হিরা গুগা ও নাবুওয়াত
আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাবুওয়াত পাওয়ার পূর্বে আল্লাহর প্রেমে এমন ভাবে মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যার কোন সীমা ছিল না। কেননা একদিন তিনি তিনার স্ত্রী খাদিজা রাযী আল্লাহু আনহা কে বললেন যে, হে খাদিজা! আমি চাইছি লোকজন থেকে দূর কোন নির্জন জায়গায় গিয়ে আল্লাহর যিকির করবো। তখন খাদিজা রাযী আল্লাহু আনহা খুব উৎসাহের সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হিরা গুহায় অবস্থান করেন। গুহাটি তিন গজ লম্বা ও একশো গজ চওড়া ছিল। সেখানে গিয়ে তিনি স্বচ্ছ মনে আল্লাহর যিকির করতে শুরু করেন। এমনি ভাবে খাদিজা রাযী আল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য প্রত্যেক দিন খাবার পাঠাতেন। কিন্তু যে খাবার তিনি পাঠাতেন পরের দিন সেই খাবার একই অবস্থাতেই পেতেন। এরিই পরিপেক্ষিতে এক উর্দু কবি বলেন : “যে ব্যক্তি স্বচ্ছ মনে আল্লাহর যিকিরে মত্ত থাকে তার না কোন ক্ষিদে পাবে না পিপাসা”।
এমনি ভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরো ছয় মাস নিজের স্বার্থ, পরিবার ও পরিবেশ ত্যাগ করে আল্লাহর যিকিরে মত্ত থাকেন। যখন আল্লাহর পরিক্ষা সম্পন্ন হল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই পরিক্ষাই সফলতা লাভ করলেন, তখন আল্লাহর বরকত ও রাহমানুর রাহীমের রাহমাত অবতীর্ণ হতে শুরু হল।
হিরা গুহায় থাকা কালীন হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন যে, কেউ যেন তিনাকে গুহা থেকে বের হতে এবং আল্লাহর কুদরতের কারিশ্মা দেখতে বলছে। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গুহা থেকে বাইরে বের হলেন এবং দেখলেন যে, সোনার তৈরি আরাম কেদারা (কুরসী) আকাশ বরাবর ছুঁয়ে আছে এবং ভূমি ও আকাশের মধ্যে ঝুলন্ত অবস্থাই রয়েছে। আরাম কেদারায় আসন গ্রহন করে আছেন এক অতি উজ্জ্বলময় রূপের যুবক। এই সমস্ত দৃশ্য দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভয়ে কাঁপতে শুরু করেন এবং সেই স্থান ত্যাগ করে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। কিছু পথ অতিক্রম করতে না করতেই সাদা কাপড় পরা এক যুবক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে এসে উপস্থিত। যুবক বললেনঃ مُحَمَّد يَا إِقْرَأ
অর্থাৎ, পড়ুন হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : مَا أَنَا بِقَارِئٍ অর্থাৎ, আমি পড়িনি। সেই যুবক যখন পুনরায় বললেন পড়ো হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আবারও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই উত্তর দিলেন। তারপর সেই যুবক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং ছেড়ে দিলেন তারপর আবার বললেন পড়ো হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আবারও কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই উত্তর দিলেন। এরপর আরও দু-বার জিজ্ঞাসা করলেন কিন্তু প্রত্যেকবার একই উত্তর পাওয়া গেল। অবশেষে সেই যুবক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুকে জড়িয়ে খুব জোরে চাপ দিলেন। আবারও জিজ্ঞাসা করাতেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে উঠলেন, বল হে যুবক কি পড়ব ? কারণ শেষ বেলাই সেই যুবক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুকে জড়িয়ে খুব জোরে চাপ দিয়েছিল যার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীনা (বুক) খুলে গিয়েছিল। সাদা কাপড় পরা যুবক বললেন : الأَكْرَمُ وَرَبُّكَ إِقْرَأ * عَلَقِ مِنْ الإِنْسَانَ خَلَقَ * خَلَقَ الَّذِي رَبِّكَ بِسْمِ إِقْرَأ
অর্থাৎঃ- পড়ুন! আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন * মানুষকে রক্তপিন্ড দ্বারা সৃষ্টি করেছেন * পড়ুন! এবং আপনার প্রতিপালক সর্বাপেক্ষা বড় দাতা। এই সমস্ত কিছু পড়ানো ও শিখানোর পর সেই সাদা কাপড় পরা যুবকটি কথাও যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। এদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়াতগুলি স্মরণে রেখে কাঁপতে কাঁপতে খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহার কাছে এলেন এবং বললেন, زَمِّلُونِ
অর্থাৎ, আমাকে চাদর দ্বারা আচ্ছাদিত করো। তখন তিনাকে চাদর দ্বারা আবৃত করা হল। কিন্তু কিছুতেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শারীরিক কম্পন বন্ধ হচ্ছে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনাবরত কাঁপতেই আছেন এবং বলছেন : “হে খাদীজা ! আমি হয়তো আর বাঁচবো না”। এই কথা শুনে খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন : “না না আপনিতো দীর্ঘজীবী হবেন, কারণ আপনিতো অনেক সাখী এবং সাখীর জন্যে জলের মাছেরা ও ভূমির পিঁপড়েরাও সর্বদা দুআ করতে থাকেন”।
অতঃপর যখন খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা দেখলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই পরিস্থিতি তখন তিনি বললেন : “আপনি হতাশ হবেন না, কাল সকাল হলেই আমি আপনাকে আমার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফালের নিকট নিয়ে যাব”। সকাল হতেই খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল ইবনে আসাদ ইবনে আব্দিল উযযা ইবনে কুসাই –এর নিকট নিয়ে গেলেন এবং বললেন, হে ভাই ! একটু মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে দেখ এবং বলো তিনার কি হয়েছে। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন। তিনার হিরা গুহা থেকে বের হয়ে আসা এবং কুরসীতে আসন গ্রহন এবং অল্প কিছু আয়াত শেখানো।
এই সমস্ত ঘটনা শোনার পর ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল বুঝে গেল যে এই তাহলে সেই রাসূল বা নাবী যার বর্ণনা তাওরাতে, যাবুরয়ে ও ইঞ্জিলে এসেছে। ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল বলতে লাগলেন, হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তুমি আল্লাহর নাবী ও রাসূল হয়ে গিয়েছ এবং আল্লাহর প্রীয় বান্দা হয়ে উঠেছ। যেই উদ্দেশে তুমি হিরা গুহায় অবস্থান করেছিলে, আজ তুমি সেই উদ্দেশে সফল হয়েছ। সেই কুরসীতে আসন গ্রহণ ছিল প্রীয় জিবরীল আমীন যিনি তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল এই কারণে, যেন তোমার বুক (সীনা) মোবারক ভরে যায় নূর দিয়ে। তোমাকে কিছু আয়াত শিখিয়েছিলেন ও বাশারাত (সু-সংবাদ) দিয়েছেন রাহমাতুল্লিল আলামিনের।
অবশেষে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী বলে পরিগণিত হলেন। যদিও তিনি শুরুতে গুপ্ত ভাবে ইসলাম প্রচার করতেন কিন্তু পরবর্তীতে প্রকাশ্য ভাবে ইসলামকে ছড়িয়েছেন। যার কারণে আজ সারা বিশ্বে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নই আজ সারা বিশ্বে ইসলাম ধর্ম দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে গেছে।