ইসলামী নেতৃত্ব গঠনে শিক্ষার্থীদের অপরিহার্য দায়িত্ব
ভূমিকা
ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের জীবনের সকল স্তরকে পরিচালিত করে। এই জীবনব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, একটি আদর্শ সমাজ গঠন করা এবং জনহিতকর নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বকে আলোকিত করা। এই ধরণের নেতৃত্ব কেবল ধর্মের ক্ষেত্রেই নয়, বরং রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই ইসলামী নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই ক্ষেত্রে, আজকের ছাত্ররা ভবিষ্যতের সমাজ ও জাতির শক্তি হিসেবে ইসলামী নেতৃত্ব উৎপাদনে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ইসলামী আন্দোলনের বেশিরভাগ বড় পরিবর্তন এসেছে তরুণদের হাত ধরে।
নবীর সাহাবীদের বেশিরভাগই ছিলেন তরুণ; উদাহরণস্বরূপ, আলী (রাঃ), মুস'আব ইবনে উমাইর (রাঃ), উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ), যাদের কাঁধে দাওয়াহ, নেতৃত্ব এবং জিহাদের ভার ছিল। এই যুবকরা ইসলামী নেতৃত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, যার প্রভাব আমরা আজও অনুভব করি। এই প্রজন্মের তরুণরা শিক্ষা, চরিত্র, তাকওয়া এবং দাওয়াতে পরিপূর্ণ ছিল, যার কারণে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শের প্রকৃত অভিভাবক হয়ে উঠতে পেরেছিল। বর্তমান বিশ্বের সর্বত্র মুসলিম সমাজ বিভিন্ন ব্যাধিতে জর্জরিত—নৈতিক অবক্ষয়, নেতৃত্বের অভাব, ইসলাম বিরোধী প্রচারণা এবং আধুনিক গণমাধ্যমের বিপথগামী ভূমিকা। এগুলো থেকে মুক্তি পেতে হলে ইসলামী মূল্যবোধে পরিপূর্ণ শিক্ষিত, চিন্তাশীল এবং দক্ষ নেতাদের গড়ে তোলা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের নেতা হবে, তাই তাদের অবিলম্বে প্রস্তুত করা উচিত। ইসলামী নেতৃত্ব কোন পদবি বা পদ নয়; এটি একটি কর্তব্য, একটি আমানত, যার জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
নেতৃত্ব হলো জনগণের যত্ন নেওয়া, ন্যায়বিচার বাস্তবায়ন করা এবং মানুষকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করা। এই দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং তাদের আদর্শিকভাবে শক্তিশালী করা বর্তমান যুগের অন্যতম চাহিদা। এই প্রবন্ধে, আমরা দেখব কিভাবে শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে ইসলামী নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করতে পারে এবং তাদের কী ধরণের গুণ অর্জন করতে হবে। এর সাথে, শিক্ষার্থীদের এই দায়িত্ব সমাজে কীভাবে পরিবর্তন আনতে পারে তার বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরা হবে।
শিক্ষার্থীদের চরিত্র বিকাশের মাধ্যমে নেতৃত্বের বিকাশ
একজন শিক্ষার্থী বই পড়ে নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করতে পারে না। নেতৃত্বের বিকাশের জন্য ব্যক্তিত্বের বিকাশ, চিন্তাশীলতা, নীতিবোধ, নীতিবোধ, আত্মত্যাগ এবং ধর্মীয় জ্ঞানে দৃঢ়তা প্রয়োজন। ইসলামী নেতৃত্বের ভিত্তি হলো আল্লাহর প্রতি ভয় এবং হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর নীতির উপর দাঁড়ানো। বর্তমান যুগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইসলামী নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রথম পূর্বশর্ত হলো বিশ্বাসের দৃঢ়তা। এই বিশ্বাস শিক্ষার্থীদের আল্লাহর উপর নির্ভরশীল, বিশ্বস্ত এবং আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। যদি একজন শিক্ষার্থী বিশ্বাসী হয়, তাহলে সে কখনও অন্যায়ের সাথে আপস করবে না, বরং সমাজে ন্যায়বিচার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।
দ্বিতীয়ত, একজন ভবিষ্যৎ নেতাকে সুশিক্ষিত হতে হবে। নবী ﷺ বর্ণনা করেছেন: "তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি যে কুরআন শেখে এবং অন্যদের শিক্ষা দেয়।" (বুখারী)। ইসলামী শিক্ষার্থীদের নিজস্ব পড়াশোনার পাশাপাশি কুরআন, হাদিস, ফিকহ, ইতিহাস এবং সমসাময়িক বিষয়বস্তু সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে। কারণ নেতৃত্ব আবেগপ্রবণ জিনিস নয়, প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতা প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, একজন আদর্শ ইসলামী নেতা হতে চরিত্রের বিশুদ্ধতা প্রয়োজন। হযরত ওমর (রা.)-এর মতো একজন ব্যক্তি ছিলেন নেতৃত্বের এক আদর্শ যিনি রাতে মানুষের কাছে যেতেন এবং দরিদ্রদের দরজায় খাবার বিতরণ করতেন। সেই আদর্শ অনুকরণ করার জন্য, শিক্ষার্থীদের শৈশব থেকেই আত্মশুদ্ধির অনুশীলন করতে হবে, অহংকার ত্যাগ করতে হবে এবং তাদের হৃদয়ে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে।
