নবী মুহাম্মদের (ﷺ) প্রশংসায় ভারতীয় অমুসলিম বুদ্ধিজীবী

মুহাম্মদ (ﷺ) যার অর্থ প্রশংসনীয় - যাকে খোদ সর্বজ্ঞানী স্রষ্টা মহান আল্লাহ তাআ’লা প্রশংসা করেছেন - জগৎ প্রশংসা না করে কি থাকতে পারে? বুদ্ধিসম্পূর্ণ শত্রু-মিত্র, বাস্তব সবার কাছে সত্য, অস্বীকারের কিছু নয়। ভারত দেশও ব্যাতিক্রম নয় যেখানকার অমুসলিম বুদ্ধিজীবীর বড়ো এক দল শান্তিদূত হযরত মুহাম্মদের (ﷺ) প্রশংসা মালা গেঁথেছেন।

   ভারতীয় সভ্যতার এক অভিনব বৈশিষ্ট হল জ্ঞান উন্মোচন - শাস্ত্র, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ইত্যাদি। অন্যদিকে আবার অবাঞ্ছিত উপাদানও বিদ্যামনা - বর্ণপ্রথা, সতীদাহ, শোষণমূলক সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, অস্পৃশ্যতা এবং আরও অনেক।  বর্তমান ভারত কোন দিকে যাচ্ছে স্পষ্ট - তবুও আলোচনা ও মূল্যায়নের বিষয়। যাই হোক না কেন ইটা পরিষ্কার - সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, জাতিকেন্দ্রিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, সংখ্যালঘু নিপীড়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে শিকার হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসখ্যা মুসলিম সম্প্রদায়। মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষের এই চড়ন কালে শান্তিকরণ কারণের দিকে লক্ষ করা চাই। বহু ভারতীয় অমুসলিম বিশ্বনবী মুহাম্মদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে সততার পরিচয় দিয়েছেন। বিদ্বেষী মানসিকতার লোকদের এই ভারত-অধ্যায় ঘুরে দেখা উচিত। এটাই মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে - সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ব এবং সামাজিক সংহতির পথে যাওয়ার।

   দিল্লীর ইসলামিক ফিকহ একাডেমী এবং হায়দ্রাবাদের মৌলানা আজাদ জাতীয় উর্দু বিশ্ববিদ্যালয় (মানু) গত ফেব্রুয়ারী মাসে ‘ইসলামিক স্টাডিজে ভারতীয় অমসুলিমদের অবমান’ নামে একটি কনফারেন্স আয়োজন করে। আলোচনা পত্রে বহু অজানা তথ্য উন্মুক্ত হয়। নবীজির (ﷺ) নামে কবিতা, জীবনী, প্রবন্ধ, অনুবাদ, তুলনামূলক আলোচনা, বৈদিক চর্চা এবং অনেক গবেষণামূলক কাজ হয়েছে এই ভারত মাটিতে, তবুও আবার অমুসলিমদের হস্তে।

   সর্ব প্রথম নাম আসে প্রয়াগ ইউনিভার্সিটি সংস্কৃতিক পন্ডিত ড. বেদ প্রকাশ উপাধ্যায়ের। তাঁর হিন্দি বই ‘কল্কি অবতার এবং মোহাম্মদ সাহেব’ সারস্বত বেদান্ত প্রকাশ সংঘ দ্বারা ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। বেদ, পুরান, মহাভারত এবং অন্যান্য হিন্দু শাস্ত্রে মুহাম্মদের (ﷺ) সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এবং বর্ণনা প্রমানসহ বিশ্লেষণ করেছেন। অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায় 'মহাভারতে মুহাম্মাদের ব্যাখ্যা' নামে বইটি বাংলায় অনুবাদ করেন। তারপর ‘মুহাম্মদ ইন দ্যা হিন্দু স্ক্রিপচারস’ নামন্তরের সাথে ইংরেজি অনুবাদ করেন মুহাম্মাদ আলঙ্গির যা  ২০১১ সালে মালয়েশিয়া থেকে প্রকাশিত হয়।  

   অনুরূপ অমুসলিম কর্তৃক নবীর (ﷺ) ওপর সুন্দর হিন্দি বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুন্দর লালের ‘হাজরাত মুহাম্মদ আওর ইসলাম’ (প্রকাশক বিশ্ব অমরনাথ, বিশ্ববাণী প্রেস, নভেম্বর ১৯৪১), স্বামী লাক্সমান প্রাসাদের ‘আরব কা চাঁদ’ (প্রকাশক মাকতাবা তামির-এ -ইনসানিয়াত, ১৯৮৯), ইত্যাদি।

