বিভেদ ও সংঘাতের মধ্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের শিক্ষা ও সম্প্রীতির  বার্তা

আজকের দুনিয়ায় ধর্মীয় বিভেদ, অসহিষ্ণুতা এবং সংঘাত দিন দিন বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা যদি অতীতের দিকে ফিরে তাকাই, দেখতে পাই কেমন করে এক মহামানব এইসব বিভেদের মাঝে থেকে সম্প্রীতির বাণী প্রচার করেছিলেন। সেই মহামানব ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। তার জীবন ও কাজ আমাদের সামনে এমন এক আদর্শ তুলে ধরে, যা মানুষের মধ্যে বোঝাপড়া ও সৌহার্দ্যের ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য আজও প্রাসঙ্গিক। স্যার সৈয়দের জীবনের মূলমন্ত্র ছিল শিক্ষার মাধ্যমে ঐক্যের বার্তা ছড়ানো।

স্যার সৈয়দ বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষা কেবলমাত্র জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং এর মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি মৈত্রী ও বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষা একটি শক্তিশালী অস্ত্র যা মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে পারে। তাই তিনি শিক্ষাকে তার প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। স্যার সৈয়দের মতে, শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি বাড়ানো সম্ভব। 

ভারতের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এখানে বহু সময় ধরেই বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মধ্যে বিদ্বেষ আর সংঘাত ছিল। উপনিবেশিক আমলে ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতি দ্বারা এই বিদ্বেষকে আরো বাড়িয়ে তোলা হয়েছিল। এই নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো হয়। কিন্তু সেই বিভাজনের মাঝে দাঁড়িয়েও স্যার সৈয়দ ভারতীয় পরিচয়ের উপর জোর দিয়েছিলেন, যেখানে সকল ধর্ম ও জাতি একসঙ্গে বাস করতে পারে।

স্যার সৈয়দ বলতেন, “আমরা একই মাটি থেকে শস্য সংগ্রহ করি, একই নদী থেকে পানি পান করি, একই বাতাসে শ্বাস নেই।” তিনি বিশ্বাস করতেন যে, হিন্দু-মুসলিম উভয়ই ভারতের সেরা সম্পদ, যারা একে অপরের পরিপূরক। স্যার সৈয়দ হিন্দু-মুসলিম একতার উপর ভরসা রাখতেন এবং সমাজে সম্প্রীতির বার্তা ছড়াতে শিক্ষা ব্যবস্থার বিকাশ ঘটান। তার এই মিশন তখনই আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন তিনি অনুভব করলেন, সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া ভারত কখনোই প্রকৃত উন্নতি লাভ করতে পারবে না।

স্যার সৈয়দের জীবনের অন্যতম প্রধান অর্জন হলো আলীগড় আন্দোলন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। আলীগড় আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো, কারণ সেই সময়ে ভারতীয় মুসলমানরা শিক্ষায় পিছিয়ে পড়েছিল। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে তিনি মুহাম্মদান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে (এএমইউ) পরিণত হয়।

আলীগড় আন্দোলন শুধু শিক্ষার বিস্তারেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি হিন্দু-মুসলিম একতাকেও গুরুত্ব দিয়েছিল। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে পরিচালিত হতো, যেখানে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের শিক্ষার্থীরা একত্রে পড়াশোনা করত। প্রথম স্নাতক ইশ্বরী প্রসাদ এবং প্রথম স্নাতকোত্তর আম্বা প্রসাদ ছিলেন হিন্দু, যা তার প্রতিষ্ঠানের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের প্রমাণ দেয়। 

এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্যার সৈয়দ বুঝিয়েছিলেন যে, প্রকৃত শিক্ষা তখনই সম্ভব, যখন তা সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। শিক্ষার মাধ্যমে তিনি ধর্মীয় ভেদাভেদ দূর করতে চেয়েছিলেন এবং সমাজে একটি সামগ্রিক ও সহনশীল মানসিকতার প্রচলন ঘটাতে চেয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন মানসিকতা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়াতে সক্ষম হবে।

স্যার সৈয়দ মনে করতেন, ধর্মের মূল লক্ষ্য হলো মানবতার সেবা করা এবং মানবমুক্তির পথে নিয়ে যাওয়া। তার মতে, সব ধর্মের মূল কথা হলো শান্তি, দয়া এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা। তাই তিনি বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সংলাপ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি ধর্ম ও  বিজ্ঞানের শিক্ষার মধ্যে মিল খুঁজে বের করার জন্য তাফসির-উল-কুরান রচনা করেছিলেন। 

স্যার সৈয়দ জানতেন, হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধর্মীয় সহনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৮৭ সালের ঈদ-উল-আযহা উদযাপনের সময় তিনি মুসলমানদেরকে গরু কুরবানী না করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, যা ছিল হিন্দুদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি পদক্ষেপ। তার এই অনুরোধ ছিল সম্প্রীতি স্থাপনের একটি বাস্তব উদাহরণ, যা পরে আলীগড় ইনস্টিটিউট গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, “যদি মুসলমানরা একটু নমনীয়তা দেখায়, তবে তাদের এই পদক্ষেপ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এক দীর্ঘস্থায়ী বন্ধন গড়ে তুলবে।” 

স্যার সৈয়দ বুঝতে পেরেছিলেন যে, শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনা সম্ভব। তাই তিনি শিক্ষাকে শুধু একটি ব্যক্তিগত অর্জন হিসেবে না দেখে সামাজিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল, সমাজের সব স্তরের মানুষ যদি শিক্ষার মাধ্যমে যুক্ত হয়, তাহলে সমাজের সকল স্তরে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের সমাজেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। 

স্যার সৈয়দ আহমদ খানের সবচেয়ে বড় অবদান হলো আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, যা আজও ভারতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মিনি ভারত’ আখ্যায়িত করেছিলেন, যা ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির নিদর্শন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা একত্রে পড়াশোনা করে, যা ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধের প্রতিফলন।

স্যার সৈয়দ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন এক চারিত্রিক গুণাবলি তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা তাদেরকে ভালো মানুষ এবং সমাজের উন্নয়নের যোগ্য সদস্য হিসেবে গড়ে তুলবে। তার মতে, শিক্ষা কেবলমাত্র পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য নয়, বরং একজন মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষাও দিতে হবে, যাতে সে সমাজের মঙ্গলার্থে কাজ করতে পারে।

আজকের পৃথিবীতে ধর্মীয় সংঘাত এবং অসহিষ্ণুতার মধ্যে স্যার সৈয়দের জীবনের আদর্শ ও তার বার্তা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহানুভূতি ও বোঝাপড়া থাকলে ধর্মীয় ভেদাভেদ দূর করা সম্ভব। তার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আজকের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে নতুনভাবে ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারি। 

স্যার সৈয়দ আহমদ খানের জীবন ও তার কাজ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শিক্ষা, মানবতা এবং ঐক্যের প্রতি প্রতিশ্রুতি সমাজকে শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ করতে পারে। তার দেখানো পথ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সব সম্প্রদায়ের মধ্যে সহানুভূতি ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে সম্প্রীতি স্থাপন সম্ভব এবং এই আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই আমরা একটি সুন্দর, উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে পারি।




Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter