যে শিক্ষাদানের পদ্ধতি গুলো বাস্তবায়ন করতে পারি সেগুলো হল; কহন, পর্যবেক্ষণ, প্রদর্শন, উপমা বা তুলনা, প্রশ্ন উত্তর, অভিজ্ঞতা পদ্ধতি ইত্যাদি।
১. Telling method বলার পদ্ধতি।
“মদিনায় দুপুর ছিল। বরাবরের মতো, সাহাবীরা মসজিদে নববীতে সমবেত হন (আল-মসজিদ আন-নববী)
তারা প্রার্থনার জন্য অপেক্ষা করছিল৷ ঠিক তখনই খালি পায়ে কিছু লোক এল। তাদের সোজা কাপড় ছিল না।
তাদের পরনে ছিল মোটা পশমের পোশাক। তাদের সব আচরণ থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে সেই পুরুষরা
মুদার গোত্রের ছিল এত অভাবী। সেই অবস্থা দেখে নবী করীম সাঃ হঠাৎ তাঁর মুখমন্ডল
পরিবর্তিত করে নামাজের পর তিনি ভাষণ দেন, তিনি কুরআনের হাশরের 18তম আয়াতটি পড়েন: “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর ব্যাপারে সতর্ক থাকুন এবং প্রত্যেকেরই আগামীকালের জন্য কী প্রস্তুতি নিয়েছো তা দেখতে হবে।”
তিনি তার সঙ্গীদের ডেকে সেই লোকদের সাহায্য করার জন্য উৎসাহ দিলেন। অনেক কম হলেও তাদের যা আছে সেই থেকে দান করে অভাবী লোকদের সাহায্য করার আদেশ দিলেন। সবাই আনলেন
তাদের কাছে যা ছিল সেই থেকে কিছু এবং মসজিদে খাবার ও কাপড়ের দুটি বড় স্তূপ দেখা দিল। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠে এবং বলেন : "যে ব্যক্তি একটি ভাল কাজ (সুন্নত) স্থাপন করে সে যা করেছে এবং তার অনুসারী উভয়ের সাওয়াব পায়।
যে ব্যক্তি একটি খারাপ কাজ (সুন্নত) স্থাপন করে সে নিজের এবং তার অনুসারীদের উভয়ের পাপ গ্রহণ করে।
এই উদাহারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের বিষয়ের উপর সচেতনতা দেওয়ার জন্য বলার পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন এবং অন্যদের সাহায্য করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন।
i.i Story telling technique গল্প বলার কৌশল
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর চেতনা বৃদ্ধির জন্য সাহাবাদেরকে গল্প শুনিয়েছেন যেমন;
একজন মানুষ যে সময় খুব তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে যাত্রা কূপে নেমে পানি পান করল। তিনি যখন বাইরে উঠলেন, তিনি দেখলেন একটি কুকুর পিপাসায় ধুলো খাচ্ছে। তিনি অনুভব করলেন
তার জন্য করুণা হল, আবার কূপে নেমে জুতা জলে ভরে কুকুরটিকে জল দিল। আল্লাহ তার পাপ ক্ষমা করে দিলেন।" সাহাবীরা কৌতূহল সহকারে জিজ্ঞাসা করলেন: “আমাদেরকে কি পানি দেওয়ার জন্য সাওয়াব হবে?
রাসুল (সাঃ) বললেন: “অবশ্যই যে কোন জীবন্ত প্রাণীকে পানি দেওয়ার জন্য সাওয়াব রয়েছে।
১.২ Giving example technique উদাহরণ প্রদান কৌশল
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের নামাজের ফজিলত বোঝাতে গিয়ে একটি উদাহরণ ব্যবহার করেছেন যেন বুঝতে সুবিধা হয়। সেটি হল;
নবী মুহাম্মদ বলেছেন: “যদি তোমাদের কারো দরজার কাছে একটি নদী থাকে এবং তোমরা প্রত্যেকে পাঁচবার তাতে গোসল কর।
আপনি কি মনে করেন যে, তার গায়ে কোন ময়লা থাকবে?