  কনফারেন্সটির কনসেপ্ট নোটে অনেক কবিদের নাম তালিকাবদ্ধ করা হয় যাঁরা ওপর কবিতার শব্দ-শ্লোকে নবীর (ﷺ) প্রশংসা মালা গেঁথেছেন। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু চৌধুরী দিলু রাম কাউসারী কলমনামে নবীর (ﷺ) প্রশংসায় চল্লিশটিরও অধিক কবিতা রচনা করেন যা একটি কাব্যগ্রন্থ সংকলনে ‘হিন্দু কি নাত’ (প্রকাশক: খাজা হাসান নিজামী, ১৯৩৭) নামে প্রকাশ করা হয়। পরে অবশই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনার একটি কবিতা এরকম: “কুছ ইশ্ক-এ-মুহাম্মদ (ﷺ) মেইন নাহিন শর্ত-এ-মুসলমান! হায় কাউসারী হিন্দু ভি তালাবগার-এ-মুহাম্মদ (ﷺ)! আল্লাহ রে! ক্যায়া রওনাক-এ-বাজার-এ-মুহাম্মদ (ﷺ) কে মাবুদ-এ-জাহান ভি হায় খরিদার-এ-মুহাম্মদ (ﷺ)!” (মুহাম্মদকে (ﷺ) ভালোবাসার জন্য মুসলিম হওয়া শর্ত নয়! হিন্দু কাওসারীও মুহাম্মদের (ﷺ) সন্ধানকারী! আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর বাজার কতই না মনোরম যে বিশ্ব প্রতিপালকও একজন খরিদার।)  

   আরও নবী প্রেমী কবিদের মধ্যে মহারাজা কিষান প্রাসাদ, মুন্সী শঙ্কর লাল সাকী, মনোহর লাল বিহার, জ্যোতিবা ফুলে এবং জাগান নাথ আজাদ, প্রমুখ। 

   নবী মুহাম্মদের (ﷺ) প্রশংসায় ভারতীয় অমুসলিম মহাপুরুষদের তালিকায় দেশের পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীও অন্তর্ভুক্ত। তিনিও নবীর (ﷺ) ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ ছিলেন। একবার তিনি তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া (১৯২৪) সংস্করণে বলেন: “...যেকোনো সময়ের চেয়ে আমি বেশি নিশ্চিত যে ইসলাম তরবারির মাধ্যমে সেইসব দিনগুলোতে মানুষের জীবন-ধারণ পদ্ধতিতে স্থান করে নেয়নি। ইসলামের প্রসারের কারণ হিসেবে কাজ করেছে নবীর (ﷺ) দৃঢ় সরলতা, নিজেকে মূল্যহীন প্রতিভাত করা, ভবিষ্যতের ব্যাপারে সতর্ক ভাবনা, বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য নিজেকে চরমভাবে উৎসর্গ করা, তাঁর অটল সাহস, ভয়হীনতা, ঈশ্বর এবং তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্বে অসীম বিশ্বাস।” (বাংলা অনুবাদ: ইন্টারনেট উৎস) অনুরুপ স্বাধীনতা সময়কালীন সরোজিনী নাইডু, অ্যানি বেসান্ত, দিয়ান চাঁদ শর্মা প্রমুখ ব্যক্তিত্ব।

   সারাংশে দর্শন প্রফেসর কে. এস. রামকৃষ্ণ রায়ের জনপ্রিয় একটি প্রশংসা উক্তি দিয়ে প্রবন্ধটি সমাপ্ত করা যাক। তাঁর বিখ্যাত ‘মুহাম্মদ: দ্যা প্রফেট অফ ইসলাম’ বইয়ে নবীকে ‘মানুষ্য জীবনের সর্বশ্রেষ্ট নিখুঁত আদর্শ’ বলে সম্মোধন করে বলেন: “মুহাম্মদের  (ﷺ) ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে জানা কঠিন। আমি শুধু তাঁর একটু আভাসই পেতে পারি। কী আশ্চর্যজনক ধারাবাহিকতার দৃশ্য! যেখানে মুহাম্মাদ (সাঃ)  নবী। সেখানে মুহাম্মদ (ﷺ) যোদ্ধা, মুহাম্মদ (ﷺ) ব্যবসায়ী; মুহাম্মদ (ﷺ) রাষ্ট্রনায়ক; মুহাম্মদ  (ﷺ) বক্তা; মুহাম্মদ  (ﷺ) সংস্কারক; মুহাম্মদ (ﷺ) দাসদের রক্ষাকারী; মুহাম্মাদ (ﷺ) নারীর মুক্তিদাতা; মুহাম্মদ  (ﷺ) বিচারক; মুহাম্মদ  (ﷺ) সাধক। এই সমস্ত মহৎ ভূমিকায়, মানবিক কার্যকলাপের এই সমস্ত বিভাগে, তিনি একজন বীরের মতো।” তালিকা আরও লম্বা।” 

  

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter