সৌলাতুন্নিসা বেগম এবং মাদ্রাসা সউলাতিয়্যাহ
একজন বাঙালি নারীর শিক্ষা প্রচার এবং আরবে ইসলামি শিক্ষার বিকাশ
সৌলাতুন্নিসা বেগম ছিলেন এক অনন্য মুসলিম নারী, যিনি শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছেন। উনিশ শতকের কলকাতায় জন্ম নেওয়া এই মহীয়সী নারী শুধুমাত্র ধর্মপ্রাণ ছিলেন না, বরং শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তার চিন্তাভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সুদূরপ্রসারী। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে মুসলিম সমাজের উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন তারা ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জীবনঘনিষ্ঠ জ্ঞান অর্জন করবে। তার এই উপলব্ধিই তাকে একটি স্থায়ী উদ্যোগ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, যা পরবর্তীতে মাদ্রাসা সউলাতিয়্যাহ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাস্তবে রূপ নেয়।
১৮৭৩ সালে সৌলাতুন্নিসা বেগম হজ পালনের জন্য মক্কায় যান। সেখানে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, ইসলামী শিক্ষার জন্য একটি সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজন, যা কেবল ধর্মীয় অনুশীলনের জন্যই নয়, বরং সমাজের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে। তখন তিনি তার নিজের সম্পদ থেকে একটি বিশাল অংশ দান করে একটি সুন্নি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার এই উদ্যোগের ফলস্বরূপ জন্ম নেয় মাদ্রাসা সউলাতিয়্যাহ, যা ইসলামি শিক্ষার এক অনন্য কেন্দ্র হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে এটি আল-খানদানিসা এলাকায় স্থাপিত হয়, তবে কিছু সময় পরেই এটি বিশাল খ্যাতি অর্জন করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
মাদ্রাসা সউলাতিয়্যাহর শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষভাবে সুন্নি মতবাদের প্রচার ও প্রসারের জন্য গড়ে ওঠে। এখানে কুরআন ও হাদিসের উপর ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষাদানের শুরুর দিকের অন্যতম প্রধান শিক্ষক ছিলেন শাইখ ইব্রাহিম সাঈদ মিসরি, যিনি কুরআন শিক্ষাদানের দায়িত্ব পালন করতেন। অন্যদিকে, শাইখ রহমতুল্লাহ সহিহ আল-বুখারি পাঠদান করতেন। শিক্ষার্থীদের শুধু ধর্মীয় জ্ঞানেই দক্ষ করা হতো না, বরং তাদের চিন্তাশক্তি, গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও জোর দেওয়া হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাদ্রাসা সউলাতিয়্যাহ তার শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে এবং এতে ইসলামি দর্শন, ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান এবং অর্থনীতিও পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং একাডেমিক গবেষণার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। সৌলাতুন্নিসা বেগমের এই মাদ্রাসাটি শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়। এখানে শিক্ষালাভ করা বহু ব্যক্তি পরবর্তীতে ইসলাম প্রচার, গবেষণা এবং নৈতিক শিক্ষার বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষত সুন্নি মতাদর্শের প্রচারে এই মাদ্রাসার ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।
মাদ্রাসা সউলাতিয়্যাহর শিক্ষাব্যবস্থা, যা "সৌলাতিয়্যাহ শিক্ষাব্যবস্থা" নামে পরিচিত, এটিকে অন্যান্য ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে স্বতন্ত্র করেছে। এই শিক্ষাব্যবস্থার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, এটি সুন্নি ইসলামি চিন্তাধারা ও দর্শনকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। শিক্ষার্থীরা এখানে কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের উপর ভিত্তি করে শিক্ষাগ্রহণ করে, যা তাদেরকে ইসলামি জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। দ্বিতীয়ত, এটি কেবল ধর্মীয় শিক্ষায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং আধুনিক বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা, ইতিহাস এবং ভাষা শিক্ষাকেও গুরুত্ব দেয়। এটি ইসলামী ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক জ্ঞানকে একত্রিত করে একটি সুষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। নারী শিক্ষার প্রসারে সৌলাতুন্নিসা বেগমের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল অত্যন্ত আধুনিক ও সময়োপযোগী। তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য নারীদের শিক্ষিত হওয়া অপরিহার্য। যদিও উনিশ শতকে নারীশিক্ষার সুযোগ সীমিত ছিল, তবুও তিনি নারীদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার উল্লেখ করতেন। তিনি চেয়েছিলেন, মুসলিম নারীরা যেন শুধু গৃহস্থালির কাজে সীমাবদ্ধ না থেকে শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখতে পারে। আজকের দিনে নারীশিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য, এবং সৌলাতুন্নিসা বেগমের চিন্তাধারা এই বাস্তবতাকে বহু বছর আগেই ধারণ করেছিল।
বর্তমানে মাদ্রাসা সউলাতিয়্যাহ সৌদি আরবের অন্যতম প্রাচীন ও স্বীকৃত ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি শুধু ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানই করে না, বরং ইসলামিক স্কলার তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করছে। এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা ব্যক্তিরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামের প্রচার, গবেষণা ও শিক্ষা বিস্তারের জন্য নিয়োজিত রয়েছেন। মাদ্রাসাটি তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষার আলোকে ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সৌলাতুন্নিসা বেগম শুধু একজন শিক্ষানুরাগীই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন এক বিপ্লবী নারী, যিনি মুসলিম সমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি মুসলিম শিক্ষার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আজও এই প্রতিষ্ঠান ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে এবং মুসলিম সমাজের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে। সৌলাতুন্নিসা বেগমের এই অসামান্য অবদান চিরকাল মুসলিম বিশ্বে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার প্রচেষ্টা ও অবদানের ফলে আজকের দিনে ইসলামিক শিক্ষার প্রচারে যে অগ্রগতি দেখা যায়, তার পেছনে মাদ্রাসা সউলাতিয়্যাহর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান অস্বীকার করা যায় না। তার দেখানো পথ ধরে মুসলিম সমাজ শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও এটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
মাদ্রাসা সউলাতিয়্যাহর শিক্ষা কার্যক্রম:
প্রতিষ্ঠানটির শুরুতে শিক্ষাদানের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কুরআন ও হাদিস। শুরুতে কুরআন শেখানোর দায়িত্বে ছিলেন শাইখ ইব্রাহিম সাঈদ মিসরি এবং সহিহ আল-বুখারি শিক্ষা দিতেন শাইখ রহমতুল্লাহ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষাদান শুরু করে। আজ এটি ইসলামী জ্ঞান চর্চার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রভাব ও প্রসার:
মাদ্রাসা সউলাতিয়্যাহ শুধু মক্কায় নয়, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। এটি ইসলামের মৌলিক শিক্ষাকে সুসংগঠিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচার এবং শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছেন।
নারীদের শিক্ষা ও সৌলাতুন্নিসা বেগমের দৃষ্টিভঙ্গি:
সৌলাতুন্নিসা বেগম শুধু শিক্ষাবিস্তারে অবদান রাখেননি, বরং নারী শিক্ষার গুরুত্বও অনুধাবন করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যাতে মুসলিম নারীরা সুশিক্ষিত হয়ে সমাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। আজকের দিনে তার এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সৌলাতুন্নিসা বেগম শুধু একজন শিক্ষানুরাগী নন, বরং তিনি ছিলেন এক বিপ্লবী নারী, যিনি শিক্ষার মাধ্যমে মুসলিম সমাজের উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। তার গড়ে তোলা মাদ্রাসা সউলাতিয়্যাহ আজও ইসলামি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।