নবী মুহাম্মদ বলেছেন: "পাঁচটি নামায এমনই। আল্লাহ তা দিয়ে গুনাহগুলোকে মুছে দেন।"
১.৩ Comparision technique তুলনা পদ্ধতি
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি বিষয়ের মধ্যে কোন একটি পগুরুত্ত বুঝাতে গিয়ে তুলনা পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন যে হাত চাই এবং যে হাত নেই তার চেয়ে যে হাত দেয় সে উত্তম। অন্য একটি হাদিসে এসেছে এতদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং সেখানে দুটি দল ছিল একদল নামাজ পড়ছিল এবং অন্য দল জ্ঞান শিখছিল তিনি বললেন তারা দুজনেই ভালো করছে একজন নামাজ পড়ছে অন্যরা জ্ঞান শিখছে আমি আল্লার কাছ থেকে শিক্ষক হিসাবে প্রেরিত হয়েছি এবং তারপর তিনি জ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত দলের কাছে বসে গেলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই যে দুই দলের মধ্যে তুলনা করলেন এবং একটিকে প্রাধান্যতা দিলেন, এটি একটি শিক্ষাদানের উচ্চতার পদ্ধতি।
১.৪ Explaining by likening technique উপমা দ্বারা ব্যাখ্যা করা
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে বলেছেন;
"একে অপরকে ভালবাসা, একে অপরের প্রতি করুণা ও সহানুভূতি দেখানোর ক্ষেত্রে, বিশ্বাসীরা একটি দেহের মতো যা অন্য এর অঙ্গগুলি অসুস্থ হয়ে পড়লে নিদ্রাহীনতা এবং উচ্চ জ্বরের সাথে ব্যথা ভাগ করে নেয়।"
অন্য একটি হাদিসে আরও বলেছেন;
"মুসলিম হল খেজুরের মত যার সব সময় পাতা থাকে, ফল দেয়"
প্রথম হাদীসে বিশ্বাস কারীদের একটি শরীরের মতো বলা হয়েছে, যেখানে প্রত্যেক অঙ্গ এক অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেহেতু তারা এক অপরের সাথে সংযুক্ত। এবং দ্বিতীয় হাদীসে খেজুর গাছের সঙ্গে উপমা দেওয়া হয়েছে। এই দুটি হাদিস দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথক সংবাদ দিতে চেয়েছেন; প্রথম হাদিসে বলেছেন যে বিশ্বাসীরা একে অপরের প্রতি অসংবেদনশীল হতে পারে না, একজনের সমস্যা হল সমস্ত সমাজের সমস্যা এবং সেই সমস্যাকে সহযোগিতার দ্বারা সংহতির মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে হবে।
দ্বিতীয় হাদিসে হাদিসের বার্তা হল খেজুর যেমন সমস্ত মানুষের জন্য উপকারী, তেমনি মুসলিম কে সকল প্রাণীর জন্য উপকারী হওয়া উচিত। খেজুর গাছের ফল এবং ছায়া সমস্ত প্রাণীর জন্য দরকারি। মানুষ যদি সাহায্য করতে না পারে তবে তাদের ক্ষতি করা উচিত নয়।
২ Observation পর্যবেক্ষণ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো মানবজাতির জন্য আদর্শ ছিলেন। সাহাবাগণেরা তাদের জীবনের সমস্ত সময়ে নবীর জীবন পর্যবেক্ষণ করেছেন, এবং শেখার চেষ্টা করেছেন, এবং ইসলাম ধর্ম ও তার আনা বিশ্বব্যাপী জীবনের দর্শন বাস্তবায়িত করেছেন। সুতরাং জাহিলিয়া যুগে যারা তাদের কন্যাদের জীবিত মাটিতে কবর দিয়েছিল, দুর্বলের প্রতি অত্যাচার করেছিল তারাই পর্যবেক্ষণের পর ও নবীর আদর্শে আদর্শিত হয়ে ইসলামের সুবর্ণ প্রজন্ম গঠন করেছেন।
৩ Demonstration পদর্ষণ
নবী মুহাম্মদ নামাজ আদায় করলেন যখন তিনি তাঁর নাতনি উমামাকে তাঁর কাছে তিনার কন্য জয়নব এর কাছ থেকে থেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
যখন তিনি দাঁড়ালেন, তিনি তাকে উঠিয়ে নিলেন এবং যখন তিনি সিজদা করলেন, তখন তিনি তাকে নামিয়ে দিলেন।
এবং যখন তার কন্যা ফাতিমা তার সাথে দেখা করতে আসতেন, তখন নবী মুহাম্মদ উঠে দাঁড়াতেন, তাকে হাথ ধরে নিয়ে যেতেন, তার কপালে চুম্বন করতেন এবং তাকে নিজের আসনে বসাতেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এইসব কাম সেই যুগে করিয়ে দেখিয়েছেন যেই সময় কন্যাদের জীবিত মাটিতে কবর দেওয়া হত এবং যদি কোন বাড়িতে কন্যা জন্ম নিত সোসাইটিকে দুর্ভাগ্য ভাবা হতো সমাজের কন্যাদের কোন মর্যাদা দেওয়া হতো না। এইসব কে শেষ করার জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবজাতিকে দেখিয়ে দিলেন যে একটি অন্যায় বা নারীর মর্যাদা কতটা।
৪ Question-answer method প্রশ্ন-উত্তর পদ্ধতি
যখন একজন সাহাবী
নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কার অনুগ্রহ করব? নবীজি উত্তর দিলেন, “প্রথমে তোমার মা, তারপর তোমার বাবাকে কর
আনুকূল্য"
প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া অধিক মাত্রায় শ্রোতাদের ওপর প্রভাব করে শ্রোতা গণেরা বা ছাত্ররা অতি শীঘ্রই বুঝা যায় এই পদ্ধতির দ্বারা এই কারণে রাসূল সাঃ সাহাবাদেরকে প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে অনেক কিছু শিখিয়েছেন।
আকদা তিনি সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলেন: "ব্যভিচার ও চুরি সম্পর্কে তোমরা কি বল?" সাহাবায়ে কেরাম বললেনঃ “ আল্লাহ ও আল্লাহর রসূলই ভালো জানেন।" সুতরাং, নবী তাদের উত্তর দিলেন যে সেইগুলো অপ্রীতিকর জিনিস এবং মানুষের উচিত
তাদের এড়িয়ে চলা।
৫ .Learning by Doing and Experiencing Method কাজ এবং অভিজ্ঞতা পদ্ধতি দ্বারা শেখা
মক্কা ও মদিনা উভয় সময়েই তিনি সাহাবীদের শিক্ষা দিতেন
তিনি আল্লাহর কাছ থেকে যে ওয়াহি গ্রহণ করেছিলেন, বোঝার জন্য সাহায্য করেছেন, সর্বপ্রম নিজে বাস্তবায়ন করে নিজেকে আদর্শ বানিয়েছেন।
জীবনের মধ্যে তাদের বহন সম্পর্কে সঙ্গীদের জন্য একটি আদর্শ হয়েছেন। সুতরাং, ইসলাম ধর্ম এবং তার নীতি
প্রথমে নিজে শিখেছেন তারপর সাথীদের শিখিয়েছেন, এবং অনুভব করেছেন এবং দর্শনে পরিণত হয়েছেন।
জীবন এবং জীবনধারার। হিজরার পর মদিনায় নির্মিত হল আল-মসজিদ আন-নববী যেটি একটি গতিশীল
শিক্ষা-শিক্ষার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এবং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে আপ্তবাক্য ব্যক্তিগতভাবে শেখা হতো।
ইতি কথা যে কেবলমাত্র বই থেকেই শিক্ষা অর্জন করা যায় না আমাদের জীবনে ঘটনা যা ঘটেছে এবং আমরা যা দেখতে পাচ্ছি সমাজে যা গঠিত হচ্ছে সেই সমস্ত কিছু থেকে জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য। তার সঙ্গে সঙ্গেই বই থেকে যা কিছু আমরা শিক্ষা অর্জন করছি সেগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি শিক্ষককে আদর্শ শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নতুন নতুন পদ্ধতি নিয়ে ছাত্রদের কে শিক্ষার আগ্রহী করে তুলতে হবে।