চতুর্থত, দায়িত্ব হলো নেতৃত্ব। একজন নেতা কখনো তার স্বার্থের কথা ভাবেন না, বরং উম্মাহর কল্যাণ ও ভবিষ্যতের কথা ভাবেন। আজকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার মাধ্যমেই তারা ভবিষ্যতে একদিন একটি সুস্থ, শক্তিশালী এবং আলোকিত নেতৃত্বের জন্ম দিতে সক্ষম হবে। এর জন্য, শিক্ষার্থীদের সংগঠিত হওয়া উচিত, তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে ইসলামী আদর্শ নিয়ে কাজ করা উচিত এবং তাদের চারপাশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া উচিত।
পঞ্চমত, নেতৃত্ব বিকাশে সহনশীলতা এবং পরামর্শের ভূমিকা অতুলনীয়। আল্লাহতায়ালা কুরআনে উল্লেখ করেছেন: "এবং তাদের সাথে পরামর্শ করো, এবং যখন তুমি সিদ্ধান্ত নিবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করো।" (সূরা আলে ইমরান: ১৫৯)। এই বৈশিষ্ট্যগুলি শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্থাপন করতে হবে - যাতে তারা অহংকারী না হয়ে দলগত চিন্তাবিদ হয়ে ওঠে, অন্যের মতামতকে সম্মান করতে শেখে এবং ধর্মীয় বিষয়ে একমত হয়। তদুপরি, নেতৃত্বের আরেকটি অপরিহার্য গুণ হল যোগাযোগের ক্ষমতা। যদি একজন শিক্ষার্থী ইসলামী ধারণা প্রচার করতে চায়, তাহলে তার ভাষা, অভিব্যক্তি, নম্রতা এবং আত্মবিশ্বাস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যুগে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রয়োগ, বক্তৃতা, লেখা, ভিডিও উপস্থাপনা ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলামী বার্তা প্রচার এবং একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সর্বোপরি, শিক্ষার্থীদের সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে শেখা উচিত। তাদের খেলাধুলা, বিনোদন বা অপ্রয়োজনীয় কার্যকলাপে অতিরিক্ত সময় নষ্ট করা উচিত নয়। বরং, তাদের নিজেদেরকে কুরআন হাফেজ, ধর্ম প্রচারক, সমাজ সংস্কারক এবং ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে প্রস্তুত করা উচিত।
উপসংহার
ইসলামের নেতৃত্ব গঠনে শিক্ষার্থীদের কর্তব্য কোন দার্শনিক ধারণা নয়; এটি একটি বাস্তব এবং বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। ভবিষ্যতের নেতারা হলেন বর্তমান শিক্ষার্থীরা। সমাজে বিপ্লব ঘটানোর জন্য নেতৃত্বকে বিপ্লবী করা উচিত; এবং নেতৃত্বের বিপ্লব ঘটানোর জন্য নেতৃত্ব-সক্ষম ব্যক্তিদের গঠন করা উচিত। এই দায়িত্ব পালনের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য দল হল ছাত্র সমাজ। যদি একজন শিক্ষার্থী শৈশব থেকেই ইসলামী নৈতিকতায় লালিত-পালিত হয়, সৎকর্মে নিবেদিতপ্রাণ হয়, শেখার জন্য আগ্রহী হয় এবং নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যে নিজেকে সক্ষম করে তোলে, তাহলে সে নিজেই পথপ্রদর্শনের উৎস হবে। সে কেবল নিজের জন্য নয়, বরং সমগ্র সমাজের জন্য নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। কুরআন বলে— “তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্য উত্থিত। সৎকাজের আদেশ দাও এবং অন্যায়কে নিষেধ করো এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখো।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১১০) শিক্ষার্থীদের সময় এবং শক্তি নষ্ট না করে সমাজ গঠনে নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে।
বিশ্বব্যাপী ইসলামোফোবিয়া, নৈতিক অবক্ষয় এবং মুসলিম সমাজে নেতৃত্বের অভাবের এই কঠিন যুগে, শিক্ষার্থীদের ইসলামের প্রকৃত বার্তা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। একদিকে, তারা নিজেদেরকে সক্ষম করে তুলবে, অন্যদিকে, তারা সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে। অতএব, ইসলামী নেতৃত্ব গঠনে শিক্ষার্থীদের কর্তব্য কোনও পছন্দ নয়; এটি একটি বাধ্যতামূলক কর্তব্য। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে, আমরা আশা করি যে আমাদের ছাত্রসমাজ এই কর্তব্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করবে এবং নিজেদেরকে প্রকৃত ইসলামী নেতা হিসেবে গড়ে তুলবে - যারা ঈশ্বরভীরু, জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ, সমাজবান্ধব এবং মানবজাতির সেবায় নিবেদিতপ্রাণ।